ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলে এক সময় ছিল বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ প্রভাব। বাংলার পাল রাজারা ছিলেন (৭৫০-১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ) বৌদ্ধ। পালদের পরে আসেন সেন রাজারা (১০৯৫-১২০০ খ্রিষ্টাব্দ)। সেন রাজারা বাংলার লোক ছিলেন না। এরা ছিলেন দাক্ষিণাত্যের। সেন রাজারা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। তারাই বাংলায় বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করেন বর্ণাশ্রম এবং ব্রাহ্মণ, কায়স্হ ও বৈদ্যের কৌলিন্য প্রথা। এ আমলে বৌদ্ধরা হতে থাকেন নিগৃহীত। বৌদ্ধদের হিন্দুরা মনে করতেন অশুচি বলে। এই অপমানিত বৌদ্ধরাই পাঠান আমলে বিশেষভাবে সাড়া দেয় ইসলামের ডাকে। মুসলমানরা আসার আগে বাংলায় হিন্দু-বৌদ্ধ বিরোধ চলছিল প্রবলভাবে।
এ দেশের হিন্দুরা নয়, দলে দলে বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইসলাম ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বিস্তৃত হয়। পূর্ব বাংলা থেকে বহু বৌদ্ধ যেতেন মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে দলে দলে বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণ করতে দেখে পূর্ব বাংলার বৌদ্ধদের মধ্যেও দেখা দেয় ইসলাম গ্রহণের স্পৃহা। এভাবেই পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করেন। আগেই এ দেশের হিন্দু-বৌদ্ধদের মধ্যে একটা বিরোধ ছিল। বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করার পর প্রাচীন হিন্দু-বৌদ্ধ বিরোধ হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু-মুসলমান বিরোধ।
এক সময় বাংলাদেশে হিন্দুরা মুসলমানদের বিদ্রুপ করতেন ‘নেড়ে’ বলে। বৌদ্ধরা মাথা মুণ্ডায়ন করতেন। হিন্দুরা তাই উপহাস করতেন নেড়ে বলে। বৌদ্ধরা মুসলমান হওয়ার পর তারাও হিন্দুদের কাছে নেড়ে হিসেবে উপহাস্য হতে থাকেন।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন, ‘বৌদ্ধরা এতটা উৎপীড়িত হয়েছিল যে, মুসলমান কর্তৃক বঙ্গবিজয় ভগবানের দানস্বরূপ মনে করিয়াছিল।
শূন্যপুরাণের ‘নিরঞ্জনের উষ্মা’ নামক অধ্যায়ে দেখা যায়, তাহারা (বৌদ্ধরা) মুসলমানকে ভগবানের ও নানা দেবদেবীর অবতার মনে করিয়া তাহাদের কর্তৃক ব্রাহ্মণ দলনে নিতান্ত আনন্দিত হইয়াছি। ইতিহাসে কোথাও একথা নাই যে সেনরাজত্বের ধ্বংসের প্রাক্কালে মুসলমানদিগের সঙ্গে বাঙালি জাতির রীতিমত কোনো যুদ্ধবিগ্রহ হইয়াছে। পরন্তু দেখা যায় যে, বঙ্গবিজয়ের পরে বিশেষ করিয়া উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সহস্র সহস্র বৌদ্ধ ও নিম্নশ্রেণির হিন্দু, নব ব্রাহ্মণদিগের ঘোর অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণপূর্বক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়াছে।’ (ড. দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, পৃষ্ঠা : ৫২৮)।
মুসলিম শাসকদের উদারতা, বৌদ্ধদের প্রতি মুসলিমদের ভালো ব্যবহারের ফলে দলে দলে বৌদ্ধরা ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ‘বাংলার অর্ধেক বৌদ্ধ মুসলমান হইয়া গেল।’ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বৌদ্ধধর্ম, পৃষ্ঠা : ১৩১)। তবে মুসলমান হওয়ার এই প্রক্রিয়াটি রাতারাতি হয়ে যায়নি, রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে বৌদ্ধ-মুসলিম সংমিশ্রনের ফলে বৌদ্ধরা ধীরে ধীরে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে। সর্বপরি কিছু সংখ্যক হিন্দুও ইসলাম গ্রহণ করেন। এরমধ্যে নিম্নবর্ণ ও উচ্চ বর্ণের হিন্দুও রয়েছে।
আর্যদের আগ্রাসী আধিপত্যবাদ দ্রাবিড় ও আদিবাসীদের দেশছাড়া করে ঠেলে দিয়েছিল দক্ষিণ দিকে লংকা পর্যন্ত। আর পূর্বদিকে গভীর বন ও নদী জড়াজড়ি করে থাকা বাংলার দুর্গম প্রান্তর পর্যন্ত। পালিয়ে এসেও তারা কিন্তু বাঁচেনি। বাংলার জংগলঘেরা শান্ত নদীর তীরে নতুন নীড় গড়ে বাংলার এ দরিদ্র মানুষেরা ভেবেছিল আর কিছু না হোক তারা তাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়ে শান্তিতে বাস করতে পারবে। কিন্তু রাজনৈতিক আধিপত্যের কাঁধে ভর করে আর্য সংস্কৃতির নিষ্ঠুর সয়লাব এসে গ্রাস করে তাদের।
ভারতে বৌদ্ধ মৌর্য যুগের পতনের পর ৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে গুপ্ত যুগের সূচনা ঘটে।
পরবর্তী ৪২০ বছর তাদের পরম দুর্ভাগ্যের কাল। অহিংস ও শান্তিবাদী বৌদ্ধ ধর্ম এবং নিরীহ দ্রাবিড়ীয় জীবন চর্চা যে শাস্ত্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সৃষ্টি করে, তা আর্যদের কর্মবাদী ও নিপীড়ন মূলক সংস্কৃতির আগ্রাসনে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বিশেষ করে সপ্তম শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় হিন্দু রাজ শশাংকের এবং এগারো শতকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসনকালে বৌদ্ধ সমাজ সংস্কৃতি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
বৃষ্টিস্নাত সুজলা সুফলা নদী বিধৌত পলিমাটির বাংলাদেশের শান্ত ও কোমল হৃদয়ের মানুষগুলো শুরু থেকেই আধ্যাত্মবাদী ও মানবিক দর্শন ও সংস্কৃতির অনুসারী, যার সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও কর্মবাদী আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘাত অত্যন্ত মৌলিক। এই সংঘাতে নিষ্পিষ্ট ও জর্জরিত হয় বাংলার মানুষ।