ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আগাম সতর্কবার্তাই কি যথেষ্ট

আল শাহারিয়া
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আগাম সতর্কবার্তাই কি যথেষ্ট

সত্তরের প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন কিংবা ১৯৯১ সালের বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে যেখানে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল, সেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সিডর, আইলা, ফণী, আম্পান বা মোখার মতো প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী ঝড়গুলোতেও আমরা মৃত্যুর সংখ্যাকে বিস্ময়করভাবে কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এই বৈপ্লবিক সাফল্যের পেছনে নিঃসন্দেহে রয়েছে আমাদের আধুনিক ও সময়োপযোগী আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা। পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে আমরা দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি এবং প্রাণহানি দিন দিন কমিয়ে আনছি।

উপগ্রহ থেকে তথ্য সংগ্রহ, উন্নত আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং একটি শক্তিশালী স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক (বিশেষ করে সাইক্লোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম বা সিপিডি) একযোগে কাজ করে। ঝড়ের কয়েকদিন আগে থেকেই বিপদ সংকেত পৌঁছে যায় উপকূলের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মাইকিং, রেডিও, টেলিভিশন এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচারণার ফলে মানুষ দুর্যোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। এই সক্ষমতা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

কিন্তু, এই অসামান্য সাফল্য কি আমাদেরকে এক ধরনের আত্মতুষ্টির বিভ্রান্তিতে ভোগাচ্ছে? আমরা কি ধরে নিচ্ছি যে, মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে আনার বার্তা দিতে পারাই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত সফলতা? সময় এসেছে এই প্রশ্নগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করার। সতর্কবার্তা জীবন বাঁচায়, কিন্তু সেই জীবনকে সচল রাখার জন্য যে জীবিকা প্রয়োজন, তা কি আমরা রক্ষা করতে পারছি?

বাস্তবতা হলো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো সতর্কবার্তা, শেষ ধাপ নয়। যখন একজন উপকূলীয় বাসিন্দাকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কথা জানিয়ে ঘর ছাড়তে বলা হয়, তখন আমরা কি ভেবে দেখেছি তার গন্তব্য কোথায়? সংকেত পাওয়ার পর সেই মানুষটির যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত, মানসম্মত ও নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র কি আমরা আদৌ নিশ্চিত করতে পেরেছি?

কাগজে-কলমে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা হয়তো বেড়েছে, কিন্তু সেগুলোর বাস্তব অবস্থা ভয়াবহ। বেশিরভাগ আশ্রয়কেন্দ্রই সারা বছর অবহেলায় পড়ে থাকে। দুর্যোগের সময় সেগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। ন্যূনতম পরিচ্ছন্নতা, সুপেয় পানি বা পর্যাপ্ত শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকে না। বিশেষ করে নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এই পরিবেশ অত্যন্ত অনিরাপদ ও অবমাননাকর।

এর চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হলো গবাদি পশুর জন্য স্থানের অভাব। উপকূলীয় অঞ্চলের একটি পরিবারের কাছে তার কয়েকটি ছাগল, হাঁস-মুরগি বা একটি গরু কেবল পশু নয়, এটি তার জীবিকার প্রধান অবলম্বন এবং বছরের সঞ্চয়। যখন আশ্রয়কেন্দ্রে এই নিরীহ প্রাণীগুলোর জন্য কোনো ব্যবস্থা থাকে না, তখন অনেক পরিবারই তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝড়ের মধ্যে নিজ বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে, আমাদের সতর্কবার্তা ব্যবস্থা সচল থাকলেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী অবকাঠামোর কারণে পুরোপুরি কার্যকর হতে পারে না। মানুষকে কেবল যাও বলাই যথেষ্ট নয়, তাদের একটি নিরাপদ ও মানবিক আশ্রয় নিশ্চিত করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

সতর্কবার্তা মানুষকে সাময়িকভাবে নিরাপদ স্থানে সরাতে পারে, কিন্তু দুর্যোগের মূল আঘাতটি আসে আমাদের ভঙ্গুর অবকাঠামোর ওপর। আর এই অবকাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উপকূলীয় বেড়িবাঁধ। জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ধাক্কাতেই যখন এই বাঁধগুলো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে, তখনই প্রকৃত বিপর্যয় শুরু হয়। একটি প্রশ্ন বারবার উঠে আসে, কেন প্রতি বছর একই জায়গায় বাঁধ ভাঙে? কেন বর্ষার আগে বা দুর্যোগের ঠিক আগমুহূর্তে জরুরি মেরামত বা আপৎকালীন সংস্কার করতে হয়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণের সংস্কৃতিতে। আমাদের বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে পড়েছে ত্রাণবান্ধব। অর্থাৎ, এমনভাবে দুর্বল করে বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কার করা হয়, যা ভেঙে গেলে নতুন করে ত্রাণ ও মেরামতের সুযোগ তৈরি হয়। টেকসই ও জলবায়ু-সহনশীল বাঁধ নির্মাণে যে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ এবং স্বচ্ছতা প্রয়োজন, সেখানে দুর্নীতি ও অবহেলার অভিযোগ প্রকট।

যখন একটি পাঁচ বা ছয় ফুট জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কাতেও বাঁধ ভেঙে যায়, তখন বুঝতে হবে এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও বেশি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা। এই দুর্বল অবকাঠামোগত ব্যর্থতা দুর্যোগের ক্ষতিকে কেবল বহুগুণ বাড়িয়েই তোলে না, এটি সতর্কবার্তার সাফল্যকেও ম্লান করে দেয়। বাঁধ ভাঙার তাৎক্ষণিক প্রভাব হলো ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়া। কিন্তু, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আরও ভয়াবহ এবং স্থায়ী। বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে যখন সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে, তা এক অপূরণীয় বিপর্যয়ের সূচনা করে। এই লবণাক্ত পানি বছরের পর বছর কৃষি জমিকে অনুর্বর করে রাখে। কৃষকের সোনালি ধানের স্বপ্ন নোনা পানিতে ডুবে যায়। মিঠা পানির মাছের ঘেরগুলো মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। সুপেয় পানির একমাত্র উৎস যে পুকুর, তা লবণাক্ত হয়ে পড়ায় তীব্র পানি সংকট দেখা দেয়। এই দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় থেকে মানুষ সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না।

আমাদের বর্তমান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা একটি অদ্ভুত দ্বৈত সংকট তৈরি করেছে। আমরা আগাম সতর্কবার্তা দিয়ে জীবন বাঁচাতে পারছি, কিন্তু টেকসই অবকাঠামোর অভাবে সেই মানুষগুলোর জীবিকা রক্ষা করতে পারছি না। একজন মানুষ যখন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ঝড়ের পরদিন সকালে বাড়ি ফিরে দেখেন, তার ভিটেমাটি লোনা পানিতে ডুবে আছে, ফসলের জমি নষ্ট হয়ে গেছে, মাছের ঘের ভেসে গেছে, তখন তার বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। দুর্যোগের পর পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও অত্যন্ত ধীরগতির এবং প্রায়শই তা ত্রাণ-নির্ভর। এই ত্রাণ সাময়িক স্বস্তি দিলেও তা টেকসই সমাধান দেয় না। একটি ভাঙা বাঁধ সময়মতো মেরামত না হওয়ায় মানুষ এক ফসলের পর আরেক ফসল হারাতে থাকে। সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। জীবিকা হারিয়ে এই মানুষগুলো ক্রমান্বয়ে স্থায়ী দারিদ্র্যের চক্রে আটকে পড়ে। শেষ পর্যন্ত, তারা সব হারিয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হিসেবে শহরের বস্তিগুলোতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। সুতরাং, আমরা জীবন বাঁচিয়ে হয়তো পরিসংখ্যানের পাতায় সফল হচ্ছি, কিন্তু জীবিকা ধ্বংস করে আমরা একটি নিঃস্ব ও পঙ্গু জনগোষ্ঠী তৈরি করছি। এটি কোনোভাবেই টেকসই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা হতে পারে না। সময় এসেছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর। কেবল দুর্যোগের সময় তৎপর হয়ে ওঠা যথেষ্ট নয়। দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে সারা বছর ধরে। আমাদের সাফল্যকে পরিসংখ্যানের ঘরে আটকে না রেখে, তা মানুষের প্রকৃত জীবনমানে প্রতিফলিত করতে হবে।

আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থার যে আধুনিকায়ন আমরা করেছি, তা অবশ্যই অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের সমস্ত মনোযোগ ও বিনিয়োগ এখন টেকসই অবকাঠামোর দিকে ফেরাতে হবে। বিশেষ করে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলোকে নেদারল্যান্ডসের ডেল্টা প্ল্যানের মতো দীর্ঘমেয়াদি ও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনায় পুনর্নির্মাণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা মাথায় রেখে বাঁধের উচ্চতা ও কাঠামো নতুন করে ডিজাইন করতে হবে। বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। জরুরি মেরামতের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে কেবল দুর্যোগের সময় নয়, সারা বছর ব্যবহারোপযোগী এবং মানবিক সুবিধাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত জলবায়ু সহনশীলতা অর্জনের পথ একটাই। তা হলো, আগাম সতর্কবার্তার সঙ্গে টেকসই অবকাঠামোর সমন্বয় ঘটানো। জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি মানুষের জীবিকা, সম্পদ এবং স্বপ্নকে রক্ষা করতে পারলেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সাফল্য প্রকৃত অর্থে সার্থক হবে।

আল শাহারিয়া

শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত