ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ঝাঁক ইসরায়েলে আরেক দফা আঘাত হেনেছে। গতকাল শনিবার ভোরে চালানো এই হামলা ছিল অপারেশন ট্রু প্রোমিজ থ্রি-র অধীনে ১৮তম হামলা। অভিযানের এই ধাপ শুরু হয় ভোর ৩টা ১০ মিনিটে। অনলাইনে প্রচারিত কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, ইরানের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে ইসরায়েলের আকাশ ঝিলিক দিয়ে আলোকিত হয়ে উঠছে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আসার সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন সক্রিয় করা হয়। বসতি স্থাপনকারীরা আবার ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারগুলোতে ফিরে যেতে বাধ্য হন, যেখানে আজকাল তাদের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হচ্ছে। ইসরায়েলি গণমাধ্যম তেলআবিবের কেন্দ্রস্থলে বিশাল বিস্ফোরণের খবর দিয়েছে। তার মানে হলো, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আবার তিন স্তরের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, তেলআবিবের একটি ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানে এবং বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিছু প্রতিবেদনে ইসরায়েলের বন্দরনগরী হাইফার কাছে ক্রায়োট এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে বলে জানিয়েছে, যেখানে শুক্রবারও বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা হয়েছিল। অভিযানের পর এক বিবৃতিতে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি বলেছে, অপারেশন ট্রু প্রোমিজ থ্রি-র সর্বশেষ ধাপে ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় অংশ এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে হামলা করা হয়, যেখানে টার্গেট করা হয় ইহুদিবাদী সেনাবাহিনীর সামরিক স্থাপনা ও অপারেশনাল সাপোর্ট সেন্টারগুলোকে। এই হামলায় বিপুল পরিমাণ শাহেদ-ওয়ান-থার্টি-সিক্স সুইসাইড ও কমব্যাট ড্রোন ব্যবহার করা হয়। সেই সঙ্গে প্রিসিশন-গাইডেড কঠিন ও তরল জ্বালানিযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছিল, যেগুলো পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হানতে ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম। বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, শাহেদ ড্রোনের বেশ কয়েকটি স্কোয়াড্রন গত শুক্রবার রাতে ইসরায়েলে ক্রমাগত আঘাত হানতে থাকে। ইসরায়েলের সবচেয়ে উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এসব ড্রোনকে প্রতিহত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের টেকসই এই মিশ্র অভিযান ইসরায়েলে আঘাত হানতে থাকবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। গত শুক্রবার ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনা ও শিল্প কারখানার পাশাপাশি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার ও গুপ্তচর কেন্দ্রগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার শক্তিশালী ঢেউয়ের কয়েক ঘণ্টা পর এই ১৮তম হামলা পরিচালিত হয়। ১৭তম হামলায়ও দূরপাল্লার সুপার-হেভি ক্ষেপণাস্ত্র এবং কমব্যাট ও সুইসাইড ড্রোন ব্যবহৃত হয়। আইআরজিসির মুখপাত্র বলেন, ‘বিশ্বকে আরও বিস্ময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে; ইরানি জনগণের বিজয়ের মাধ্যমে এই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটবে।’
ইরানের ১০ ক্ষেপণাস্ত্রের ৫টিই আঘাত হেনেছে : ইসরায়েলের চ্যানেল টোয়েলভ ও দেশটির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ইরান থেকে গতকাল সকালে ১০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে, যার মধ্যে ৫টি নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়েছে। একটি ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিবের দক্ষিণের হোলন শহরে আঘাত হানে বলে খবর পাওয়া যায়। হামলায় সেখানে একটি বহুতল ভবনে আগুন ধরে যায় এবং সেটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চ্যানেলটির খবরে বলা হয়েছে, ইরানের পাল্টা হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল তাদের নতুন ‘লাইটনিং’ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বসাতে শুরু করেছে। ইরানি ড্রোন ঠেকাতে এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহৃত হবে। জেরুজালেম পোস্ট জানায়, ইরানে ইসরায়েলের হামলার এক সপ্তাহ পার হলেও তেহরানে সরকারের কোনো অস্থিরতা দেখা যায়নি; বরং তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে। দৈনিকটি উল্লেখ করেছে, গতকাল সকালের হামলা ছিল ইরানের ১৮তম হামলা। এসব হামলা ইঙ্গিত দিচ্ছে, তেহরান দীর্ঘ মেয়াদে চাপ বজায় রাখতে ও আরও বৃদ্ধি করতে প্রস্তুত, যতক্ষণ না কৌশলগত লক্ষ্য পূরণ হয়েছে বলে তারা মনে করেন।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে ইরানের ড্রোন হামলায় ‘বিস্মিত’ ইসরায়েল : ইরানের দুটি ড্রোন ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে দেশটির উত্তরাঞ্চলে ও দক্ষিণাঞ্চলে পৃথক হামলা চালিয়েছে। যা অনেকটা অবাক করেছে ইসরায়েলকে। হামলার বিষয়টি স্বীকার করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এটি একটি বিরল ঘটনা, যেখানে ইরানের ওয়ানওয়ে অ্যাটাক ড্রোন সফলভাবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের খবরে বলা হয়, গতকাল শনিবার ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে জর্ডান সীমান্তসংলগ্ন বেইত শেইন শহরে একটি ড্রোন আঘাত হানে। এতে একটি দুইতলা বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। জরুরি উদ্ধারকর্মীরা জানান, বিস্ফোরণে বাড়িটির পাশে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়েছে, জানালা ও দরজা উড়ে গেছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর তথ্যমতে, ইরানের দ্বিতীয় ড্রোনটি ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের একটি খোলা এলাকায় আঘাত হানে।
ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির খবর প্রকাশে ইসরায়েলের বিধিনিষেধ : ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের ব্যাপক সেন্সরশিপের পরও কিছু ভিডিও অনলাইনে শেয়ার করা হয়েছে, যেখানে দেখা গেছে, হাইফা বন্দর ও তেলআবিবে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার পর অনেক স্থান থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠছে। স্থানীয় হাসপাতালগুলোর তথ্যের বরাতে সিএনএনের খবরে বলা হয়, শুধু হাইফায় গত শুক্রবার ইরানের হামলায় ৩৩ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যম বলছে, এই তথ্য আসল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণের তুলনায় নগণ্য। সরকারি বিধিনিষেধের কারণে ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানির যথাযথ চিত্র সংবাদমাধ্যমে তুলে আনা সম্ভব হচ্ছে না। কিছু মিডিয়া ইসরায়েলে বিপুল প্রাণহানির খবর দিলেও ইসরায়েল এ পর্যন্ত মাত্র ২৫ জন নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করছে। আলজাজিরার খবরে বলা হয়, ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো ইরানের সঙ্গে চলমান যুদ্ধের খবর কীভাবে প্রকাশ করবে, সে বিষয়ে সরকার একটি নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সেন্সরশিপ বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কোবি ম্যান্ডেলব্লিট এক বিজ্ঞপ্তিতে কিছু নিয়মনীতি ঘোষণা করেন। ইরানি হামলার প্রভাব নিয়ে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা কী প্রকাশ করতে পারবেন এবং কী পারবেন না, তা এসব নিয়মনীতিতে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ইসরায়েলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটলেও প্রকৃত হতাহতের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে না। এদিকে, ইসরায়েলি প্রোপার্টি ট্যাক্স কমপেনসেশন ফান্ডের বরাত দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ইয়েদিওথ আহরোনোথ জানিয়েছে, ইরানের হামলায় আট হাজারেরও বেশি ইসরায়েলি ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন। তাছাড়া ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি ইসরায়েলি। প্রতিবেদন মতে, ভবন বা যানবাহনের ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে এসব অনুরোধ এসেছে।
বিক্ষোভের প্রশংসা খামেনির : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দেশটিতে চলমান বিক্ষোভের প্রশংসা করেছেন। গতকাল শনিবার এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘এই বিক্ষোভগুলো আমাদের প্রিয় জাতির সাহসিকতা, যুক্তিবোধ ও আধ্যাত্মিকতার শক্তিকে তুলে ধরেছে।’ গত সপ্তাহে ইসরায়েলের আকস্মিক হামলার পর থেকে প্রকাশ্যে আসেননি খামেনি। তবে তার সামাজিকমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট সক্রিয় রয়েছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তারা এই সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ইরানের নেতৃত্বকে উৎখাত করতে চায়। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, ‘খামেনি আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না; তাকে হত্যা করা হবে।’ এই অবস্থায় সামাজিকমাধ্যমে খামেনি ইরানিদের সাহস জোগাচ্ছেন এবং ইরান কোনো শক্তির সঙ্গে আপস করবে না বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এদিকে, ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ইরানে রাজধানী তেহরানসহ দেশজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর লাখ লাখ মানুষ এসব বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নেন। প্রতিবেদন মতে, তেহরান, তাবরিজ, ইসফাহান, শিরাজ, মাশাদ ও কমের পাশাপাশি ছোট ছোট শহরেও বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি ও ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ জানিয়ে স্লোগান দেয়া হয়। ফিলিস্তিনের প্রতিও সংহতি জানান তারা। এক্সে তেহরান টাইমসের পোস্ট করা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন ইরানি পতাকা এবং একজন ইউনিফর্ম পরিহিত সৈনিকের ছবি সম্বলিত কফিন বহন করছেন। তাদের পিছনে পুরুষ, নারী ও শিশুরা স্লোগান দিচ্ছেন ‘ইসরায়েলের পতন হোক’। তেহরানের দক্ষিণে অবস্থিত পবিত্র শহর কোম এবং রাজধানীর পশ্চিম উপকণ্ঠ কারাজেও একই রকম জানাজার দৃশ্য দেখা গেছে। এ সময় বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেকে ইরান, ফিলিস্তিন ও হিজবুল্লাহর পতাকা ওড়ান।
ইসরায়েলি চ্যানেলের সদরদপ্তরে মিসাইল হামলা : আহরাম অনলাইন জানিয়েছে, ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ইসরায়েলের হাইফা শহরে অবস্থিত ইসরায়েলি চ্যানেল ফোর্টিনের লাইভ সম্প্রচারের সদরদপ্তরে মিসাইল হামলা চালিয়েছে। গত সোমবার ইসরায়েলি বাহিনী তেহরানে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ব্রডকাস্টিং বা আইআরআইবি-র সদরদপ্তরে হামলা চালায়। এর জবাবেই মূলত ইরান ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমটির কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে। এদিকে, ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকেন্দ্রে ইসরায়েলের ওই হামলাকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে তেহরান। তারা বলেছেন, এই হামলা ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর অপরাধপ্রবণতা ও আন্তর্জাতিক নীতির প্রতি অবজ্ঞা আবারও প্রমাণ করেছে। তবে, ইসরায়েলি হামলার কিছুক্ষণ পরই আইআরআইবি সদরদপ্তরের কার্যক্রম আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।
মোসাদের ৫৪ গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার করেছে ইরান : তেহরান ও তেলআবিবের মধ্যে চলমান সংঘাতের মধ্যেই ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ৫৪ জন গুপ্তচরকে গ্রেপ্তার করেছে ইরান। গতকাল শনিবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদোলু। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত শুক্রবার ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের প্রসিকিউটর অফিস জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা ‘শত্রুর পক্ষ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ, রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা, মিথ্যা তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করার’ অভিযোগে অভিযুক্ত। ইরানের আধা-সরকারি নিউজ এজেন্সি ফার্স রাষ্ট্রপক্ষের বরাত দিয়ে জানায়, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সরাসরি যোগাযোগ থাকার প্রমাণ মিলেছে।
আগ্রাসন বন্ধ না হলে আলোচনা নয়- ইরান : ইসরায়েল সরকার ইরানের ওপর চালানো আক্রমণ বন্ধ না করা পর্যন্ত কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে না তেহরান। গত শুক্রবার জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকের পরে এমনটিই জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি। তিনি জানান, আলোচনার টেবিলে সমঝোতা চাইলে পূর্বশর্ত হিসেবে ইসরায়েল সরকারকে ইরানের ওপর তার অপরাধ এবং আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। আর তা না হওয়া পর্যন্ত ইরান কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবে না। একই সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ বলেও এই শীর্ষ কূটনীতিক পুনর্ব্যক্ত করেন। এছাড়াও আগামীতে এই তিন ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য ইরান প্রস্তুত আছে বলেও জানান আরাকচি। গত শুক্রবার ইউরোপে জাতিসংঘের কেন্দ্রস্থল জেনেভায় ইরান এবং ইউরোপের মধ্যে এ আলোচনা হয়। ই-থ্রি নামে পরিচিত এ আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান। যেখানে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ইরানের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসন এবং ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি। আলোচনায় আরাকচি স্পষ্ট জানিয়েছেন, অর্থপূর্ণভাবে কূটনীতি চালিয়ে যেতে চাইলে ইসরায়েলি আগ্রাসনের অবসান ঘটাতে হবে। এদিকে, ওআইসির সম্মেলনে যোগ দিতে তুরস্কে পৌঁছেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি। এই সম্মেলনে বিশ্বের ৪০ জনেরও বেশি পররাষ্ট্রমন্ত্রী অংশ নেবেন। এর আগে ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার প্রেক্ষাপটে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দুইবার ফোনালাপ করেছেন বলে জানা গেছে।
যুদ্ধে ৮৪ শতাংশ ইরানির সমর্থন : গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইআরআইবি জানিয়েছে, ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সমর্থন আছে ৮৪ শতাংশ ইরানির। ইসরায়েল-ইরান সংঘাত নিয়ে তেহরানের বাসিন্দারা কী ভাবছেন, তা নিয়ে জরিপ চালায় আইআরআইবি। পরে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান মোহসেন শাকেরি নেজাদ জানান, ৮৪ শতাংশ ইরানি ইসরায়েল সরকারের হামলার বিরুদ্ধে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে সমর্থন করেছে। জরিপে আরও দেখা গেছে, ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ৮৬ শতাংশ ইরানি তেহরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি জোরদার করার পক্ষে।
ইসরায়েলকে হামলা বন্ধ করতে বলবেন না ট্রাম্প : ইরানে ইসরায়েলি বিমান হামলা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ চেয়ে যখন ইউরোপীয় কূটনীতিকরা জোর আহ্বান জানাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি ইসরায়েলকে হামলা বন্ধ করতে বলবেন না। হামলা কমিয়ে আনা ও আলোচনার পথ খুলে দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপীয় নেতাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসরায়েলকে চাপ দেবেন কি না সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ইসরায়েল এখন জয়লাভ করছে এবং তারা খুব ভালো করছে। তাই জয়ী পক্ষকে এমন অবস্থায় কিছু বলা কঠিন। অর্থাৎ, তিনি ইরানে ইসরায়েলের চলমান হামলা বন্ধের জন্য কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। এই অবস্থায় অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের চালান নিয়ে আরও কয়েকটি পরিবহন উড়োজাহাজ বৃহস্পতিবার ইসরায়েলে পৌঁছেছে। এসব অস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি থেকে এসেছে বলে তুরস্কের সরকারি সংবাদমাধ্যম আনাদলু জানিয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইরানের হামলা শুরুর পর এ নিয়ে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ১৪টি কার্গো ইসরায়েলে পৌঁছেছে। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করার পর ৮০০ কার্গো এ ধরনের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ইসরায়েলে এসেছে।
শান্তির পথে প্রধান অন্তরায় নেতানিয়াহু সরকার- এরদোয়ান : ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) শীর্ষ সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকারই এই অঞ্চলের শান্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এরদোয়ান আরও বলেন, নেতানিয়াহু সরকার একের পর এক আক্রমণ ও উসকানিমূলক পদক্ষেপ নিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। এদিকে, ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে সংঘাত নিয়ে বৈঠক করেছেন আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। তুরস্কের সংবাদ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ২০ জুন সন্ধ্যায় ইস্তাম্বুলে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের আলোচ্য বিষয় ছিল ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ। এই বৈঠক হয়েছে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-এর শীর্ষ সম্মেলনের আগের রাতে।
ইরানে হামলায় এ পর্যন্ত নিহত ৪৩০ : ইসরায়েলের সঙ্গে গত ১৩ জুন সংঘাত শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ইরানে অন্তত ৪৩০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ মানুষ। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে স্থানীয় নূর নিউজ এজেন্সি হতাহতের হালনাগাদ এ তথ্য প্রকাশ করেছে। ইরানের পক্ষ থেকে গত কয়েকদিনের মধ্যে নিহতের সংখ্যা নিয়ে এই প্রথম সরকারি তথ্য প্রকাশ করা হলো। সর্বশেষ গত রোববার ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, ইসরায়েলি হামলায় দেশটিতে মোট ২২৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অধিকার সংগঠনের সংবাদমাধ্যম হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট নিউজ এজেন্সি বলেছে, নিহতের সংখ্যা ৬৫৭ জন।
আরেক ইরানি কমান্ডারকে হত্যার দাবি ইসরায়েলের : ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর আরেকজন কমান্ডারকে হত্যার দাবি করেছে ইসরায়েল। সামাজিকমাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে তাদের দাবি, ওই কমান্ডার ইরানের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের দিকে শত শত ড্রোন নিক্ষেপের দায়িত্বে ছিলেন। ইসরায়েলি সেনারা বলছেন, ওই কমান্ডারের নাম আমিন পউর জোধকি। তবে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে গত ১৩ জুন আইআরজিসি-র আরেক কমান্ডার তাহার ফুরকে হত্যার কথা জানায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, এরপর থেকে কমান্ডার আমিন ওই বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
ইস্পাহানে পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের হামলা : ইরানের ইস্পাহান শহরে পারমাণবিক স্থাপনায় গতকাল শনিবার ভোরে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমের বরাতে এ খবর জানিয়ে বিবিসি বলছে, ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা তাৎক্ষণিকভাবে এই হামলার জবাব দিয়েছে। এ কারণে ইস্পাহানে জোরে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইরানের ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, ইসরায়েলের এ হামলার ফলে ইস্পাহানে পারমাণবিক স্থাপনা থেকে কোনো বিপজ্জনক পদার্থ ছড়িয়ে পড়েনি। যদিও সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো তথ্য জানাতে পারেনি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। এদিকে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা রাতভর ইরানের মধ্যাঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত এবং স্থাপনায় ‘ধারাবাহিক হামলা’ চালিয়েছে।