প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫
চারপাশে এখন কেবলই আধুনিকতার ঢেউ। সকালের ঘুম ভাঙা থেকে শুরু করে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত আমরা নানাভাবে ব্যবহার করছি নানা প্রযুক্তিকে। যোগাযোগ এখন হয়েছে আরও সহজ। চাইলেই পুরো পৃথিবীকে নিয়ে ফেলছি হাতের মুঠোয়। সহজ থেকে সহজতর হচ্ছে আমাদের দৈনন্দিন জীবন। পরিবর্তন এসেছে আমাদের প্রায় প্রতিটি কাজ কর্মেই। ধনী থেকে দরিদ্র সমাজের সবার জীবনেই কোনো না কোনো ভাবে আধুনিকতার প্রভাব লক্ষ করা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোয়ায় বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবন তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি এটাই যে সেই সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধনগুলো, হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক সম্প্রীতিগুলো। সমাজ বিজ্ঞানীরা সব সময়ই বলেন একটা দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিবার। তবে সেই প্রতিষ্ঠান এ ভাঙন ধরছে দ্রুতই। বেড়েই চলছে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো সামজিক ব্যধি। বিবাহ বিচ্ছেদ আসলে কি? একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে পরিবার গঠনের লক্ষে সামজিক ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে যে নির্মল বন্ধন এ আবদ্ধ হয় তখন আমরা সেই পারিবারিক আচার কে বিয়ে বলে থাকি। তবে নানা কারনে সেই বন্ধন যখন আর টিকিয়ে রাখতে সম্ভব হয় না তখনই তাকে আমরা বিবাহ বিচ্ছেদ বলে থাকি। বিয়ে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির খুবই সুন্দর একটি সুন্দর আচার তবে বর্তমান এ আমাদের দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্য মতে ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিচ্ছেদের হার ছিল ০.৬ থেকে ১.১ শতাংশের মধ্যে। ২০২২ সালে এটি বেড়েছে প্রায়ই ১.৪ শতাংশ। এই হার ঢাকার শহরে আরও বেশি। পরিসংখ্যান এ আরও বলা হয়েছে পুরুষের চেয়ে নারীরা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য বেশি আবেদন করছেন। ঢাকার শহরে প্রতি ৪০ মিনিট এ অন্তত একটি বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন দাখিল হয়েছে।
বিবাহ একটি সামজিক আচার যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে নতুন একটি পরিবার। তবে সেই সামজিক আচারই যেন রীতিমতো সামজিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদের সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে সমাজে। ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ খুঁজতে গেলে এর পেছনে বেশ কিছু কারণ খুজে পাওয়া যায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে মানুষের মানসিকতা। ইন্টারনেট এর ছোঁয়ায় আজ তথ্যের অবাধ প্রচলন ঘটছে ফলে ভিন দেশি সংস্কৃতি অতি সহজেই প্রবেশ করছে আমাদের সংস্কৃতিতে। যার সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে আমাদের মানসিকতা।
সেই পাশাপাশি আরও বেশ কিছু কারণ উল্লেখ করা যায়। এই যেমন আধুনিকতার এই যুগে আমাদের জীবন হয়ে পড়ছে আরও ব্যস্ত কিন্তুু বদ্ধ বিশেষ করে শহর অঞ্চচল এ তো এই অবস্থা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েই চলছে। আমাদের দেশের শহরগুলোতে বাসার বাইরে বিনোদন এর একমাত্র স্থান হয়ে পড়ছে খাবারের স্টল। ফলে সুষ্ঠ বিনোদন এর অভাবে আমাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ব্যপকভাবে। যার ফলে মেজাজ হচ্ছে খিটখিটে। কমে যাচ্ছে মানিয়ে নেওয়া ও মেনে নেওয়ার ক্ষমতা যার সরাসরি প্রভাব গিয়ে পড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো সামজিক ব্যাধির পরিসংখ্যান এ। মানসিকভাবে কোন সমস্যা দেখা দিলে যে তার চিকিৎসা প্রয়োজন এমন সংস্কৃতি আমাদের এখানে এখনও সেভাবে গড়ে উঠে নি। ফলে মানসিক নানা সমস্যা নিয়েই আমারা দিনের পর দিন পার করে যাচ্ছি।
যার ফলে সেই সমস্যারও প্রভাব গিয়ে পড়ছে সম্পর্কগুলোতে। বর্তমান সময়ে কোনো রকম বাদ বিচার ছাড়াই আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবাদে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে থাকি, যার কারণে আমাদের মস্তিষ্কও হয়ে পড়ছে ভারী। মেজাজ খিটখিটে হওয়ার এটাও একটা বড় কারণ। যানযটের কারণে আমাদের দিনের বড় একটা সময় ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। সারাদিন নানা ব্যস্ততা পার করে তারপর আবার যানযট নামক ভয়ঙ্কর ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিয়ে যখন বাড়ি ফেরা তখন মেজাজের অবস্থা যে কি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান সময়ে জীবন যাত্রার খরচ যেমন বাড়ছে পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দ্রব্যমূল্যের দামও ফলে সংসার টিকিয়ে রাখতে অনেকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবার বাড়তি সেই খরচ মেটাতে অনেকেই ঝুকছে বাড়তি আয়ের দিকে সেই আয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেকেই পরিবারে সময় দিতে পারছেন না। যার ফলে পারিবারিক বন্ধনগুলোও দুর্বল হয়ে পড়ছে। কমে যাচ্ছে মায়া। এছাড়াও অনেক সময় সন্তান না হওয়া ও অনেকেই বিবাহ বিচ্ছেদের মতো সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছে। আমাদের দেশের গ্রাম অঞ্চলেও বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েছে এক্ষেত্রে নানা সামজিক কুসংস্কার ও কাজ করে থাকে। পারিবারিক পবিত্র যে বন্ধন তার গুরুত্ব সামজিক বাস্তবতায় অপরসীম। যে সব দেশে এই পারবারিক বন্ধন দূর্বল সেই সমস্ত দেশের অবস্থার ভয়াবহ অবস্থা তাকালেই বোঝা যায়। এই যেমন জাপানের মতো সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক দেশেও মারা গিয়ে লাশ পড়ে থাকলেও কেউ খবর রাখে না বলে গণমাধ্যম এ শিরোনাম হতে দেখেছি। আর তাই এখনই আমাদের এই সামজিক অভিশাপ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত হবে। শুরুতেই এই বিষয়ে ব্যপক প্রচারণা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ এক্ষেত্রে ব্যপক ভূমিকা পালন করতে পারে। পাশাপাশি আমাদের মানসিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
আরাফাত নাফিজ
শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন