প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫
বিবাহ, মানবসমাজের অন্যতম পবিত্র বন্ধন, যা দুটি জীবন ও পরিবারকে একসূত্রে গেঁথে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ জীবনে এই পবিত্র সম্পর্ক প্রায়শই ‘যৌতুক’ নামক এক ভয়ংকর ব্যাধির শিকার। কনের পরিবার থেকে বরের পরিবারকে নগদ অর্থ, মূল্যবানসামগ্রী বা সম্পত্তি প্রদানের এই কুপ্রথা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও সমাজের গভীরে শিকড় গেঁড়ে আছে। একসময় এই প্রথা নির্দিষ্ট কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, বর্তমানে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের উচ্চবিত্ত থেকে দরিদ্রতম স্তর পর্যন্ত এর কালো ছায়া বিস্তৃত হয়েছে। যৌতুক প্রথা শুধু আর্থিক শোষণ নয়, এটি নারীকে পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করে, তার স্বাধীনতা ও মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত হানে এবং পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনের পথে এই প্রথা এক বিরাট প্রতিবন্ধকতা, যা নারীদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে এবং বহু পরিবারে অশান্তি ও বিচ্ছেদের জন্ম দিচ্ছে। এই প্রথা যে শুধু গ্রাম বা বস্তি এলাকাতেই সীমাবদ্ধ তা নয়, বরং শিক্ষিত ও বিত্তবান পরিবারেও ‘উপহার’ বা ‘সম্মান’ রক্ষার নামে চলে এই অর্থনৈতিক লেনদেন, যা এর সর্বব্যাপী বিস্তারের প্রমাণ বহন করে।
যৌতুকের এই ভয়াবহতা পরিসংখ্যানের আয়নায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) মতো সরকারি সংস্থা এবং বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন, যেমন- বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, নিয়মিতভাবে যৌতুক-সংক্রান্ত নির্যাতনের তথ্য প্রকাশ করে। এই জরিপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, দেশের বিশাল সংখ্যক বিয়েতে কোনো না কোনোভাবে যৌতুক লেনদেন ঘটে, যা আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং সামাজিক স্বীকৃতির ফল। প্রতি বছর শত শত নারী যৌতুক-সংক্রান্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। যৌতুকের দাবিতে অগ্নিদগ্ধ করা, নির্মম শারীরিক আঘাতের মাধ্যমে পঙ্গু করা, ঘর থেকে বিতাড়িত করা এবং ক্ষেত্রবিশেষে আত্মহত্যার প্ররোচনা বা নির্মমভাবে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা সংবাদপত্রের পাতায় প্রায় প্রতিদিন শিরোনাম হয়। এসব পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, যৌতুক শুধু একটি অর্থনৈতিক সমস্যা বা প্রথা নয়, এটি একটি জীবনবিনাশী সামাজিক সন্ত্রাস। যৌতুকের বলি হওয়া নারীরা অনেক সময় আইনের আশ্রয় নিতে ভয় পান, কারণ তারা মনে করেন এতে তাদের বৈবাহিক জীবন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আবার, দুর্বল আর্থ-সামাজিক পটভূমির কারণে অনেকেই আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে যেতে চান, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করে এবং এই চক্রকে চিরস্থায়ী রূপ দেয়।
যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ অনুযায়ী যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া উভয়ই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইন ভঙ্গকারীকে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এত কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও এই প্রথা সমাজের বুক থেকে নির্মূল না হওয়ার মূল কারণগুলো বহুমুখী। প্রথমত, আইনের দুর্বল এবং ক্ষেত্রবিশেষে ত্রুটিপূর্ণ প্রয়োগ একটি বড় কারণ। অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক বা স্থানীয় প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে মামলা দুর্বল হয়ে যায় বা দীর্ঘসূত্রিতায় আটকে থাকে। দ্বিতীয়ত, সমাজের মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এখনও ছেলের পরিবারকে উচ্চতর এবং অর্থনৈতিকভাবে বেশি সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হিসেবে দেখা হয়। তৃতীয়ত, বর্তমানে সরাসরি যৌতুক না চেয়ে ‘উপহার’, ‘আনুষ্ঠানিক উপহার’ বা ‘বিলাস সামগ্রী’ নামক ছদ্মবেশে অর্থ বা সামগ্রী দাবি করা হয়। বরপক্ষ এটিকে যৌতুক হিসেবে চিহ্নিত না করে কনেপক্ষ থেকে ‘খুশি’ হয়ে দেওয়া দান হিসেবে দেখায়। লোকলজ্জা বা মেয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যাওয়ার ভয়ে কনেপক্ষ বাধ্য হয়ে এই ‘উপহার’ দেয়, যা প্রমাণ করা কঠিন হওয়ায় আইনি নজর এড়িয়ে যায় এবং অপরাধীরা সহজেই মুক্তি পায়। এছাড়া, দীর্ঘদিনের প্রথাগত বিশ্বাস হলো- বিয়েতে মেয়ের পরিবারকে কিছু দিতেই হবে। এই প্রথাগত বিশ্বাস মানসিকতার পরিবর্তনে বড় বাধা সৃষ্টি করছে এবং যৌতুক প্রথাকে এক ধরনের সামাজিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে। সামাজিক চাপের কারণে অনেক শিক্ষিত পরিবারও এই প্রথার বাইরে যেতে পারে না।
এই সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, আইনি কঠোরতা এবং মানসিকতার আমূল পরিবর্তন। প্রথমত, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে যৌতুকের কুফল সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে যৌতুক বর্জনের শপথ নিতে উৎসাহিত করতে হবে এবং ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে উভয়কেই তাদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনে যৌতুকমুক্ত থাকার অঙ্গীকার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নারীর শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করে তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা গেলে যৌতুককে কেন্দ্র করে সৃষ্ট চাপ অনেকটা কমে আসবে। একজন স্বাবলম্বী নারী তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে এবং যৌতুকবিহীন বিয়েতে আত্মবিশ্বাসী হতে সক্ষম হবেন। তৃতীয়ত, যৌতুক নিরোধ আইনকে আরও কঠোর করতে হবে এবং ‘উপহারের’ নামে ছদ্মবেশে নেওয়া যৌতুক প্রমাণে আইনগত প্রক্রিয়াকে সহজ ও কার্যকরী করতে হবে। যৌতুক দাবিকারী বা গ্রহণকারীকে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে, যাতে সমাজের অন্যরা ভয় পায় এবং এমন অপরাধ থেকে বিরত থাকে। চতুর্থত, স্থানীয় পর্যায়ে শক্তিশালী সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। যে পরিবার যৌতুক দাবি করে বা গ্রহণ করে, তাদের সামাজিকভাবে বর্জন করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ধর্মীয় নেতারাও যৌতুককে অনৈসলামিক বা অনৈতিক কাজ হিসেবে প্রচার করে সমাজের নৈতিক ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, যৌতুক প্রথা শুধু একটি সামাজিক সমস্যা নয়, এটি মানবতা ও নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। এই প্রথার বিলোপ শুধু আইনি প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়, এর জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক ও মানসিক পরিবর্তন, যেখানে কন্যাসন্তানকে ‘বোঝা’ না ভেবে সম্পদ মনে করার মানসিকতা তৈরি হবে। একটি সমাজ তখনই প্রগতিশীল হতে পারে যখন তার নারীরা হয় সুরক্ষিত ও সম্মানিত। প্রতিটি নাগরিককে এই সামাজিক অভিশাপের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে এবং যৌতুকবিহীন একটি মানবিক সমাজ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু আইন প্রণয়ন করা নয়, আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং সমাজকে সচেতনতার আলোয় উদ্ভাসিত করা। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারি এবং একটি সুস্থ, সাম্যভিত্তিক সমাজ নির্মাণ করতে পারি, যেখানে বিবাহ হবে শুধুই ভালোবাসা ও প্রতিশ্রুতির পবিত্র বন্ধন।
জান্নাতুল ফেরদৌস জেরিন
শিক্ষার্থী বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়