প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫
সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। লক্ষ্মী দেবী ছোট ঘরে সন্ধ্যা নামছে। ডায়াবেটিসের কারণে তার শরীরটা বেশ কাহিল। প্রতি সন্ধ্যায় এই সময়টায় তার মনটা কেমন যেন হু হু করে ওঠে। বুকের ভেতর এক অব্যক্ত যন্ত্রণা, এক গভীর আর্তনাদ জমে আছে।
লক্ষ্মী দেবী তারুণ্যে ছিলেন এক প্রাণবন্ত নারী। মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসতেন। যখন ডায়াবেটিস ধরা পড়ল, তখন মনে হয়েছিল জীবনটা থমকে গেছে। ডাক্তার মিষ্টি, ভাত আর আরও কত কী বারণ করে দিলেন। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। লুচি-পায়েস খাওয়া বারণ, জামাইষষ্ঠীতে শাশুড়ির হাতের বিশেষ মিষ্টিগুলোও মুখে তোলা নিষেধ।
লক্ষ্মী দেবীর আর্তনাদ শুধু মিষ্টি না খাওয়ার জন্য নয়। এই রোগ তাকে সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। কেউ আর তাকে নিমন্ত্রণ করতে চায় না, পাছে তার খাওয়া-দাওয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হয়। বাড়ির অনুষ্ঠানেও যেন তিনি অবাঞ্ছিত। সবার হাসি-ঠাট্টার মাঝে তিনি যেন এক কোণায় চুপচাপ বসে থাকা এক বিষণ্ণ মানুষ।
তার এই আর্তনাদ এক অবহেলিত জীবনের, একাকীত্বের, আর প্রিয়জনের স্পর্শ না পাওয়ার। ডায়াবেটিস শুধু রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায় না, মানুষের মনকেও ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। লক্ষ্মী দেবীর মতো হাজারো ডায়াবেটিস রোগীর আর্তনাদ হয়তো সমাজের কোণে কোণে এভাবেই মিশে আছে, যা কেউ শুনতে পায় না।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস দিবস প্রতি বছর ১৪ নভেম্বর পালিত হয়। ২০২৫ সালেও দিবসটি ১৪ নভেম্বর, শুক্রবার পালিত হবে। দিবসটির মূল লক্ষ্য হলো ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সবার কাছে সহজলভ্য করা করা। বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন’ (Build diabetes awareness in the workplace) এই দিবসে কর্মক্ষেত্রে ডায়াবেটিস রোগীদের সহায়ক পরিবেশ তৈরির উপর জোর দেওয়া হবে। অর্থাৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কর্মীদের জন্য একটি সহায়ক কর্মপরিবেশ তৈরি করা এবং তাদের সুস্থভাবে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হবে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বারডেম হাসপাতাল এবং এর শাখাগুলো ১৪ এবং ১৫ নভেম্বর নিম্নলিখিত কর্মসূচি আয়োজন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ১. বর্ণাঢ্য রেলিসহ শোভাযাত্রা। ২. ঘোড়ার গাড়িসহ ব্যান্ড পার্টি। ৩. হাসপাতালে সেবা সম্বলিত লিফলেট বিতরণ এবং ৪. বিনামূল্যে ডায়াবেটিস পরীক্ষা, রোগ নির্ণয়, পরামর্শ এবং চিকিৎসাসেবা প্রদান। বিষয়টি বারডেম হাসপাতালের ওয়ারী শাখা (শহীদ খালেক-ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতাল) হতে ০৫-১১-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দে ইসুকৃত এক স্মারকের মাধ্যমে হাসপাতালটির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার আনিস বিন সাঈদ (লিমন) আমাকে অবহিত করেন।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসার পথিকৃৎ হলেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম। তিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (BADAS) এবং এর অধীনে থাকা বারডেম হাসপাতাল-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে বারডেম হাসপাতাল নামে পরিচিত। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বর্তমানে বারডেম হাসপাতাল ও আরও অনেক ডায়াবেটিস সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশে ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে চলেছে।
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা যেখানে শরীর রক্তে শর্করার (গ্লুকোজ) মাত্রা স্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটি মূলত ইনসুলিন নামক হরমোনের অপর্যাপ্ত উৎপাদন বা শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি সঠিকভাবে সাড়া না দেওয়ার কারণে ঘটে।
সাধারণত, আমরা যখন শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার খাই, তখন শরীর তা ভেঙে গ্লুকোজে (শর্করা) পরিণত করে। ইনসুলিন এই গ্লুকোজকে শরীরের কোষে পৌঁছাতে সাহায্য করে, যা পরে শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হয়, ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়।
ডায়াবেটিস মূলত তিন ধরনের হয়ে থাকে : টাইপ ১ ডায়াবেটিস- এই ক্ষেত্রে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে দেয়, ফলে শরীর প্রায় কোনো ইনসুলিনই তৈরি করতে পারে না। টাইপ ২ ডায়াবেটিস- এটি সবচেয়ে সাধারণ প্রকার। এতে শরীরের কোষগুলো ইনসুলিনের প্রতি যথাযথভাবে সাড়া দেয় না (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স), অথবা অগ্ন্যাশয় প্রয়োজনের তুলনায় কম ইনসুলিন তৈরি করে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস- এটি গর্ভাবস্থায় কিছু মহিলার মধ্যে দেখা যায় এবং সাধারণত শিশুর জন্মের পর ঠিক হয়ে যায়।
ডায়াবেটিসের সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া (বিশেষ করে রাতে)। অতিরিক্ত তৃষ্ণা বা গলা শুকিয়ে যাওয়া। প্রচণ্ড ক্ষুধা লাগা। অব্যক্ত ওজন হ্রাস। চোখে ঝাপসা দেখা। শরীরের কোনো ক্ষত ধীরে ধীরে নিরাময় হওয়া।
ইনফেকশন থেকে বাঁচতে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা হলো : রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন এবং তা নির্দিষ্টসীমার মধ্যে রাখুন। অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত শর্করা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। ফল, শাকসবজি এবং ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি খান। চিনি, সাদা চাল ও ময়দার মতো পরিশোধিত শর্করা গ্রহণ সীমিত করুন। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা হাঁটা বা অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপের অভ্যাস গড়ে তুলুন। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ত্বক সবসময় পরিষ্কার ও শুকনো রাখুন। প্রতিটি কর্ম সতর্কতার সঙ্গে সম্পন্ন করা, যাতে ক্ষত হওয়ার মত কোন দুর্ঘটনা না ঘটে ছোটখাটো ক্ষত বা আঘাতকেও অবহেলা করবেন না। দ্রুত ক্ষত নিরাময়ের জন্য রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা অপরিহার্য, কারণ উচ্চ শর্করা ক্ষতের নিরাময় প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়।
নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করুন এবং মুখ পরিষ্কার রাখুন। দাঁতের সংক্রমণের ঝুঁকি ডায়াবেটিস রোগীদের বেশি থাকে। বিশেষ করে পায়ের যত্নে নজর দিন। সঠিক মাপের, আরামদায়ক জুতো ও মোজা ব্যবহার করুন। কোনো সংক্রমণ বা অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আপনার ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করুন ইনফেকশন প্রতিরোধে কোনো টিকা নেওয়া উচিত কি না।
ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা নিম্নে উল্লেখ করা হলো : পজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (NCD) কর্নার স্থাপন করে ডায়াবেটিস নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র এবং অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী সহজলভ্য করা হয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বাংলাদেশ সরকার বিভিন্নভাবে কাজ করে থাকে, যেমন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এবং কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন উপজেলায় নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (NCD) কর্নার স্থাপন করেছে, যেখানে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী রোগের নির্ণয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়াও, সরকার ডায়াবেটিস রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কাজ করে এবং তাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতীব জরুরি : ডায়াবেটিস প্রতিরোধের উপায়, যেমন সুষম খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং ধূমপান ত্যাগের উপর জোর দিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারণা চালানো। স্কুল, কলেজ এবং কর্মক্ষেত্রে ডায়াবেটিস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন সম্পর্কে শিক্ষামূলক কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা। সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সুলভ মূল্যে এবং সহজলভ্য চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা করা।
যারা ইনসুলিন ব্যবহার করেন, তাদের জন্য নিয়মিত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডোজ নির্ধারণের উপর জোর দেওয়া। নিয়মিত ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং গ্লুকোজ, লিপিড, রক্তচাপ ও ওজন নিরীক্ষণের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা। ডায়াবেটিসের ফলে সৃষ্ট জটিলতা, যেমন কিডনি, চোখ, স্নায়ু ও হৃদরোগের প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করার জন্য নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা। ডায়াবেটিক ফুট, ডায়াবেটিক নিউরোপ্যাথি) নিরাময়ের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন ও সহজলভ্য করা। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বিশেষায়িত কেন্দ্র স্থাপন করা, যেখানে তারা একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যসেবা (যেমন পুষ্টি, ব্যায়াম ও মানসিক স্বাস্থ্য) পেতে পারে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য বাস্তব জীবনের কিছু অনুপ্রেরণামূলক অভিজ্ঞতার কথা লিখে এ নিবন্ধের সমাপ্তি টানছি : আমার দেখা মতে অনেক ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী আছেন যারা কঠোর পরিশ্রম, সঠিক ডায়েট ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় প্রতিনিয়ত উন্নতি হচ্ছে। নতুন ওষুধ এবং প্রযুক্তির সাহায্যে ডায়াবেটিস ব্যবস্হাপনা অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে অবশ্যই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসবে। ডায়াবেটিস মোকাবিলায় মানসিক শক্তি এবং ইতিবাচক মনোভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনার মতো আরও অনেকেই এই পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করছেন, তাই নিজেকে একা ভাববেন না।
নিবন্ধের অবতারণার লক্ষ্মী দেবিরা অবহেলার পাত্র নয়, তাদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই, বরং সঠিক চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা মেনে চলার মাধ্যমে তাদের উৎসাহ প্রদান করা হলে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকা মানেই, তারা অন্যজনের মতোই সুস্বাস্থ্যবান মানুষ।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক