ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫, ৩০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইরানে কেন আক্রমণ?

আরিফ আনজুম
ইরানে কেন আক্রমণ?

আগে কেউ কখনও এভাবে কল্পনাও করেনি যে, ইসরায়েল ইরানে সামরিক আক্রমণ চালাবে। আসলে এটা কি একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল? মোটেই না। অনেক দিনের প্রস্তুতি, অনেকগুলো ছোট আক্রমণের পরে পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধের এই নতুনমাত্রার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের গণহত্যার মধ্যে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের একটানা আক্রমণ চলছে। হাজার হাজার বার বিমান হানা হয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণ হয়েছে, পরে স্থলবাহিনী ঢুকেছে। অন্তত ৫৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন, প্রায় ২ লাখ মানুষ আহত হয়েছেন। গাজায় অক্ষত কাঠামো বলে কিছু নেই। যখন এই আক্রমণ শুরু হয়, তখন যুক্তি ছিল ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ঢুকে হামাসের আক্রমণ। তখন এই পৃথিবীকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছিল ২০০২, ২০০৪, ২০০৮, ২০১২ সালের দিকে গাজায় ইসরায়েলের একতরফা সামরিক আক্রমণের ইতিহাস, যখন হামাসের ইসরায়েলের ভূখণ্ডে প্রবেশের কোনো ঘটনাই ছিল না। হামাস যে নয়, ইসরায়েলের লক্ষ্য বস্তু যে সব ফিলিস্তিনি, যে শিশু সবেমাত্র পৃথিবীর আলো দেখেছে, এমনকি যে শিশু এখনও ভূমিষ্ঠ হয়নি, তারাও তা যথেষ্ট স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন ইসরায়েলের একের পর এক শীর্ষ নেতা। গাজায় বোমারু বিমানের সঙ্গেই অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে, অনাহারকে কোনো সাহায্য কেউ পাঠাতে পারবে না। স্টারভেশন ওয়ার। চোখ যদি অন্যদিকে সরে না থাকে তাহলে লক্ষ্য করা যাবে গত একমাস ধরে ইসরায়েলের আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু সাহায্য নিতে দাঁড়ানো শিবিরের সামনে মানুষের সারি। প্রত্যেক দিন শুধু সাহায্য শিবিরেই নিহত হচ্ছেন ৬০ থেকে ১০০ জন করে মানুষ। গাজা ছাড়িয়ে এক সময়ে এই আক্রমণ পৌঁছেছে ওয়েস্ট ব্যাংকে, জেনিনে। গাজায় কোনো ফিলিস্তিনির বসতি থাকবে না, এই লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওয়েস্ট ব্যাংকে ইসরায়েলের বেআইনি বসতি শিবিরের বিস্তার। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি। হামাসের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ইসমাইল হানিয়ে, ইয়াহিয়া শিনওয়ার নিহত হয়েছেন। হামাসের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তবে এদিন পর্যন্ত হামাস বা সাধারণভাবে ফিলিস্তিনির প্রতিরোধ নিঃশেষ হয়ে যায়নি। রাষ্ট্র সংঘের অজস্র বিবৃতি, সংঘর্ষ বিরতির জন্য কৃত্রিম বৈঠকের পরেও এই গণহত্যা প্রায় অবাধে চলেছে। ফিলিস্তিনে এই গণহত্যার সময়েই পালটা প্রতিরোধে নেমেছিল লেবানন, আরও স্পষ্ট করে বললে সেখানকার হেজবুল্লাহ। দক্ষিণ ইসরায়েলে তারা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল ইসরায়েলি বাহিনীকে কিছু মাত্রায় ব্যস্ত রাখার জন্য। শেষ পর্যন্ত ইসরায়েল বিপুল মাত্রায় লেবানন আক্রমণ করে, হেজবুল্লাহের শীর্ষ নেতা হাসান নাসারাল্লাকে হত্যা করতেও সমর্থ হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো সিরিয়া। সেখানে ‘শাসন পরিবর্তন’ বা ‘রেজিম চেঞ্জ’-এর জন্য ২০১১ থেকে চেষ্টা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং ইসরায়েল। বাসার আল আসাদের সরকারকে হটানোর জন্য তথাকথিত গৃহযুদ্ধ তৈরি করা হয়েছে। এমন ‘গৃহযুদ্ধ’ যেখানে অন্য দেশ থেকে পাঠানো হয়েছে শয়ে শয়ে সন্ত্রাসবাদী। উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চেচনিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়েছে প্রাক্তন আল কায়েদা বা অন্য সন্ত্রাসবাদীদের।

জাবাত আল নুসরা, আইসিসের পাশে মার্কিন সমর্থিত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট, ফ্রি সিরিয়ান আর্মির বাহিনীকে ঢেলে অস্ত্র দিয়েছে আমেরিকা, তুরস্ক। তুরস্ক সীমান্ত দিয়ে তারা সিরিয়ায় ঢুকেছে। আল কায়েদা থেকে ইরাকে আইসিস হয়ে নুসরা ফ্রন্ট, তারপরে হায়াত তাহরির আল-শাম তৈরি করা নেতা আহমেদ হুসেইন আল-শারা শেষ পর্যন্ত ২০২৪-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে দ্রুত দামাস্কাস দখল করতে সমর্থ হন। তার এই অভিযানে মার্কিন মদদ তো ছিলই, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বোমারু বিমান পাঠিয়ে সাহায্য করেছিল। আল-শারা এখন সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি। আসাদ দেশান্তরী, ইসরায়েলের বহুদিনের বৈরী সিরিয়া এখন ইসরায়েলে-মার্কিন অক্ষের বন্ধু। ইসরায়েল আরও এক ধাপ এগিয়েছে। এবার ইরান। ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ ছিল, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে। তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, যার অন্যতম হলো তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ করতে পারবে না। ইরান একটানা বলে এসেছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, কোনো অস্ত্র তৈরির অভিপ্রায় তাদের নেই। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা নজরদারি দল পাঠিয়েছে একাধিক বার। তারা বলেছে, অস্ত্র তৈরি করছে এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো, চীন, রাশিয়ার সঙ্গে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে একটি চুক্তি হয়। লক্ষণীয়, ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সময়ে এই আলোচনা থেকে তার দেশকে সরিয়ে নেন। আবার এই ট্রাম্পই নতুন করে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। যেদিন ইরান-মার্কিন আলোচনা শুরুর কথা তার দুই দিন আগেই ইসরায়েল ইরান আক্রমণ করল। ইরানের পরমাণু পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে আক্রমণ হলো, এমনকি শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করা হলো। কেউই এই অভিযোগ করেনি, এমনকি ইসরায়েলও না যে ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে। এ বছরের মার্চ মাসে মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা অধিকর্তা তুলসী গাবার্ড নিজেই বলেন, ইরান কোনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে না। ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসনের আগে মার্কিন প্রশাসন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা এই মর্মে আওয়াজ তুলেছিল যে ইরাকের হাতে ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’ রয়েছে।

এই অজুহাত সামনে রেখেই ইরাকে আক্রমণ চালানো হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হয় ওই অভিযোগ ভুয়া এবং পরিকল্পিতভাবে সেই অভিযোগ তৈরি করা হয়েছিল। এখন ইরানের বিরুদ্ধে সেই অভিযোগও তোলা হচ্ছে না, ‘পরমাণু কর্মসূচি’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইরানই কিন্তু কয়েক দশক ধরে পরমাণু অস্ত্র মুক্ত মধ্য প্রাচ্য এলাকা গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়ে চলেছে। ইসরায়েলকে বাঁচাতে এই প্রস্তাব নিয়ে রাষ্ট্র সংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো কোনো তৎপরতা দেখায় না। কঠিন বাস্তব হলো- মধ্যপ্রাচ্যে পরমাণু অস্ত্র রয়েছে একমাত্র ইসরায়েলের হাতে। অথচ ইসরায়েল স্বীকৃত পরমাণু শক্তিধর দেশ নয়, কোনো আন্তর্জাতিক বিধির আওতায় নেই।

ইরানের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ কেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার পশ্চিমী মিত্র, ইসরায়েলের সামরিক তত্ত্ব হলো ইরান, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন মিলে একটি ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ রয়েছে। প্রতিরোধ কাকে? পশ্চিম এশিয়ায় ইসরায়েলের একচেটিয়া দখলদারি, মার্কিন সামরিক ছক এবং তথাকথিত মার্কিন পছন্দের ‘বৃহত্তর মধ্য প্রাচ্য’ মানচিত্রের প্রতিরোধ। অনুগত আরব দেশগুলো এই প্রতিরোধে শামিল না।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, ইরানের অস্তিত্বই ইসরায়েলের অস্তিত্বের পক্ষে বিপদ। ঠিক যেভাবে ফিলিস্তিন ধ্বংসের কারণ হিসেবে একই যুক্তি খাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু এত কথা বোঝার দরকার পড়ে না যদি কেউ ১২ জুন মার্কিন রাষ্ট্রপতির নিজের সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল- এ পোস্ট করা বিবৃতিটি পড়ে দেখেন। ট্রাম্প লিখছেন, আমি ইরানকে বারবার সমঝোতা করে নিতে বলেছি। কিন্তু তা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। ইসরায়েলের কাছে তার অনেক কিছুই রয়েছে এবং আরও আসছে। তারা জানে কীভাবে তা ব্যবহার করতে হয়। কিছু কট্টরপন্থি ইরানের লোক সাহস দেখিয়েছিলেন; কিন্তু তারা জানতেন না কী হতে চলেছে, তারা সবাই এখন মৃত। আরও বড় আক্রমণ হতে চলেছে, এককালের ইরানি সাম্রাজ্য মুছে যাবার আগে এখনই সমঝোতা করে নিন।

ইসরায়েলকে যে মার্কিনীরা অস্ত্র সরবরাহ করে, তা দুনিয়ায় সবাই জানে। মার্কিন অস্ত্রেই ইসরায়েলের দাপট। ট্রাম্প একবার বলছেন, ইরানে হানার আগে তিনি কিছু জানতেন না। আরেকবার কথা পাল্টে বলছেন, জানতাম কিন্তু আমেরিকা যুক্ত হয়নি। এমনকি ভয়ঙ্করতম অস্ত্র প্রয়োগের ইঙ্গিতও দিচ্ছেন। ট্রাম্পকে অনেকেই বলেন, তার মতির স্থির নেই। লগ্নি পুঁজির জন্য তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন। শুধু মধ্য প্রাচ্যেই আমেরিকার ঘোষিত ১৯টি স্থায়ী ঘাঁটি রয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। ভূমধ্য সাগরে মার্কিন রণতরীর বহর রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ইসরায়েল নিজেই। এই দুর্বৃত্ত দেশটি আসলে আমেরিকার কাঠপুতুল। গাজায় আক্রমণের সময়েও বারংবার দেখা গেছে তদানীন্তন মার্কিন বিদেশ সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব তেলআবিবে গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। রাষ্ট্র সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে ওয়াশিংটন। কোলের ছেলে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যাবতীয় সামরিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক অস্ত্র প্রয়োগ করে আমেরিকা। ইরানে সামরিক আক্রমণ মার্কিন- ইসরায়েল যৌথ রণনীতিরই ফসল। ইরানে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামো নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মানবাধিকারের পরিধিতে প্রশ্ন তোলার ন্যায়সঙ্গত কারণ রয়েছে। কিন্তু ইরানের সার্বভৌমত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন তো নেই। ইরানের শাসকদের বিরুদ্ধে টানা লড়াইয়ে থাকা বামপন্থি তুদে পার্টি তাদের বিবৃতিতে ইসরায়েলের এই আক্রমণকে সাম্রাজ্যবাদের মদদে জায়নবাদী আক্রমণ বলে চিহ্নিত করেছে। দেশের ভূখণ্ড, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সর্বাত্মক প্রতিরোধের ডাকও দিয়েছে।

ইসরায়েল যেভাবে গাজায় বর্বরতা চালাতে পেরেছে, রাষ্ট্র সংঘ থেকে শুরু করে প্রায় কারোরই প্রকৃত বাঁধার মুখে তাদের পড়তে হয়নি, তা তাদের সীমাহীন দুঃসাহস জুগিয়েছে। কিন্তু এখন তাল কেটেছে। ইরানের প্রত্যাঘাতের মুখে তাদের পড়তে হবে, তা ইসরায়েলের নীতি নির্ধারকরা ভেবে উঠতে পারেননি। ইসরায়েলে অনেক শহরেই ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে। বাঙ্কারে জীবন কাটছে ইসরায়েলি নাগরিকদের। ইসরায়েলে সেন্সর শিপ চালু হয়ে গেছে, সংবাদ মাধ্যমে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির কথা উচ্চারণ করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কেন এই আক্রমণ ইরানের এই সংঘাতের অবসান হয়তো এই বারের যুদ্ধবিগ্রহের সমস্যার অবসানের মাধ্যমে সমাধান হবে। ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বে মুসলিম জাহান আজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে পতিত হচ্ছে। আমাদের এই বিশ্বের সব মুসলিমকে এক ছাতায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে খুব শিগগিরই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত