প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৫
একটি রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে রাজনীতি। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটই বলে দেয় দেশটি কতটা সম্ভাবনাময়। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের সার্বিক মঙ্গলনির্ভর করে রাজনৈতিক হালচালের উপর। রাজনৈতিক পরিস্থিতি সুস্থ ও মানবিক হলে দেশের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্রমে স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসায় আবদ্ধ থাকে তখন সাধারণ জনগণের ভোগান্তির শেষ থাকে না। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন জনগণের ভোগান্তিকে বাড়িয়ে তুলছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা ধরে রাখা কিংবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যা ইচ্ছে তাই করে। তারা দেশের কল্যাণ অথবা জনগণের মঙ্গলের জন্য রাজনীতি করে না। তারা রাজনীতি করে থাকে একমাত্র তাদের স্বার্থ হাচিলের জন্য। সেটা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুব বেদনাদায়ক।
গত ৫৪ বছরে দেশের ইতিহাসে খুব কম দলই আছে, যারা সুস্থ রাজনীতির নজির রাখতে পেরেছেন। ২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। টেলিভিশন খুললেই হরতাল, অবরোধ, মিছিল, খুন-খারাপি, ডাকাতি, ছিনতাই ও সহিংস কর্মসূচি দেখতে পাচ্ছি। যেটি গোটা দেশবাসীর মনে আতঙ্ক ও ভয় সৃষ্টি করছে।
রাজনৈতিক সংঘর্ষে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন রিকশা চালক, হকার, দিনমজুর ইত্যাদি নিম্ন পেশাজীবী মানুষজন। অস্থির পরিস্থিতিতে গাড়ি-ঘোড়া চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, দোকানে ক্রেতা হ্রাস পায়, কারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়ার মতো নানা সমস্যা দেখা দেয়। যা দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলে। যাদের একদিন আয় না করলে মুখে ভাত ওঠে না, তাদের সংসারে নেমে আসে অনিশ্চয়তা। একজন দিনমজুরের রাজনীতি নিয়ে কোন চিন্তা নেই, এটি সরাসরি তার পেটের ভাতের প্রশ্ন। দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় ঢাকা শহরের দিনমজুরের কাছে রাজনৈতিক অস্থিরতা মানে অনিশ্চয়তা। রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়, পরিবহনে কাঁচামাল নষ্ট হয়ে যায়, অ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোগীদের অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়ে এবং চাকরি জীবীদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, রাজনৈতিক কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। ফলে সরাসরি শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভাব পড়ে। যেমন পরীক্ষা পিছিয়ে যায়, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অনিহা তৈরি হয় এবং শিক্ষাবর্ষ পিছিয়ে যায়। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। শিক্ষা একটি দেশ ও জাতির জন্য অপরিহার্য হলেও দেশের রাজনৈতিক অস্থির পরিবেশ শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল করে দেয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশের অর্থনীতি চরম ভাবে ভেঙে পড়ে। বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় ভোগেন, কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না, দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, কৃষকরা ফসলের দাম পায় না আরও অনেক সমস্যা দেখা দেয়। তখন সাধারণ মানুষজন দ্বিমুখী চাপের সম্মুখীন হন — একদিকে তাদের ইনকাম কমে যায়, অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
দেশের রাজনীতিতে আরেকটি সমস্যা হলো ভিন্নমতকে শত্রুতা হিসেবে দেখা। রাজনীতি সংশ্লিষ্ট মানুষজন সামাজিকভাবেও বিভক্ত হয়ে পড়ে। সবার চোখে বিরক্তিকর ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়। আমাদের দেশে পরিবারের মধ্যেও রাজনৈতিক মতভেদ দূরত্ব তৈরি করে, যা সামাজিক ঐক্য নষ্ট করে। দেশের পুলিশ প্রশাসনও ক্ষমতায় থাকা দলের হয়ে কাজ করে। ফলে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।
প্রভাবশালী নেতাদের দৌরাত্ম্য রাষ্ট্রের ওপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়। অনেক সময় গণমাধ্যম কর্মীরা রাজনৈতিক চাপে পড়ে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে বাধাগ্রস্ত হয়। অথচ একটি দেশের সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যম অপরিহার্য। পূর্ব এশিয়া, ইউরোপের দেশগুলোতে গণমাধ্যমগুলো স্বাধীনভাবে বাস্তবতা তুলে ধরতে পারেন। যেটি তাদের রাজনৈতিক পরিবেশকে স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল রাখতে সাহায্য করে। বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করছে। যেমন ২৪ পরবর্তী সময় এনসিপির মতো সংগঠনগুলো। তারা জবাবদিহিতা চায়, চায় নিরাপদ জীবন ও ন্যায্য অধিকার। রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণমুখী। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনীতি পুরোটাই ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরাসরি জনগণের জীবনের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় প্রতিটি সংঘাত-সংঘর্ষে জনগণকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এক কথায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমনই হোক তার ভার বহন করে সাধারণ মানুষ। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জনগণের স্বস্তি, নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করা।
সবার মনেই একটি প্রশ্ন, রাজনৈতিক প্রভাব থেকে জনগণের মুক্তি মিলবে কবে? এসব দলের ক্ষমতার খেলার শেষ কোথায়? বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হবে সেই দিন, যেদিন সব দল-মত নির্বিশেষে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। সবাই দেশ প্রেম হৃদয়ে ধারণ করে দেশের তরে কাজ করলেই রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে মুক্তি মিলবে। আমরা চাই জনগণের ভোগান্তি লাঘব করায় হোক রাজনীতির মূল লক্ষ্য। আজকে বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক কান্তিলগ্নে দাঁড়িয়েছে, যেখানে সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে জনগণের ভোগান্তি ছাড়া কিছুই আশা করা যায় না। আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি যেন আরও গরম হয়ে যাচ্ছে। যেটি আমাদের জন্য আশঙ্কার। দেশের নাগরিক, সমাজ, গণমাধ্যম ও প্রশাসনের সক্রিয় হওয়া জরুরি। দেশকে উন্নত বিশ্বে দাঁড় করাতে প্রয়োজন স্থিতিশীল রাজনীতি। পরিশেষে বলতে চাই, সংঘাত নয় সম্প্রীতি; প্রতিহিংসা নয় দায়িত্ববোধের নেতৃত্ব গড়ে উঠুক।