ঢাকা সোমবার, ১৭ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অদৃশ্যে বিশ্বাসের অনুশীলনী

অদৃশ্যে বিশ্বাসের অনুশীলনী

মানবাকৃতির একটি পুতুল বা খুঁটির কথা চিন্তা করুন। যদি মাটির সাথে পায়ের শক্ত গাঁথুুনি না থাকে, তাহলে কি এগুলো খাড়া হয়ে থাকতে পারবে? পারবে না। মেশিন লাগিয়ে যদি হাঁটানোর ব্যবস্থা করা হয়, তাও পারবে না, ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাবে। কারণ, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণি বা খুঁটি আস্ত খাড়া থাকতে বা পথ চলার কসরত করতে পারে না। বস্তুত একহারা খাড়া মাথা উঁচু করে হাঁটা মানুষের সৃষ্টিতত্ত্বের আরেক রহস্য। জীবন্ত মানুষের ভেতরে খাড়া থাকার পথ চলার যে শক্তি তাকে আমরা ভারসাম্য বলতে পারি। এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব। এই ভারসাম্য শক্তি সবার মধ্যে বিদ্যমান, তবে তা অদৃশ্য। অথচ এই অদৃশ্য শক্তিকে নিয়ে মানুষের জীবন ও জগত সংসার প্রতিষ্ঠিত।

দেহের ভারসাম্য শক্তির মতো আরেকটি শক্তি আছে, যার উপর মানুষের মনুষ্যত্ব, বৈশিষ্ট্য ও মানবীয় গুণাবলী নির্ভরশীল, সেই শক্তির নাম বিশ্বাস। জীবনকে এগিয়ে নিতে হলে নিজের উপর এই বিশ্বাস থাকতে হবে। আত্মবিশ্বাস ব্যতীত কোনো মানুষ বা জাতি দুনিয়ার বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে পারে না। এই আত্মবিশ্বাস এমনিতে জন্ম নেয় না। দৃশ্যমান জগত, চারপাশের পরিবেশ, মানুষ ও সৃষ্টিলোক সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে, জগত ও জগতের সৃষ্টির বিষয়ে নানা জিজ্ঞাসার কী জবাব আছে, তা নিয়ে গঠিত হয় বিশ্বাস। ইসলামে এই বিশ্বাসের গুরুত্ব বহুতল ভবনের ভিত্তিমূল বা মাটির নিচের গাঁথুনির মতো। কিংবা বিরাট বৃক্ষের শিকড়ের সাথে তুলনীয়, যা মাটির অনেক গভীরে গিয়ে চারিদিকে বিস্তৃত। মাটির নিচের গাঁথুনি ও ভিত্তি না থাকলে যেমন বহুতল ভবন টিকে থাকতে পারে না, শিকড় বিহীন গাছের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, বিশ্বাস ছাড়াও কোনো মানুষের মনুষ্যত্বের অস্তিত্বের কথা চিন্তা করা যায় না। এ কারণে কোনো মানুষ ঈমানদার বা মুসলমান হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে, তাকে বিশ্বাসের বলে বলিয়ান হতে হবে। এই বিশ্বাসও হতে হবে অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে। দালানের মাটির নিচের গাঁথুনি বা গাছের প্রোথিত শিকড়ের মতো। কুরআন মজিদে মুমিনদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে আল্লাহর ভাষা এরূপ ‘হে ওইসব লোক যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছ’ কিংবা ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে।’ সূরা ফাতিহার পর সূরা বাকারা দিয়ে কুরআন মজিদ শুরু হয়েছে। ‘আলিফ লাম মীম, এই কিতাব, এখানে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তা মুত্তাকিদের জন্য হেদায়ত, পথনির্দেশিকা।’ এর পরপর মুক্তাকিদের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে, ‘যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে।’

এক শ্রেণির লোক বলে, আমরা অদৃশ্যে বিশ্বাস করি না। আগুন জ্বলছে, সামনে যা পাচ্ছে ভস্মীভূত করছে, চোখে দেখে বিশ্বাস করি আগুনের দহন জ্বলন। সুরেলা বা কর্কশ আওয়াজের অস্তিত্ব আমরা বিশ্বাস করি শ্রবণেন্দ্রিয়ের সাহায্যে। জিহ্বা আছে বলে টক, ঝাল পরীক্ষা করতে পারি, ফুলের সুবাস, পঁচা দুর্গন্ধ পরীক্ষার জন্য আছে নাসিকা। ত্বক আছে বলে হাতে ছুঁয়ে বস্তুর অস্তিত্ব, উঞ্চ শীতল ফারাক করা যায়। পঞ্চেন্দ্রিয়ের বাইরে কিছুর অস্তিত্ব নেই। সব মরীচিকা মায়াজাল। আরো পরিষ্কার ভাষায় তারা বলতে চান, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা যাবে না বা ধরা ছোঁয়ার বাইরে এমন নির্বস্তুক কিছুতে আমরা বিশ্বাসী নই। তারা খাঁটি বস্তুবাদি। অদৃশ্য বিশ্বাস তাদের কাছে অন্ধ বিশ্বাসের সমতুল্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রোথিতযশা অধ্যাপক মরহুম ড. আবদুল্লাহর মুখে অন্তত দুইবার শুনেছি একটি কথা। তার ভাষায় ‘আমি এবং আরো কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বসে আছি, ভিসির বাসভবনের ওয়েটিং রুমে। তার সাথে সাক্ষাৎ হবে এ আশায় সবাই অপেক্ষায়। হঠাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের নামকরা নাস্তিক লেখক অধ্যাপক, (প্রয়াত) আমাকে দেখেই চটে গেলেন। আমিও যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সে লেহাজটুকু করলেন না। সবার সামনে তীর্যক ভাষায় বললেন, এই তুমি যে খোদা খোদা কর, খোদারে কী তুমি দেখেছ। আমি তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আপনি যে আপনার পিতাকে বাবা বলে ডাকেন, তিনি আপনার প্রকৃত পিতা তা কি হলফ করে বলতে পারবেন। পাড়াপড়শী, আপনার মা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের কথা বিশ্বাস করে আপনার পিতাকে বিশ্বাস করেন, অথচ আপনার মা মিথ্যা বলারও অবকাশ আছে। আমার খোদাকে না দেখলেও তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে এমন মহাপুরুষরা সাক্ষ্য দিয়েছেন যারা পরম সত্যবাদি হিসেবে দুনিয়ার মানুষ সাক্ষ্য দেয়। অপ্রত্যাশিত জবাব শুনে নাস্তিক অধ্যাপকের আমতা আমতা করা ছাড়া উপায় ছিল না।’

শেখ সাদী বলেছেন,

‘বর্গে দেরাখতানে সবজ দর নজরে হুশিয়ার

হার ওয়ারাকে দফতরীস্ত মারেফাতে কির্দেগার’

সবুজ বৃক্ষের পত্রপল্লব বিচক্ষণ মানুষের দৃষ্টিতে

আল্লাহকে চেনার একেক গ্রন্থ, সন্দেহ নেই তাতে।

পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হওয়ার যে মূল উপাদান এক কথায় তার নাম আত্মবিশ্বাস। আত্মবিশ্বাস উৎসারিত হয় আল্লাহর উপর বিশ্বাস থেকে। আল্লাহ চর্মচক্ষুর আড়ালে, বেহেশত, দোজখ, ভাগ্যলিখন-তকদির প্রভৃতির অবস্থানও অদৃশ্য জগতে। বস্তুত যারা অদৃশ্য বিষয়ে বিশ্বাসী তারাই বিচক্ষণ, আর যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে না, তারা অন্ধ বস্তুর বাইরে আর কিছুর অস্তিত্ব দেখে না, দেখার দৃষ্টিশক্তি নাই। কোনো যুক্তি তর্কের ধারে কাছে না গিয়ে দুনিয়ার অনেক কিছুর অস্তিত্ব নাই বলে বলে বেড়ায় তারাই অন্ধ বিশ্বাসী।

কিন্তু মুমিন মুসলমান অদৃশ্যে বিশ্বাসে বলিয়ান।

রমজানে দীর্ঘ ত্রিশ দিন এই বিশ্বাসকে লালন করে, অনুশীলন করে। তাতে আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা ও ভয় তার অন্তরে বদ্ধমূল হয়, তার চরিত্রে গেঁথে যায়, স্বভাবে পরিণত হয়। আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা না থাকলে কেউ কী উপোস থাকার মধ্যে অনন্দ খোঁজ করবে, করতে পারে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রোজাদারের জন্য দুটি পরম আনন্দ, একটি আনন্দ ইফতারের সময়; আরেকটি আনন্দ আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময় (যখন রোজাদার রোজার অভাবনীয় প্রতিদান লাভ করবে।)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত