ঢাকা শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মাটির ঘরের গল্প এখন স্মৃতি

আরশী আক্তার সানী
মাটির ঘরের গল্প এখন স্মৃতি

ভোরের আলো ছুঁয়ে যেত উঠোনে ছিটানো জলের উপর। মাটির ঘরের দেয়ালগুলো তখনো ভেজা, আর সেই ভেজা মাটির গন্ধে যেন প্রাণ জেগে উঠত। দূরে বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আসত, মুরগি ডাকত, মা হাঁড়িতে জল তুলতেন। চারপাশে নরম একটা শান্তি, কোনো হট্টগোল নেই, কোনো যন্ত্রের শব্দ নেই- শুধু প্রকৃতির মৃদু ছন্দ।

সেই সময়গুলো এখন যেন কেবল গল্পে পাওয়া যায়। মাটির ঘর এখন শুধু স্মৃতি- কিন্তু সেই স্মৃতির ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক দেশ, এক সময়, এক জীবনের গল্প। আমাদের গ্রামের ঘরগুলো ছিল সাদামাটা, কিন্তু তাতেই ছিল একরাশ ভালোবাসা। দেয়াল ছিল মাটির, ছাদ খড়ের, জানালায় বাঁশের কাঠামো। বৃষ্টির সময় ছাউনির নিচে বসে গল্প হতো, বাতাসে ভেসে আসত কাদা-মাটির গন্ধ। শীতের দিনে ঘর উষ্ণ, গ্রীষ্মে ঠান্ডা। এখনকার ঘরগুলো মজবুত, সুরক্ষিত, আরামদায়ক- কিন্তু কোথাও যেন কিছু নেই। নেই সেই আত্মার উষ্ণতা, নেই সেই মাটির স্পর্শ।

ঘরের ভেতরের মানুষ : মাটির ঘর মানে ছিল সম্পর্কের জায়গা। সকালে মা উঠোনে জল ছিটিয়ে মাটি ঠান্ডা করতেন, ছোট ভাই ঘর ঝাড়ত, বাবা চুলার ধোঁয়ার পাশে বসে বিড়ি ধরাতেন। দুপুরে পাখির ডাক, সন্ধ্যায় মোমবাতির আলো, রাতে মাটির বিছানায় বসে গল্প।

এখনকার বাড়িতে সবার আলাদা ঘর, আলাদা মোবাইল, আলাদা জীবন। এক ছাদের নিচে থেকেও মানুষ দূরে। আগে ঘর ছোট ছিল, কিন্তু মন বড় ছিল; এখন ঘর বড়, মন ছোট।

আমার দাদু বলতেন, ‘ঘর শুধু দেয়াল নয়, ঘর মানে মানুষে মানুষে বন্ধন।’ সেই কথার মানে এখন বুঝি। মাটির ঘর আমাদের একত্র করত- কেউ অসুস্থ হলে পুরো পাড়া পাশে দাঁড়াত। এখন পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকে, অনেকে জানেই না।

প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক : মাটির ঘর প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম ছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে বাতাস আসত, পিঁপড়া হেঁটে যেত দেয়ালে, বৃষ্টির জল পড়ে টপটপ শব্দ করত। কেউ বিরক্ত হতো না, বরং মনে হতো প্রকৃতি আমাদেরই অংশ। এখন আমরা এমন ঘরে থাকি, যেখানে সূর্যের আলো ঢোকে না, জানালায় কাচ, বাতাস আসে যন্ত্রের মাধ্যমে। আমরা প্রকৃতি থেকে দূরে গিয়ে বদ্ধ হয়ে গেছি নিজেদের তৈরি দালানে। আগে বৃষ্টির দিনে উঠোনে কাদা জমত, তবু সেই কাদা নিয়েই আনন্দ ছিল। শিশুরা কাদা মেখে খেলত, মা হাসতেন। এখনকার শিশুরা মাটিতে বসতে ভয় পায়। তাদের খেলা স্ক্রিনে, প্রকৃতি তাদের কাছে শুধু ছবির বইয়ে।

এক জীবনের গন্ধ : মাটির ঘরের গন্ধটা একরকম ছিল- ভিজে মাটি, ধান, ধোঁয়া, আর রান্না করা ভাতের গন্ধ। সেই গন্ধে ছিল বাড়ির উষ্ণতা। আজকের ঘরে হয়তো সুগন্ধি আছে, কিন্তু সেই মাটির গন্ধ নেই। মাটি ছিল আমাদের পরিচয়, আমাদের শিকড়। এখন আমরা সেই মাটিকে তুচ্ছ করে ফেলেছি- ভাবি, উন্নতি মানে সিমেন্টের দেয়াল। কিন্তু ভুলে যাই, এই মাটিই আমাদের ইতিহাস।

উৎসবের দিনগুলো : একসময় গ্রামের উৎসব মানেই মাটির ঘরে প্রাণ। পহেলা বৈশাখে উঠোনে আলপনা আঁকা হতো, ধানের খড় দিয়ে ঘর সাজানো হতো। মেয়েরা গলায় ফুল পরত, পুরুষেরা বাজাত ঢোল। শীতের সকালে পিঠা বানানোর সময় মা চুলার পাশে বসে থাকতেন, আমরা পাশে বসে ধোঁয়ার ভেতর মিষ্টি গন্ধে মুগ্ধ হতাম। বৃষ্টির দিনে সবাই মিলে ঘরের মধ্যে গান গাইত, গল্প করত। এখন উৎসব মানে মোবাইলে ছবি তোলা, ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া। হাসি আছে, কিন্তু সেই হাসিতে প্রাণ নেই।

ঘর হারানোর কষ্ট : কয়েক বছর আগে গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখি, আমাদের পুরোনো মাটির ঘরটা নেই। সেখানে তৈরি হয়েছে পাকা দালান, চকচকে রঙ করা দেয়াল, লোহার দরজা। উঠোনের জায়গায় এখন টাইলস। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছি। মা বললেন, ‘সময় বদলেছে, এখন মাটির ঘর টেকে না।’ কিন্তু আমার মনে হলো- ঘর টিকেছিল, টিকিনি আমরা। আমরা আমাদের শিকড় থেকে সরে গেছি। সেই ঘরের প্রতিটি কোণে একেকটা স্মৃতি ছিল। দেওয়ালের ফাটলে এখনও যেন দাদুর কণ্ঠ ভেসে আসে, উঠোনে যেন ছোটবেলার হাসি। সবকিছু হারিয়ে গেল ইট আর রডের নিচে।

মানুষ বদলে গেছে : আগে মানুষ গরিব ছিল, কিন্তু সুখী ছিল। তারা একে অপরকে জানত, খোঁজ নিত, সময় দিত। এখন মানুষ ব্যস্ত, একা, অচেনা। আগে সন্ধ্যায় ঘরে আলো জ্বেলে সবাই একসঙ্গে বসত, এখন প্রত্যেকে নিজের স্ক্রিনে হারিয়ে যায়। আমরা ভেবেছিলাম উন্নত ঘর মানেই উন্নত জীবন। কিন্তু জীবনের মান মাপা যায় না সিমেন্ট দিয়ে। আগে ঘরে ছিল গল্প, এখন আছে নিরবতা।

আধুনিকতার দম্ভ : আমরা আধুনিক হয়েছি, কিন্তু মানবিক নই। আগে মাটির ঘর বানাতে সময় লাগত, পরিশ্রম লাগত, ভালোবাসা লাগত। এখন কন্ট্রাক্টর আর টাকা থাকলেই ঘর হয়। কিন্তু সেই ঘরে স্মৃতি থাকে না। আগে ঘর বানানো ছিল উৎসব, এখন ব্যবসা। আগে ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মাটির গন্ধে মন ভরে যেত, এখন শুধু ঠান্ডা বাতাস। আমাদের সমাজে এখন এমন ধারণা তৈরি হয়েছে, মাটির ঘর মানেই গরিবি, পেছিয়ে পড়া। অথচ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোই এখন আবার ফিরছে সেই মাটির ঘরের ধারণায় পরিবেশবান্ধব ‘ইকো-হোম’ নামে। তারা বুঝেছে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেই স্থায়ী জীবন সম্ভব। অথচ আমরা, যারা সেই সংস্কৃতি বহন করতাম, তারাই তা ভুলে গেছি।

স্থাপত্যের ভেতর এক ইতিহাস : বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সাহিত্য, আর কবিতার ভেতরে মাটির ঘর এক প্রতীক। রবীন্দ্রনাথের ‘পল্লী জীবন’-এর কবিতায়, জসীমউদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’-এ, কিংবা বিভূতিভূষণের উপন্যাসে- মাটির ঘরই ছিল জীবনের কেন্দ্র।

আরশী আক্তার সানী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত