ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল ও তার সহযোগী যুক্তরাষ্ট্র। স্বল্পস্থায়ী এ যুদ্ধে নেতানিয়াহু দুটি লক্ষ্য ছিল। এক. ইরানের পরমাণু কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়া। দুই. ইরানে শাসনব্যবস্থার বদল। কিন্তু ইরানের পরমাণু কর্মসূচি কি গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে? উত্তরটা হবে, না। এটা মনে হচ্ছে যে ফোর্দো পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর আগেই সেখান থেকে ফিউশনযোগ্য বা বিভাজ্য পদার্থ সরিয়ে নিয়েছিল। ইউরেনিয়ামের এ মজুতই ইরানের হাতে থাকা পারমাণবিক কর্মসূচির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যটি ব্যর্থ হয়েছে। তবে ইরানের কৌশগত ‘লাভ’ হয়েছে। যুদ্ধে নিজেদের ‘অপরাজেয়’ শক্তি হিসেবে প্রমাণ করতে সফল হয়েছে ইরান। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছে দেশটি। যুদ্ধের সমীকরণ অনুযায়ী, পরাজিত শক্তিই মূলত ‘সাদা পতাকা প্রদর্শন’ করে আত্মসমর্পণ করে বা যুদ্ধবিরতি চায়। কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের অবস্থাও তেমনই হয়েছে। অনেকটা তড়িঘড়ি করেই যুদ্ধবিরতির দিকে ধাবিত হয়েছেন ট্রাম্প।
শুধু তাই নয়, এতদিনের চড়া সুর নরম করতে যাচ্ছেন ট্রাম্প প্রশাসন। দেশটিকে আলোচনার টেবিলে আনতে একগাদা ছাড় দেবে ওয়াশিংটন। পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দেশটিকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা দিতে পারে। এছাড়া তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে দেশটি। পাশাপাশি জব্দ করা ফান্ডও ফিরিয়ে দেবে। বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত ৪টি সূত্রের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএন। সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত দুই সপ্তাহ ধরে ইরান-ইসরায়েলে সংঘাতের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়রা পর্দার আড়ালে ইরানিদের সঙ্গে কথা বলেছেন। যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পরও এ সপ্তাহে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
একটি খসড়া প্রস্তাবের কথা জানিয়ে দুটি সূত্র সিএনএনকে বলেছেন, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন যে তারা কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। এগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এখনো বিকাশমান। তবে একটি বিষয় নিয়ে তারা আপসহীন। সেটি হলো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ। ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শূন্যের কোটায় রাখতে হবে। তবে, ইরান বারবার বলেছে এটি তাদের প্রয়োজন। ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগের দিন অর্থাৎ, গত শুক্রবার হোয়াইট হাউজে বৈঠকে বসে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় অঞ্চলের মিত্ররা। ওই বৈঠকে থাকা দুটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। ওই বৈঠকে ইরান ইস্যুতে আলোচনা হয়। যদি ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করে তাহলে দেশটিতে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করা হবে, যা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপানে ব্যয় হবে। ট্রাম্প প্রশাসন ও সূত্র বিষয়টি সিএনএনকে জানিয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ইরানে সম্ভাব্য বিনিয়োগের এ অর্থ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে যাবে না। এর মানে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা এ বিনিয়োগ করতে পারে। গত মাসে পারমাণবিক ইস্যুতে হওয়া ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় বিনিয়োগের কথাটি বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘তেহরানের সঙ্গে আলোচনায় ওয়াশিংটন নেতৃত্ব দেবে। কেউ একজন ইরানের নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম পুনর্নির্মাণের জন্য অর্থ খরচ করবে। তবে, আমরা সেই প্রতিশ্রুতি দেব না।’ খসড়া অনুযায়ী, অন্যান্য প্রণোদনার মধ্যে রয়েছে ইরানের ওপর আরোপিত কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং তেহরানকে ছয় বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত অর্থ ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া, যা বর্তমানে বিদেশি ব্যাংক হিসাবগুলোতে জব্দ রয়েছে। বিষয়টির সঙ্গে সম্পৃক্ত দুটি সূত্র বলছে, গত সপ্তাহে আরেকটি ধারণা উত্থাপিত হয়, যা বর্তমানে বিবেচিত হচ্ছে। সেটি হলো, ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্রের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের উপসাগরীয় অঞ্চলের মিত্ররা অর্থায়ন করবে।
একটি সূত্র বলছে, ‘বিভিন্নজনের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ধারণা আসছে এবং সেগুলো নতুন।’ আরেকটি সূত্র বলছে, ‘ইরান প্রস্তাবনাগুলো মানবে কি না তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। গত বুধবার ইউটকফ সম্প্রচার মাধ্যম সিএনবিসিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একটি শান্তিপূর্ণ চুক্তি চাই। ট্রাম্প প্রশাসন চাচ্ছে, প্রস্তাবনার মাধ্যমে ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ থেকে সরিয়ে আনতে।’ যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম রয়েছে এবং তা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। তবে তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে না। ইরান ইউরেনিয়াম আমদানি করতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছে ওয়াশিংটন। ইউটকফ সিএনবিসিকে বলেন, ‘এখন ইরানের সঙ্গে আলোচনার বিষয় হচ্ছে, কীভাবে তাদের জন্য একটি উন্নততর বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি গঠন করা যায়, যা হবে অসমৃদ্ধিকরণযোগ্য।’ মার্কিন প্রশাসনের সামনে ইরানকে একটি চুক্তির খসড়া উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে পারে। গত বুধবার ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান আগামী সপ্তাহে আলোচনায় বসবে।’ যদিও ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এসমাইল বাঘাই আগামী সপ্তাহে কোনো আলোচনার ব্যাপারে জানেন না বলেই উল্লেখ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়নি ইরান : এদিকে ইরান জানিয়েছে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা শুরু করার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। গত বৃহস্পতিবার ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি এ কথা বলেন। খবর বার্তা সংস্থা আনাদোলুর। আরাগচি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানে ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন করে, আবার পরে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসারি বোমা হামলা চালায় তখনও ওয়াশিংটন তেহরানের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত ছিল। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক আলোচনায় তারা আমাদের জাতির অধিকার ত্যাগ করার জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিল। যখন কিছু নির্দিষ্ট ঘটনা ঘটে, তখন তারা যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় এবং অপরাধী ইহুদিবাদী (ইসরায়েল) শাসনব্যবস্থাকে আক্রমণ চালানোর জন্য ছেড়ে দেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলোচনার সময় যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই অভিজ্ঞতা পরমাণু আলোচনার বিষয়ে ইরানকে ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।’ ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তবুও কূটনীতি অব্যাহত রয়েছে এবং আমি বেশ কয়েকজন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’ আগামী সপ্তাহে ইরানের সঙ্গে পরিকল্পিত বৈঠকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন আরাগচি। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরোক্ষ আলোচনার কোনো সুযোগ নেই। তাদের বক্তব্য পরস্পরবিরোধী।’ গত ১৩ জুন ইরানের সামরিক, পারমাণবিক ও বেসামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা শুরু করে ইরান। যা পরবর্তীতে তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যে ১২ দিনের সংঘর্ষে রুপ নেয়। এতে কমপক্ষে ৬০৬ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৩৩২ জন আহত হন বলে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তেহরান ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। যার ফলে কমপক্ষে ২৯ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গত ২৪ জুন থেকে এই সংঘাত থেমে যায়।
পরিকল্পনা থাকলেও খামেনিকে হত্যার সুযোগ পায়নি ইসরায়েল : ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ দাবি করেছেন, যুদ্ধে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল ইসরায়েলের, তবে সেই সুযোগ তারা পাননি। গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল ১৩-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাৎজ এ কথা জানান। তিনি বলেন, আমরা খামেনিকে নির্মূল করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু কোনো কার্যকরী সুযোগ ছিল না। সাক্ষাৎকারে আরও প্রশ্ন করা হয়, এমন একটি হামলার জন্য কি যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন ছিল? এর জবাবে কাৎজ বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতির প্রয়োজন হয় না।’ এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন খামেনি। ভাষণে তিনি বলেন, ‘ভুয়া ইহুদিবাদী সরকারকে আমরা যুদ্ধে পরাজিত করেছি।’ এছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ইরান তাদের মুখে থাপ্পড় মেরেছে।’ ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর খামেনি নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই তিনি এ বক্তব্য দিয়েছেন।
ইরানকে ফাঁসাতে যুক্তরাষ্ট্রে হামলা, ইসরায়েলের ‘ষড়যন্ত্র’ ফাঁস : এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বোমা হামলা চালানো এবং এর জন্য ইরানকে ফাঁসানোর একটি পরিকল্পনা (ষড়যন্ত্র) করেছিল ইসরায়েল। আর এই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল- যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করা। এমনই এক ভয়ঙ্কর দাবি করেছে ইরানি সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস। তাদের হাতে এ সংক্রান্ত তথ্য এসেছে বলেও দাবি করেছে সংবাদ মাধ্যমটি। তেহরান টাইমস বলছে, পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটানো এবং এতে ইরান জড়িত তা প্রমাণ করা। যাতে মার্কিন জনমতকে কাজে লাগানো এবং ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্ররোচনা দেওয়া যায়।
ইরানি কর্তৃপক্ষ তার এক বন্ধু রাষ্ট্রের কাছ থেকে এমন ভয়ঙ্কর তথ্য পেয়ে ইসরায়েলি ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করেছে দাবি করে সংবাদমাধ্যমটি জানায়, সম্ভাব্য আক্রমণ সম্পর্কে জানতে পেরে ইরান মার্কিন কর্মকর্তাদের কাছে বার্তা পাঠায় এবং পরিকল্পিত বিস্ফোরণটি ঘটতে বাধা দেয়।
উল্লেখ্য, গত ১৩ জুন বিনা উসকানিতেই ইরানের বিভিন্ন সামরিক, পারমাণবিক ও বেসামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা শুরু করে ইরান। যা পরবর্তীতে তেহরান ও তেলআবিবের মধ্যে ১২ দিনের সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে কমপক্ষে ৬০৬ জন নিহত এবং ৫ হাজার ৩৩২ জন আহত হন বলে জানিয়েছে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জবাবে তেহরান ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। যার ফলে কমপক্ষে ২৯ জন নিহত এবং ৩ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। দু’সপ্তাহের এ যুদ্ধে ইরানকে সমর্থন জানায় পাকিস্তান। পরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গত ২৪ জুন থেকে এই সংঘাত থেমে যায়।
ইরান পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে পরিস্থিতি ‘সবচেয়ে খারাপ’ হবে- ম্যাক্রোঁ : তেহরান যদি বিশ্বব্যাপী পরমাণু বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, তবে ‘সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি’ হবে বলে জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন হামলা ‘সত্যিকার অর্থেই কার্যকর’ ছিল। ব্রাসেলস থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে। ব্রাসেলসে ইইউ শীর্ষ সম্মেলনের পর সাংবাদিকদের ম্যাক্রোঁ বলেন, ইরানের পরমাণু বিস্তার রোধ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া হবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি। চুক্তিটি বজায় রাখার জন্য ও পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার সীমিত করার উদ্দেশ্যে তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের সঙ্গেও কথা বলবেন।
গত বৃহস্পতিবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক ফোনালাপের মাধ্যমে এরমধ্যেই এই আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনায় ম্যাক্রোঁ জানান, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেকে গত কয়েক দিন ধরে তেহরানের সঙ্গে প্যারিসের যোগাযোগের কথা জানিয়েছেন। ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘আমাদের আশা, দৃষ্টিভঙ্গির সত্যিকারের মিলন ঘটবে, লক্ষ্য ছিল ইরান কর্তৃক ‘পুনরায় পারমাণবিক নির্মাণের কোনও প্রচেষ্টা’ না করা। ইরান ১৯৭০ সালে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) অনুমোদন করে এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার কাছে তার পারমাণবিক উপাদান ঘোষণা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু সম্প্রতি তারা চুক্তি থেকে সম্ভাব্য প্রত্যাহারের জন্য ভিত্তি প্রস্তুত করতে শুরু করেছে। সংস্থাটিকে ইসরায়েলের ‘আগ্রাসন যুদ্ধে’ ‘অংশীদার’ হিসেবে কাজ করার অভিযোগ এনেছে।
মার্কিন বি-২ বোমারু বিমান গত সপ্তাহান্তে বিশাল জিবিইউ-৫৭ বাঙ্কার-বাস্টার বোমা দিয়ে দুটি ইরানি পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত করেছে, যখন একটি গাইডেড মিসাইল সাবমেরিন টমাহক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে তৃতীয় স্থানে আঘাত করেছে। ট্রাম্প নিজেই এই হামলাগুলোকে ‘চমৎকার সামরিক সাফল্য’ বলে অভিহিত করেছেন এবং বারবার বলেছেন যে, তারা পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করেছে। কিন্তু মার্কিন সংবাদমাধ্যম এই সপ্তাহের শুরুতে একটি প্রাথমিক আমেরিকার গোয়েন্দা মূল্যায়ন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, এই হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে শুধু কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পিট হেগসেথ ও অন্যরা এই প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের সাথে আলোচনায় আমেরিকা : ‘ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে টেকসই শান্তি’ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের মধ্যে এই আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এসময় পাকিস্তান সবসময় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ। গতকাল শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বৃহস্পতিবার এক ফোনালাপে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর।
এর আগে চলতি সপ্তাহের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ থামাতে একটি যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। গত ১৩ জুন ইসরায়েলের ইরানে হামলার মাধ্যমে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এর আগে ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে ইরান নিয়ে আলোচনা হয়। ট্রাম্প সেসময় বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান ইরান সম্পর্কে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ভালো জানে।’ মূলত যুক্তরাষ্ট্রে ইরানের কোনো দূতাবাস না থাকায় ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের দূতাবাসের একটি অংশ ইরানের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয় : ‘দুই নেতা ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় একসঙ্গে কাজ করার গুরুত্ব তুলে ধরেন।’ এতে আরও বলা হয়: ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুবিও জোর দিয়ে বলেন, ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি বা অর্জন করতে পারবে না।’ অন্যদিকে পাকিস্তান সরকারের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনকল গ্রহণ করেন। বিবৃতিতে বলা হয়: ‘ফোনালাপে প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েল-ইরানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাহসী ও ফলপ্রসূ নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।’ মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়ের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সবসময় মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। রুবিওও পাকিস্তানের এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন এবং বলেন, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায়।
প্রসঙ্গত, ইসরায়েল-ইরান সংঘাত এমন সময় শুরু হয় যখন ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের কারণে পুরো অঞ্চল আগে থেকেই উত্তপ্ত হয়ে আছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই গত সপ্তাহান্তে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায় এবং এর জবাবে সোমবার ইরান কাতারে একটি মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এরপরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। পাকিস্তান অবশ্য ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ইরানবিরোধী হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। তবে একই সঙ্গে ইসলামাবাদ চলতি মাসে এক বিবৃতিতে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চার দিনের যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্পের ভূমিকার জন্য তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে।
ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের জন্য দুঃস্বপ্ন : দখলদার ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইরানের গৌরবময় বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথি আনাসারুল্লাহ। সংগঠনটির নেতা আব্দুল-মালিক আল-হুথি বলেছেন, ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইহুদিবাদী সত্তার (ইসরায়েল) জন্য এক চরম দুঃস্বপ্ন।’ গত বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানী সানা থেকে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক ভাষণে আল-হুথি বলেন, ‘ইরানের বিজয় সমগ্র মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি বিজয়।’ তিনি বলেন, ‘আগ্রাসী, নিপীড়ক ও অপরাধী ইসরায়েলি শত্রুর বিরুদ্ধে ইরানের মহান বিজয়ের জন্য আমরা ইরানকে অভিনন্দন জানাই। ইরানের ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য আমরা মুসলমানদের অভিনন্দন জানাই। এ বিজয় সমগ্র ইসলামী বিশ্বকে উপকৃত করেছে।’ ‘ইরানের কাছে ইহুদিবাদী শত্রু ও তার অপরাধী মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি এবং ফ্রান্স যে পরাজয় বরণ করেছে, তা সমগ্র মুসলিম উম্মাহর (জাতি) জন্য একটি বিজয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক দশক ধরে ইসলামী বিশ্ব শত্রুদের দ্বারা সৃষ্ট সংকটে জর্জরিত। আল্লাহর সৃষ্টি ও কর্তৃত্ব সবকিছুর ওপরে এবং মুসলিমরা এই অকাট্য সত্যের ওপর নির্ভর করে তাদের চ্যালেঞ্জ এবং বিপদগুলো কাটিয়ে ওঠে।’ মার্কিন সহায়তায় ইরানে হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলিদের প্রস্তুতি দীর্ঘ সময়ের বর্ণনা করে হুথি প্রধান বলেন, ‘যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে তেলআবিব সরকারের এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।‘ আব্দুল মালিক আল-হুথি অন্যান্য মুসলিম সরকার এবং দেশের তুলনায় ইরানের পারমাণবিক, সামরিক এবং আবাসিক স্থাপনাগুলোতে হামলার পাকিস্তানের নিন্দাকে ‘একটি অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ এবং চমৎকার প্রতিক্রিয়া’ বলেও প্রশংসা করেন।
তিনি ইসরায়েলি বিমান হামলার প্রতি তুরস্কের তীব্র নিন্দাকে ‘একটি স্পষ্ট, সুস্পষ্ট এবং সুপরিচিত আচরণ’ বলেও প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শত্রুরা নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি, বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরায়েলি শত্রুদের জন্য এক চরম দুঃস্বপ্ন ছিল এবং এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় ইসরায়েলিরা ভয়াবহ আতঙ্ক ও ভয়ের মধ্যে বাস করছিল এবং বোমা আশ্রয়কেন্দ্রে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল।’
খামেনির প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করল হিজবুল্লাহ : অবশেষে থেমেছে ইসরায়েল-ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণঘাতী সংঘাত। ১২ দিনের এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো মিডিয়ার সামনে আসেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। আর এর ঠিক কয়েক ঘণ্টা পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতার প্রতি আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করে ইরানের বিজয় উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছেন হিজবুল্লাহ নেতা নাইম কাসেম। ইরানে ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা শুরু করার সময় থেকেই তেহরানকে সমর্থন জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ। এবার সেটা আবারও পুনর্ব্যক্ত করল সংগঠনটি।
এক ভিডিও বার্তায় কাসেম বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত করছি এবং গর্বিত যে আমরা ইরানের সঙ্গে আছি। আমরা ইমাম খামেনির তত্ত্বাবধানে আছি।’ কাসেম আরও বলেন, ‘ইরানের নেতৃত্ব ও শাসনব্যবস্থার চারপাশে অভূতপূর্ব জনমত এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশকে রক্ষা করার জন্য ইমাম খামেনির চারপাশে সমাবেশ করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, খামেনি একজন সাহসী, জ্ঞানী এবং অনুপ্রেরণাদায়ক নেতা। যিনি সবক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে থেকে লড়াই করেন। তিনি শুধু স্রষ্টার ভয়ে ভীত এবং বিজয়ের প্রতি আত্মবিশ্বাসী।’
জার্মান চ্যান্সেলর ইতিহাসের ভুল দিকে অবস্থান নিয়েছেন : ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, দখলদার ও খুনি ইসরায়েলের প্রতি জার্মান চ্যান্সেলরের সমর্থন ঘোষণার অর্থ হলো তিনি শুধু ইতিহাসের বিবেক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেননি বরং জার্মান জাতির সম্মিলিত বিবেককেও অসম্মান করেছেন। ইরনার বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকায়ি গতকাল শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে গণহত্যাকারী ইসরায়েলের প্রতি জার্মান চ্যান্সেলরের সমর্থন সম্পর্কে লিখেছেন, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেয়ার্জ গণহত্যাকারী অপরাধী ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে নিজেকে ইতিহাসের ভুল দিকটিকে বেছে নিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, দেশের শীর্ষ নেতার পক্ষ থেকে আগ্রাসী শক্তির প্রতি সমর্থন প্রদান এবং আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘনকে উপেক্ষা করা মেনে নেওয়া যায় না। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জার্মান চ্যান্সেলর মারাত্মক অপরাধকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাকায়ি বলেন- ইরান কখনই এ কথা ভুলবে না যে, সাদ্দাম সরকারকে রাসায়নিক অস্ত্র কে দিয়েছিল। একই সঙ্গে যারা গতকাল আক্রমণকারীকে সমর্থন করছে তাদেরকেও ক্ষমা করবে না ইরান।