প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫
হজরত জাফর তাইয়ার (রা.) একটি কিল্লা বিজয়ের অভিযান চালান। দুর্গের কাছে গিয়ে মনে হলো, পুরো কিল্লা গোগ্রাসে তিনি গিলে ফেলতে পারবেন। অর্থাৎ দুর্গ বিজয়ের বিষয়টি তার কাছে একেবারেই সহজ মনে হলো। জাফর তাইয়ার (রা) ছিলেন নিঃসঙ্গ; অথচ তাকে দেখে দুর্গের ভেতরে শত্রুদের পিলে কাঁপছিল। কারও সাহস হলো না তার সঙ্গে লড়তে আসবে। ধরুন, জাহাজে লোকেরা সমুদ্রভ্রমণ করছে। বিশাল তিমি এসে যদি জাহাজের গতিরোধ করে জাহাজের যাত্রীরা কি লড়তে সাহস করবে? দুর্গের রাজা তার মন্ত্রীকে ডেকে পরামর্শ করলেন, এখন কী করা? মন্ত্রী বলল, একটিই উপায়। সবাই কাফন তরবারি হাতে নিয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করি। রাজা বলল, তিনি তো একা। তারপরও তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে কেন? মন্ত্রী বলল, এ কথা চিন্তা করবেন না যে, তিনি একা। দেখুন, তার আতঙ্কে কীভাবে কাঁপছে পুরো কিল্লা। অশ্বের জিনের ওপর এমন অবিচলভাবে তিনি বসে আছেন। মনে হচ্ছে পূর্ব ও প্রাচ্যের লোকলষ্কর তার পেছনে সারীবদ্ধ। এর মধ্যে কয়েক যুবক সাহস করে এগিয়ে গেল জাফরের সঙ্গে মল্ল যুদ্ধে। কিন্তু তিনি একেক আঘাতে তাদের ধরাশায়ী করলেন অশ্বের ক্ষুরের নিচে। এই বীরত্বের রহস্য কী?
দাদে বুদেশ সুনএ হক জামইয়াতি
কে হামি জদ য়্যক তানে বর উম্মতি
আল্লাহর সৃষ্টিনৈপুণ্য দিয়েছিল তাকে এমন ব্যক্তিত্ব
বিশাল বাহিনীর সম্মুখে তিনি অবিচল একা একশ’।
হজরত জাফর (রা.) বলেন, আমার চক্ষু যখন থেকে মহান মালিকের মহিমা ও শক্তির রহস্য দেখল তখন থেকে দুশমনের বিপুলতা আমার চোখে গুরুত্ব হারাল। ব্যাপারটি এমন, রাতের আকাশে অগণিত তারকার মেলা, কিন্তু ভোরে সূর্যের উদয়ে কোথায় মুখ লুকায় তারারা। মহামহিমের শক্তির ঐশ্বর্যে আমার অন্তর বলীয়ান। তাই আমার চোখে অতিশয় তুচ্ছ শত্রুরা। মনে কর, অগণিত ইঁদুর কিলবিল করে। তারপরও বিড়াল ইঁদুরের ঝাঁকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে কি দ্বিধা সংকোচ করে? অগণিত ইঁদুর; অথচ একটি বিড়ালের সামনে আসতে পারে না আত্মবিশ্বাস, মনোবলের অভাবে।
হাস্ত জমইয়্যত বে সুরাতহা ফুশার
জমএ মানা খাহ হীন আজ কেরদেগার
জানো, মূল্যহীন বাহ্যিক সংখ্যাধিক্য একতা অযথা
তুমি চাও আল্লাহর কাছে আত্মবিশ্বাস একাত্মতা।
সংখ্যা বেশি হলেই আত্মবিশ্বাস অটল হবে, এমন কথা সঠিক নয়। সংখ্যার বিপুলতায় যদি মনের মিল না থাকে, পরস্পরে একাত্মতার অভাব হয়, কোনো কাজে আসবে না তা। ইঁদুরদের মনে যদি আত্মবিশ্বাস একাত্মতা থাকত তাহলে অল্প ইঁদুর হলেও আক্রমণ চালাতে পারত বিড়ালের উপর। এক ইঁদুর খুলে নিত বিড়ালের চোখ। আরেকটি ধারালো দাঁত দিয়ে কেটে ফেলত বিড়ালের কান। অন্যটি এসে কামড় বসাত বিড়ালের গায়ে। বিড়াল যেতে পারত না এত এত ইঁদুরের ভিড় ঠেলে। কিন্তু আফসোস যে, ইঁদুরদের মাঝে মনের ঐক্য নেই। আত্মবিশ্বাসের চরম অভাব। ফলে প্রাণ নিয়ে পালায় বিড়ালের মিও শব্দ শুনে। বিড়াল দেখামাত্র হাজারো ইঁদুর এলোপাতাড়ি লুকিয়ে যায়। ছাগল ভেড়ার বিরাট পাল, কিন্তু কসাই কী ভয় পায় এদের সংখ্যা দেখে। বুঝা গেল, ব্যক্তির মনোবলের কাছে হার মানে জাগতিক সংখ্যাধিক্য। প্রশ্ন হলো, এই আত্মবিশ্বাস মনোবলের উৎস কোথায়?
মালিকুল মুলক আস্ত জমইয়্যত দাহাদ
শির রা তা বর গেল্লেয়ে গুরান জাহাদ
মহামহিম আল্লাহই করেন আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার
তাতে বাঘ একা প্রাণ কাড়ে শত শত জেব্রার।
বাঘের এই যে দুঃসাহস, শত সহস্র জেব্রা একটি বাঘের হুংকারে প্রাণ হাতে পালায় তার পেছনে কারণ, আল্লাহর পক্ষ থেকে বাঘকে দেয়া অসীম সাহস। তিনিই মহান মালিক, তার হাতেই সমস্ত ক্ষমতা। তিনি যখন কাউকে সৌন্দর্য ঢেলে দেন তখন তিনি ইউসুফে পরিণত হন। কারও চেহারায় যদি তিনি সৌন্দর্যের প্রলেপ মেখে দেন, রাজা-বাদশাহরাও তার সৌন্দর্যের কাঙালে পরিণত হয়। কারও মাঝে যখন তিনি নুরের ঝলক বিকিরণ করেন, তখন রাতের আঁধারেও সে লোক বলতে পারেন, কে ভালো বা মন্দ কেমন।
ইউসুফ (আ.) ও মুসা (আ.)-এর চেহারায় ব্যক্তিত্বে যে সৌন্দর্যের আভা নিশ্চয়ই আল্লাহ দিয়েছেন। কুহে তুর থেকে এসে মুসা (আ.)-এর চেহারার সৌন্দর্য ত্যেজের এমন অবস্থা হয়েছিল, অসতর্কভাবে তার দিকে কেউ তাকালে তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে তিনি আল্লাহর কাছে দরখাস্ত করেন, আমার চেহারায় একটি রুমাল দাও, যাতে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমার চেহারা ঢেকে রাখতে পারি। আল্লাহ বলেন, মুসা! চেহারায় রুমাল ঝুলানোর জন্য আলাদা কাপড়ের প্রয়োজন নেই। তোমার যে গায়ের চাদর আছে তা দিয়ে তোমার চেহারার ঝুলটুপি বানাও। কারণ, তোমার ওপর পতিত নুরের ঝলক ধৈর্র্য ও সহনশীলতা হয়ে তোমার কাপড়ে মাখা আছে। জামার চাদরের সুতায় টানায় বানায় মারেফতের ঐশ্বর্য লুকিয়ে আছে। এই পশমী আলখেল্লা ছাড়া তোমার চেহারার নুরের হেফাজত আর কিছু দিয়ে হবে না।
আজ কামালে কুদরত আব্দানে রেজাল
য়াফত আন্দর নুরে বে চোন এহতেমাল
আল্লাহওয়ালারা যে লাভ করেন নুরের ঝলক দেহে
বিচ্ছুরিত হয় তা আল্লাহর অপার নুরের ঝলক হতে।
তুর পর্বত যে নুর ধারণ করতে পারে না, কী আশ্চর্য দেহের চিমনি সইতে পারে তার ত্যেজের দহন। আল্লাহওয়ালার দেহ যেন হারিকেনের চিমনি। আর অন্তর এমন নুরের দীপাধার, যে নুরের ত্যেজ কুহে তুর সহ্য করার ক্ষমতা রাখেনি। আল্লাহর এই বান্দা ইনসানে কামেল, পূর্ণ মানব, যার চরিত্রে স্বভাবে অস্তিত্বে মানবীয় গুণাবলী পূর্ণরূপে বিকশিত। আল্লাহর পবিত্র নামসমূহ ও গুণাবলীর তাজাল্লীর উদ্ভাস তার অস্তিত্বে প্রতিফলিত। এ জন্যে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আমি সমাবিষ্ট হব না জমিনে আসমানে। তবে সমাবিষ্ট হব মানুষের হৃদয়ে। এই সমাবিষ্ট হওয়ার স্বরূপ কী?
দর দিলে মুমেন বগুঞ্জিদাম চো জাইফ
বি চোন ও বি চেগুনে বি জে কাইফ
মোমিনের অন্তরে সমাবিষ্ট হব মেহমানের মতো
কি রকম, কত, ধরন ও স্বরূপ কেমন তা ব্যতিরেকে।
মোমিনের অন্তরে সমাবিষ্ট হওয়ার স্বরূপ কী, তার ধরন কী রকম এমন প্রশ্ন এখানে অবান্তর। মোমিন বান্দার অন্তরে নুরের এই বিচ্ছুরণের লক্ষ হচ্ছে, আত্মিকভাবে উন্নত বা অনুনন্নত সব মানুষ যেন তার কাছ থেকে লাভবান হয়। তার হেদায়তের বরকতে যেন সত্য সুন্দর সঠিক পথ খুঁজে নিতে পারে। জমিন ও আসমান আমার তাজাল্লি, বিচ্ছুরণ ধারণ করতে পারে না; অথচ আয়নারূপ মোমিনের অন্তর ধারণ করতে পারে। এ জন্য বলা হয়, প্রকৃত মোমিনের অন্তর আল্লাহর ফয়েজ ও তাজাল্লি বিকাশের মাধ্যম। মুসা (আ.)-এর জানা ছিল সৃষ্টি ব্যবস্থাপনার এই রহস্য। তিনি জানতেন সাধারণ মানুষ আল্লাহর তাজাল্লির বিচ্ছুরণ ধারণ করতে পারবে না, তাই তিনি তার পশমী চাদর দিয়ে ঝুলটুপি তৈরি করেন।
আল্লাহর সৃষ্টি ব্যবস্থাপনায় গ্রহতারা চাঁদণ্ডসূর্যের প্রভাব প্রমাণিত। চাঁদের প্রভাবে সাগরে জোয়ার ভাটা হয়, তাতে বিশাল জলরাশী প্রাণবন্ত আছে। সূর্যের কিরণ ও তাপে দিন হয়, রাত আসে। শীতগ্রীষ্মের পালাক্রমে জগত স্থিতিশীল আছে। অনুরূপ বস্তুজগতের বাইরে আধ্যাত্মিক জগতের ব্যবস্থাপনায় থাকেন ইনসান কামেল আল্লাহর নবীগণ। তাদের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত গোটা সৃষ্টিজগত। কথিত আছে, ইউসুফ (আ.)-কে দেওয়া সৌন্দর্যের ত্যেজ এমন ছিল, তিনি যখন কোনো পথ দিয়ে যেতেন, আশপাশের ঘরবাড়ির লোকেরা বলত এখন ইউসুফ আমাদের এদিক দিয়ে যাচ্ছেন। যে ঘরের ফটক পথের দিকে উন্মুক্ত থাকত সেই ঘরে পূর্ণিমায় জোসনার মতো ইউসুফের সৌন্দর্য প্রতিফলিত হতো।
হিন দরিচা সুয়ে ইউসুফ বাজ কুন
ওয়াজ শেকাফশ ফুরজেয়ি আগাজ কুন
ওহে, তোমার ফটক খুলে রাখ ইউসুফের পথের পানে
সে ফটক দিয়ে দেখতে থাক তার রুহানি রূপ প্রাণপণে।
এই যে ফটক খুলে রাখার কথা বললাম, তার তাৎপর্য কী। তার তাৎপর্য হলো, বন্ধুর ভালোবাসার চেরাগ জেলে আপন বক্ষ আলোকিত রাখা। তোমার বুকটা যদি সদা আলোকিত রাখতে চাও তাহলে সর্বদা প্রেমাষ্পদের ভালোবাসায় আকুল হয়ে থাক। আর এই কাজটি করতে হবে তোমার নিজেকেই।
রাহ কুন দর আন্দারুনহা খিশ রা
দুর কুন এদরাকে গাইর আন্দিশ রা
দিলের ভেতরে পথ খুঁজে বের কর বন্ধুর কাছে যাবার
আল্লাহ ছাড়া কারও চিন্তা স্থান দিও না অন্তরে তোমার।
তোমার ভেতরে ওষুধ আছে। গায়ে ঘা-পাঁচড়া হয়েছে। অলসতা কেন, মনের দোকান থেকে নিয়ে মলম লাগাও। চরিত্রে আচরণে অসুন্দর কিছু থাকলে সুন্দর, প্রশংসিত গুণে তা বদলে নাও। তখন তুমি বন্ধু কেন দুশমনকেও আপন করে নিতে পারবে। এভাবে বদলে যেতে পারলে তোমার কপালও বদলে যাবে।
চোন শুদি জিবা বেদান জিবা রসি
কে রহানদ রুহ রা আজ বি কাসি
সুন্দর হলে পৌঁছতে পারবে পরম সুন্দরের কাছে
তোমার রুহকে মুক্ত করবেন তিনি অসহায়ত্ব থেকে।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ৩০২৯-৩১২৩)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)