ঢাকা শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ৫ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ (রহ.)-এর জীবন ও কর্ম

এলাকার নাম শশীর চর। ছোট-বড় ১৩টি গ্রাম নিয়ে বিশাল এই এলাকা। কথিত আছে, ব্রিটিশ আমলে এ এলাকায় ‘শশী বাবু’ নামের একজন জমিদার ছিলেন। তার নামানুসারেই এলাকার নামকরণ করা হয় শশীর চর। বৃহত্তর শশীর চরের অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলো হচ্ছে- স্নানঘাটা, জমাদার কান্দি, কাঁচিকাটা, পাতাইলা কান্দি, শনিকোণা, উত্তর উড়ার চর, কদমতলি, ভবানী শংকর, নামির চর, ও মাতুব্বর কান্দি।

সবুজ-শ্যামল এলাকা। এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ নদের শাখা। সবাই যাকে বলে ‘ছোটোগাঙ’। বাজারি নৌকা, ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সরগরম থাকে সব সময়। নদীর তীরজুড়ে পাখণ্ডপাখালির কিচিরমিচিরে সকালের ঘুম ভাঙে। মৌসুমি ফসলে সেজে ওঠে প্রতিটি গ্রাম। ফুল, ফল, ফসলের শশীর চর সবার কাছেই নান্দনিক। শান্ত-শিষ্ট একটি এলাকা। একটি গ্রামের সঙ্গে আরেকটি গ্রামের সৌহার্দ সহোদরের মতো। মিলেমিশে চলছে যুগের পর যুগ।

শশীর চরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে গ্রীষ্মকালে পায়ে হাঁটা পথ আর বর্ষাকালে নৌকা। সবখানেই কাঁচা রাস্তা। মাঝে মাঝে আবার ভাঙা। অনেক রাস্তা আবার তলিয়ে যায় পানির নিচে। বর্ষায় সেখানে ভরসা শুধু বাঁশের সাঁকো। জনগণ কার্যত নিরুপায়।

শশীর চর কৃষিপ্রধান অঞ্চল। তাই কৃষকের সংখ্যাই বেশি। কোনো কোনো মৌসুমে ধান, গম, পাট, আখ, সরিষা, কলই, মুসুরি তাদের অর্থকরী ফসল। তবে বর্ষা মৌসুমের কয়েক মাস জমি থাকে পানির নিচে। ফলে অর্থনৈতিক অবস্থা আহামরি ভালো বলা যাবে না। কেননা বছরের ছয় মাস বসে বসেই খেতে হয় সবাইকে। বেশিরভাগেরই আবার ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা। তাই তো সুদ ব্যবসার খুব রমরমা অবস্থা। চোর-ডাকাতের উৎপাতও কম নয়।

এতসব হতাশার মাঝেও মাঝে মাঝে আশার আলো চোখে পড়ে। এলাকার ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত করার জন্য উদ্যোগ নেন ভবানী শংকর গ্রামের মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ। প্রতিষ্ঠা করেন একটি মাদরাসা। গ্রামের নাম স্নানঘটা অনুসারে নাম রাখেন স্নানঘাটা মাদরাসা। নিজ বাড়ির চাচাত ভাইদের দান করা জমিতে গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমে এবতেদায়ি পর্যন্ত চালু করেন। এরপর থেকেই পড়াশোনায় মোটামুটি উন্নতির দিকে যেতে থাকে এলাকাটি।

যদিও মহকুমা শহর থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দ্বীপই বলা যায় শশীর চরকে। আড়িয়াল খাঁ নদ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এলাকাটি। তারপরেও বেশকিছু মানুষের উদ্যোগে মাদ্রাসাটি চলতে থাকে। পাশাপাশি খুব ভোরে মসজিদে মসজিদে মক্তবের প্রচলন আছে। দু-চার ঘর পরপর দুয়েকজন শিক্ষিত মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়। তবে শিক্ষিতরা বেশিরভাগ চাকরি-বাকরি নিয়ে গ্রামের বাইরে থাকে। আর শিক্ষিত যারা গ্রামে থাকে; তারা শিক্ষকতায় ব্যস্ত।

শশীর চরের গ্রামে গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ আসেনি। কেরোসিন চালিত হারিকেন বা বাতিই ভরসা। সন্ধ্যা হলেই হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে আলো জ্বালাতে হয়। অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্তরা বাতিতেই ভরসা খুঁজে পায়। সন্ধ্যার পর থেকে ঘণ্টা দুই ঘরে ঘরে আলো জ্বললেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একে একে নিভে যেতে থাকে সব আলো। অন্ধকার নেমে আসে এলাকাজুড়ে।

সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ হলেও দূর-দূরান্ত থেকে দ্বীনি জ্ঞান শেখার জন্য শিক্ষার্থীরা আসতে থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে তাদের লজিং থাকার ব্যবস্থা করা হয়। মাওলানা ফয়েজ উদ্দিনের বাড়িতে বোডিং চালু করা হয়। কাচারি ঘরে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বিশাল পাতিলে রান্না হয়। দিনভর পড়াশোনার গুনগুন শব্দ ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে।

১৯২৬ সালে এলাকাবাসীর সহায়তায় দ্বীনি শিক্ষা প্রচারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত স্নানঘাটা ইসলামিয়া মাদরাসাটি ক্রমান্বয়ে ফাজিল পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়। একসময় কাগজে-কলমে মাদ্রাসার নাম হয় ‘স্নানঘাটা ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা’। মাদ্রাসাটির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য আনতে শুরু করেন। ধান, চাল, ডালসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে গ্রামের মানুষ তাকে সাহায্য করতে থাকেন। তৎকালীন রাজনীতিবিদ আব্দুল করিম ঢালীর সঙ্গে সখ্য ছিল শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের। মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন মাদ্রাসাটি উন্নত করার লক্ষ্যে আব্দুল করিম ঢালীর সাহায্য চাইলেন। তিনি বড় হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে শেরে বাংলার সঙ্গে দেখা করেন। মাদরাসার উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন।

স্থানীয়দের কাছে শোনা যায়, ফয়েজ উদ্দিন ১৮ শতকের শেষের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় ‘বড় হুজুর’ নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাবা মোহাম্মদ ঢালী একজন আদর্শ কৃষক ছিলেন। কৃষকের সন্তান হিসেবে ফয়েজ উদ্দিনের বাবা ছেলেকে আদর্শ কৃষকই বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফয়েজ উদ্দিনের পড়াশোনার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল।

ফয়েজ উদ্দিন পড়াশোনার আগ্রহ নিয়ে কালকিনির শিকারমঙ্গল এলাকার মামা বাড়িতে (ঢালী বাড়ি) চলে যান। সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে এলাকার বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা খলিলুর রহমান বাহার উল্লাহর আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে তার সান্নিধ্যে কয়েক বছর এলমে দ্বীন গ্রহণ করেন। পরে উচ্চ শিক্ষার জন্য হাটহাজারী মাদরাসায় যান। সেখান থেকে পড়া শেষ করে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় গিয়ে আরবি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।

শিক্ষাগ্রহণ শেষে এলমে দ্বীন প্রচার ও শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে নিজ জন্মস্থান ভবানী শংকরে ফিরে আসেন। গ্রামে এসে প্রতিবেশী হাজী তজিমুল্লাহ ফরাজীর মেয়ে মোসাম্মৎ মরিয়ম বিবির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এক ছেলে আফছার উদ্দিন ও এক মেয়ে মোসাম্মৎ রাবেয়াকে রেখে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর পার্শ্ববর্তী উত্তর উড়ার চর গ্রামের ঢালী বাড়ির মোহাম্মদ ফরমান ঢালীর মেয়ে জবেদা বিবিকে বিবাহ করেন। সে পক্ষে তার আরও পাঁচটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তাদের নাম রাখেন ফরিদা খানম, মমতাজ বেগম, রিজিয়া খানম, সুফিয়া বেগম ও অজুফা খানম।

বড় হুজুর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইসলাম প্রচারকদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন। সে হাজী শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পীরজাদা আবা খালেদ রশিদ উদ্দিন ওরফে বাদশা মিয়ার নেতৃত্বে ইংরেজবিরোধী আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন।

১৯৮০ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে মাওলানা ফয়েজ উদ্দিন আহম্মেদ নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর পর বাড়িতেই কবর খোড়েন আত্মীয়-স্বজনরা। কিন্তু এলাকাবাসীর অনুরোধে তাকে তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে শায়িত করা হয়। পরে তার একমাত্র ছেলে মাওলানা আফছার উদ্দিন ঢাকা আলিয়া থেকে কামিল পাস করে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

বৃহত্তর ফরিদপুরের মধ্যে এটিই প্রাচীন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বংশ পরম্পরায় ফরায়েজী আন্দোলনের খলিফা হয় মাওলানা আফছার উদ্দিনও। এলাকায় তাকেও ‘বড় হুজুর’ বলে সম্মান করেন সবাই। ফলে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মিলাদ বা দোয়া পড়ানো, মৃতের জানাজা পড়ানো, মসজিদের ইমামতি, আজান দেওয়া, জমির ভাগ-বণ্টন, ধর্মীয় মাসআলা দেওয়া, শীতের মৌসুমে ওয়াজ-মাহফিল করা, গরুর ক্ষুরা রোগের জন্য পাকা কলা পড়ানো, অসুখ-বিসুখের জন্য পানি পড়া দেওয়া, গ্রামের ছোটখাটো বিচার-বৈঠক তো আছেই।

একসময় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদ। তার মৃত্যুর পর মাদ্রাসার হাল ধরেন তার একমাত্র সন্তান মাওলানা মেছবাহ উদ্দিন ফয়েজী। তিনি উপাধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত অকাল প্রয়াত হন তিনি। ইসলামের খেদমতে নিবেদিত পরিবারটি দায়িত্বভার থেকে অব্যাহতি পান আল্লাহর ইশারায়। এলাকার মানুষের ভালোবাসায় মাদ্রাসাটি এরই মধ্যে শতবর্ষ অতিক্রম করার গৌরব অর্জন করে। মাদ্রাসার অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী দেশে-বিদেশে সুনামের সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন।

তথ্যসূত্র

১. ইতিহাস ঐতিহ্য অমরত্বের কালকিনি, আকন মোশাররফ হোসেন, পৃষ্ঠা : ২১২/২১৩

২. বড় হুজুরের পুত্রবধূ আমেনা বেগম

৩. একমাত্র পুত্র মাওলানা আফছার উদ্দিন আহমেদ

৪. একমাত্র নাতি মাওলানা মেছবাহ উদ্দিন ফয়েজী

৫. বড় মেয়ে রাবেয়া খাতুনের ছেলে মাওলানা আব্দুল মাজেদ।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত