প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫
বর্তমান সময়ে দেশের সাধারণ মানুষ এক অভূতপূর্ব আর্থিক চাপে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া, অথচ আয়ের সুযোগ সীমিত। চাকরি, কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় স্থিতিশীলতার অভাব মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরাসরি প্রতিফলিত হচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের জীবনমান রক্ষার জন্য দিনরাত সংগ্রাম করছেন, আর নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য পরিস্থিতি অনেক কঠিন। জীবনযাত্রার মান কমছে, শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ সীমিত হচ্ছে- এই সংকটের প্রভাব প্রতিটি পরিবারে স্পষ্ট।
মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রার অস্থিরতা মানুষকে মানসিকভাবে চাপে ফেলেছে। অনেকেই দৈনন্দিন খরচ মেটাতে ঋণের আশ্রয় নিচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান বাজারদাম সামাজিক বৈষম্যকে আরও গভীর করছে। ধনী ও মধ্যবিত্ত কিছুটা হলেও নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারলেও নিম্ন আয়ের মানুষ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছেন। এর ফলে মানসিক চাপ, হতাশা এবং নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তীব্র হচ্ছে। চাকরি ও আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি আশাপ্রদ নয়। বেসরকারি খাতের স্থিতিশীলতা নেই, ক্ষুদ্র ব্যবসা বা কৃষিক্ষেত্রও আগের মতো লাভজনক নয়। দৈনন্দিন ব্যয়, ঋণের বোঝা ও অনিয়মিত আয়ের কারণে মানুষ প্রায়ই সংকটে পড়ছেন। বিশেষ করে মহিলারা, শিশু ও বৃদ্ধরা এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার। পরিবারগুলো বেঁচে থাকার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করছেন- অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো, ক্ষুদ্র ব্যবসা চালানো বা অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া। সরকার নানা সময়ে ভর্তুকি, ঋণ সুবিধা এবং খাদ্যদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ নীতির সীমাবদ্ধতা এবং সরবরাহের বৈষম্য এই উদ্যোগগুলোর কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়েছে। মানুষের আয় ও বাজারের দাম কখনও সমান নয়; ফলে জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্যের মতো মৌলিক প্রয়োজনও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিঘ্নিত হচ্ছে, শিক্ষার সুযোগ সীমিত হচ্ছে- যা দীর্ঘমেয়াদে সমাজের জন্য বিপজ্জনক। এই সংকট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়; সামাজিক ও মানসিক ক্ষেত্রেও এর প্রভাব স্পষ্ট। পরিবারগুলো জীবিকা রক্ষায় সংগ্রাম করছেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক বৈষম্য ও মানসিক চাপ আরও বাড়ছে। অপরাধ, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক অনিশ্চয়তার ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রা সাধারণ ও স্বাভাবিক থেকে কঠিন ও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। তবে উত্তরণ সম্ভব। প্রয়োজন সমাজের সব স্তরের সমন্বিত পদক্ষেপ। শুধু সরকারের নীতি যথেষ্ট নয়, স্থানীয় উদ্যোগ, ব্যবসায়িক সম্প্রদায় ও সচেতন নাগরিক অংশগ্রহণ অপরিহার্য। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে, দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, এবং স্থানীয় ব্যবসা ও কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সাধারণ মানুষের জীবনমান রক্ষার জন্য এসব পদক্ষেপ অপরিহার্য।
মানুষের সংগ্রাম, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার প্রতি আমাদের মনোযোগ দেওয়া জরুরি। সরকার ও সমাজকে একসাথে কাজ করতে হবে। মানবিক সহায়তা, কার্যকর নীতি এবং বাস্তব সমাধান ছাড়া সাধারণ মানুষের জীবনে স্থিতিশীলতা আনা সম্ভব নয়। এই সংকট কেবল সংখ্যা বা পরিসংখ্যান নয়; এটি প্রত্যেক পরিবারের জীবন, প্রতিটি শিশুর ভবিষ্যত এবং দেশের সামগ্রিক উন্নতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
সংক্ষেপে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য এক কঠিন বাস্তবতা। জীবনযাত্রা রক্ষা, শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা, এবং প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ- এসবই আজ সমাজ ও সরকারের সমন্বিত দায়িত্ব। অর্থনৈতিক সংকটের ছায়া থেকে মুক্তি পেতে হলে মানবিক সহায়তা, কার্যকর নীতি এবং স্থিতিশীল সমাধানের দিকে সকলে একসাথে মনোযোগ দিতে হবে। এই সংকট কেবল আর্থিক নয়; এটি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জীবনযাত্রা, মানসিক স্বাস্থ্য এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। সাধারণ মানুষ ধৈর্য, শক্তি ও সংগ্রামের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল সমাধান ছাড়া নিরাপদ ও মানসম্মত জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সরকারী উদ্যোগ এবং নীতি নির্ধারণের কার্যকর বাস্তবায়ন ছাড়া এই সংকট কাটানো অসম্ভব।
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও প্রবন্ধকার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি