ঢাকা শুক্রবার, ১৮ জুলাই ২০২৫, ৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দরজা ভেঙে ধর্ষণ : নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ সংকেত

মো: শামীম মিয়া
দরজা ভেঙে ধর্ষণ : নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ সংকেত

বাংলাদেশের নারীরা কি সত্যিই নিরাপদ? এই প্রশ্ন বারবার উঠে আসে, যখন আমরা সংবাদপত্রের পাতায় দেখতে পাই ধর্ষণ, নিপীড়ন ও সহিংসতার বেদনাদায়ক খবর। সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার এক গ্রামে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা যেন সমাজের মুখে আরেকবার আঘাত হেনে বলছে- নারীর নিরাপত্তা আজ চরমভাবে হুমকির মুখে। ঘটনাটি নিছক একটি আইনি অপরাধ নয়, বরং এটি নারী-অধিকার, মানবিকতা এবং রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার ওপর সরাসরি প্রশ্ন তোলে। ভুক্তভোগী নারী ছিলেন বাবার বাড়িতে। পূজার অনুষ্ঠানে পরিবারের অন্য সদস্যরা বাইরে গেলে, রাত ১০টার দিকে ফজর আলী নামের এক ব্যক্তি জোর করে দরজা ভেঙে বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে ধর্ষণ করে। এটাই শুধু নয়- ঘটনার পর ‘তথাকথিত’ গ্রামবাসীদের কেউ কেউ ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এই নির্মমতা যেন এক মহাঅন্ধকারের প্রতীক।

পুলিশ জানিয়েছে, প্রধান অভিযুক্ত ফজর আলীকে রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে আরও চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুক্তভোগীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে রুজু করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও কিছু প্রশ্ন আমাদের বিবেককে বিদ্ধ করে- কেন একজন নারী নিজের বাবার ঘরেও নিরাপদ নয়? কেন ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরেও তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা ও সামাজিকভাবে অপমানিত হতে হয়? আর সবচেয়ে ভয়াবহ- কেন ভুক্তভোগীর গোপন দুর্বল মুহূর্তের ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয় বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছাড়াই?

একজন নারী, দুইবার নির্যাতনের শিকার : ধর্ষণ নিছক শরীরঘটিত সহিংসতা নয়; এটি এক গভীর মানসিক ও সামাজিক নিপীড়ন। ধর্ষণের শিকার নারীরা একদিকে যেমন শারীরিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হন, অন্যদিকে সমাজের কৌতূহল, অবজ্ঞা এবং ভিডিও ছড়ানোর মতো নির্মম ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আরও একবার নিপীড়নের শিকার হন। মুরাদনগরের এই ঘটনাটিতেই দেখা গেল- ভুক্তভোগী নারীকে উদ্ধার করার সময়ে কেউ কেউ তাকে মারধর করেছেন, ভিডিও করেছেন এবং সেই ভিডিও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন জাগে, এই সমাজ কি ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নাকি ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকেই দোষারোপ করার পক্ষে?

সাংবাদিকতা, নাগরিক দায়িত্ব কিংবা সামাজিক সচেতনতার নামে এই ধরনের কাজগুলো আসলে একধরনের ‘দ্বিতীয় সহিংসতা’। ভুক্তভোগীর সম্মানহানি, মানসিক বিপর্যয় ও ভবিষ্যতের পথে পাথর হয়ে দাঁড়ায় এই অমানবিক আচরণ। আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ কোথায়? বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রয়েছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু শাস্তির ভয় কি অপরাধ কমাচ্ছে? উত্তর হলো- না। কারণ আইন থাকলেও, সেই আইন প্রয়োগে দীর্ঘসূত্রতা, বিচারপ্রক্রিয়ায় দুর্বলতা, সাক্ষ্যগ্রহণে জটিলতা এবং সামাজিক চাপের কারণে বহু ধর্ষণের মামলা শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তিহীন থেকে যায়।

মুরাদনগরের ঘটনাতেও দেখা গেছে, প্রথমে অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হলেও তিনি হাসপাতালে পালিয়ে যান। পরে তাকে ঢাকায় খুঁজে পেতে হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে- একজন ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত আসামি পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে পারেন? এখানে পুলিশের দায়িত্বশীলতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ, তেমনি গোটা সিস্টেমের কার্যকারিতাও। ধর্মীয় পরিচয় ও প্রান্তিকতা ভুক্তভোগী নারী হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যা ঘটনাটিকে আরও একটি মাত্রায় স্পর্শ করে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীরা সমাজে প্রান্তিক ও অরক্ষিত অবস্থানে থাকে। ফলে তারা অনেক সময় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয় বা দ্বিগুণ সামাজিক চাপের মুখোমুখি হয়। এই বাস্তবতাও প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় রাখা উচিত।

সমাজের নীরবতা কি অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছে?

সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো- এই ঘটনাগুলোর পেছনে সমাজের এক ধরনের মৌন প্রশ্রয় কাজ করছে। প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনেও সময়মতো সাহায্যে এগিয়ে আসেননি। পরে যখন এগিয়ে এসেছেন, তখন মানবিকতার বদলে তারা দেখিয়েছেন চরম কৌতূহল ও হীনমন্যতা। ভিডিও ধারণ, মারধর- এসব প্রমাণ করে, এই সমাজে ভুক্তভোগীকে সম্মান নয়, সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমন সমাজে ধর্ষকের বিচার হলেও, ধর্ষণের সংস্কৃতি পাল্টাবে না। আর যদি সংস্কৃতি না পাল্টায়, তাহলে আগামীকাল হয়তো আরও একটি দরজা ভাঙবে, আরও একটি নারী চুপচাপ হারিয়ে যাবে সমাজের নীরবতার মধ্যে। সমাধানের পথ কোথায়?

এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন : দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার, ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচারপ্রক্রিয়া বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।

ভিডিও ছড়ানো বন্ধে কঠোর শাস্তি : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিদ্যমান আইন অনুযায়ী ভিডিও ছড়ানোকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ভুক্তভোগীর আইনি ও মানসিক সহায়তা : নির্যাতিত নারীর জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনজীবী, মনোপরামর্শ এবং আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি : স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও গণমাধ্যমকে যৌন সহিংসতা ও সম্মানবোধ বিষয়ে ইতিবাচক ও মানবিক শিক্ষা দিতে হবে। মুরাদনগরের এই ধর্ষণ কেবল একটি গ্রামের ঘটনা নয়- এটি একটি জাতীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

সমাজের প্রতিটি দরজা যদি নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়ে, তাহলে সে সমাজ কখনোই সভ্য হতে পারে না। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নারীর প্রতি সম্মান ও সহানুভূতির মানসিকতা গড়ে তোলা। সামাজিক নীরবতা আর প্রযুক্তির অপব্যবহার যদি একইসঙ্গে সহিংসতাকে ঢেকে রাখে, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ আরও ভয়ানক হতে বাধ্য।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত