ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫, ২৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ইরানের সঙ্গে সংঘাতে ‘অকল্পনীয়’ আর্থিক ক্ষতি ইসরায়েলের

ইরানের সঙ্গে সংঘাতে ‘অকল্পনীয়’ আর্থিক ক্ষতি ইসরায়েলের

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক সংঘাত আপাতত থেমেছে। তবে যে লক্ষ্য নিয়ে দখলদার ইসরায়েল ইরানে আগ্রাসন চালিয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। বরং বিপুল পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছে ইহুদিবাদী দেশটি। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইরানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ইসরায়েলের আনুমানিক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির এ তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে এক প্রতিবেদনে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, ইসরায়েলি সরকার অনুমান করেছে যে, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন বলছে, ইরান প্রায় দুই সপ্তাহের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিল। যার ফলে ইসরায়েলি অবকাঠামোর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

গত ১৩ জুন ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে এবং ১২ দিন ধরে তেহরানের সামরিক, পারমাণবিক এবং আবাসিক এলাকায় আক্রমন করে। ইসরায়েলের সমর্থনে গত ২২ জুন যুক্তরাষ্ট্র নাতানজ, ফোর্দো এবং ইসফাহানে-তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। গত ১৩ জুন ইসরায়েলের হামলার পরপরই ইরানের সামরিক বাহিনী শক্তিশালী পাল্টা হামলা চালায়। ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ডস কর্পস অ্যারোস্পেস ফোর্স অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি-এর অংশ হিসেবে ইহুদিবাদী সরকারের (ইসরায়েল) বিরুদ্ধে ২২টি প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যার ফলে ইসরায়েলি শহরগুলোতে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর ২৪ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় দুদেশের মধ্যে ১২ দিন ধরে চলা যুদ্ধের বিরতি হয়।

১২ পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে পারে ইরান : ইরানের কাছে বর্তমানে প্রায় ১২টি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে, তবে দেশটি এখনও কোনো বোমা তৈরি করেনি বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি। গত বৃহস্পতিবার ফ্রান্স ইন্টার রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্রোসি বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেগুলো এখনও কার্যকর রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়ে গেছে-এমন দাবি সঠিক নয়।’ তিনি নিশ্চিত করেছেন, ফোর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে থাকা সেন্ট্রিফিউজগুলো অকেজো হয়ে গেছে, তবে অন্যান্য স্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাতে রাজি হননি। গ্রোসি আরও বলেন, ইরানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাটির সম্পর্কে টানাপোড়েন বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘ইরান এখন এজেন্সির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দুপক্ষের মধ্যে স্পষ্ট উত্তেজনা রয়েছে।’ গত ২৫ জুন ইরানের পার্লামেন্ট একটি বিল পাস করেছে। এতে আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার পথ তৈরি করেছে। এ বিল গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। এটি আইএইএর পরিদর্শনের জন্য সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করবে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি অনুযায়ী, ইরান কেবল ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে তারা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশের একেবারে কাছাকাছি। এর আগে আইএইএ জানিয়েছিল, ইরান চুক্তির শর্ত মানছে না।

ট্রাম্পের খামেনিকে অসম্মান করা বন্ধ করতে হবে : যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরমাণু চুক্তি চান, তাহলে তার ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে নিয়ে অসম্মানজনক এবং অগ্রহণযোগ্য কথা বলা থেকে দূরে থাকা উচিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে এমনটাই লিখেছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। খবর বার্তা সংস্থা মেহেরের। এক্সে আরাগচি লেখেন, ‘ইরানিদের দৃঢ়তা ও জটিলতা বিশ্বের কাছে সুপরিচিত, যা কঠোর পরিশ্রম এবং ধৈর্যের ফল। কিন্তু একটি জাতি হিসেবে, আমাদের মূল ধারণা খুবই সহজ এবং সরল: আমরা আমাদের মূল্য জানি, আমাদের স্বাধীনতাকে মূল্য দেই এবং অন্য কাউকে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে দেই না।’

তিনি লেখেন, ‘যদি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পরমাণু চুক্তির ব্যপারে আগ্রহী হন, তাহলে তার ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির প্রতি অসম্মানজনক এবং অগ্রহণযোগ্য কথা বলা থেকে দূরে থাকা এবং তার লক্ষ লক্ষ হৃদয়বান অনুসারীদের আঘাত করা বন্ধ করা উচিত।’ তিনি আরও লেখেন, ‘শক্তিশালী ইরানি জনগণ বিশ্বকে দেখিয়েছে যে, আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধ্বংস এড়াতে ইসরায়েলের ‘বাবার’ কাছে ছুটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তারা হুমকি এবং অপমানকে সদয়ভাবে গ্রহণ করেন না। যদি তাদের ভ্রম তাদেরকে ভুল দিকে পরিচালিত করে, তাহলে ইরান তার আসল ক্ষমতা উন্মোচন করতে দ্বিধা করবে না আর তা ইরানের শক্তি সম্পর্কে যেকোনো বিভ্রান্তির অবসান ঘটাবে।’

ইরানে ইসরায়েল-আমেরিকার আগ্রাসনে শহিদদের জানাজা অনুষ্ঠানে জনতার ঢল : ইহুদিবাদী ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ দিনের সামরিক আগ্রাসনে শহিদদের স্মরণে ইরানের রাজধানী তেহরানে রাষ্ট্রীয়ভাবে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তেহরান সময় গতকাল শনিবার সকাল ৮টায় এই বিশাল জানাজা শুরু হয় শহরের কেন্দ্রস্থল ইনকেলাব চত্বরে যা ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আজাদি স্কয়ার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই জানাজায় ৬০ জন পরমাণু বিজ্ঞানী, সামরিক কমান্ডার ও বেসামরিক নাগরিকের কফিন স্থান পায়। শহিদদের কফিন ইরানের জাতীয় পতাকায় মোড়ানো ছিল এবং অনেকের ছবি ও সামরিক পোশাক সংবলিত ব্যানারও প্রদর্শিত হয়। জানাজায় অংশ দেন ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, আইআরজিসির কুদস ফোর্সের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল কায়ানি এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা।

বিপুলসংখ্যক শোকসন্তপ্ত জনতা কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে ‘ইসরায়েল ধ্বংস হোক’, ‘আমেরিকা ধ্বংস হোক’- স্লোগান দেন এবং নানা প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড বহন করেন। একটি ব্যানারে লেখা ছিল: “বুম বুম তেল আবিব”-যা ইরানের পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ইঙ্গিত দেয়। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাকায়ি জানাজায় অংশ নিয়ে ‘শহিদদের প্রতি ইরানি জাতির অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও অশ্রুসিক্ত ভালোবাসা’ তুলে ধরেন। পরে এক এক্স (টুইটার) বার্তায় তিনি লিখেন, ‘আজ (শনিবার) ইরানের দেশপ্রেমী জনতা তাদের সবচেয়ে নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক সন্তানদের-কমান্ডার, বুদ্ধিজীবী, ক্রীড়াবিদ, নারী ও শিশুদের-কাঁধে তুলে নিয়েছে। আজ ইরানের সাহসী জনগণ, তাদের এক একটি পবিত্র দেহকে বীরের মতো শ্রদ্ধার সাথে মাতৃভূমির মাটিতে সমাহিত করছে।’ তেহরান ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল-এর প্রধান মোহসেন মাহমুদি এই দিনটিকে ‘ইসলামি ইরান ও বিপ্লবের ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। শহিদদের মধ্যে রয়েছেন- ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাকেরি-যিনি তার স্ত্রী ও সাংবাদিক কন্যাসহ তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় শহিদ হন। পরমাণু বিজ্ঞানী ড. মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি ও তার স্ত্রী, আইআরজিসির প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি এবং আরও অন্তত ৩০ জন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও ৪ শিশু। ইরানি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১২ দিনের এই আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৬০০-রও বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।

এই বিশাল জানাজা অনুষ্ঠিত হলো মহাররম মাসের দ্বিতীয় দিনে যে মাসে কারবালার বীর শহিদ ইমাম হোসেইন (আ.) ও তার সাথীদের স্মরণ করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বাকায়ি বলেন: ‘ইরানিরা প্রমাণ করেছে, তারা ইমাম হোসেইনের জাতি-যারা সত্য-মিথ্যার যুদ্ধে ঈমান, ধৈর্য ও জাতীয় ঐক্যের শক্তিতে যেকোনো শত্রুকে পরাজিত করতে সক্ষম।’

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার ভূমিকা নিয়ে ইরানের প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে (আইএইএ) অসহযোগিতা করার যে অবস্থান নিয়েছে ইরান, এতে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির ?স্বচ্ছতার প্রশ্নে উদ্বেগ বাড়তে পারে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে, বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা রক্ষায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) কতটা ভূমিকা রাখছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইরান তাদের অসহযোগিতার অবস্থানের পেছনে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের বিরুদ্ধে যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার অভিযোগ করেছে। খবর বিবিসি বাংলা। সম্প্রতি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। দেশটির পার্লমেন্টই অভিযোগ করেছে। ইরানের পার্লামেন্ট এমন অভিযোগও বলেছে যে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

কী কাজ করে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা? : প্রায় সাত দশকের পুরোনো আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বিশ্বে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করতে কাজ করে থাকে। একইসঙ্গে সংস্থাটির কাজের মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার রোধ করা। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে এবং এটি জাতিসংঘের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। সংস্থাটি এর সদস্য দেশগুলোয় পারমাণবিক স্থাপনা এবং উপকরণগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে সহায়তা করে। সে ক্ষেত্রে তারা পারমাণবিক নিরাপত্তা বিষয়ক মান ও গাইড লাইন তৈরি করে। এছাড়াও, আইএইএ পারমাণবিক প্রযুক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য সদস্য দেশগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তাও প্রদান করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১৫ সালে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন এবং রাশিয়া, অর্থাৎ পি ফাইভ প্লাস ওয়ান নামে পরিচিত পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে ইরান। এর ভিত্তিতে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিল আইএইএ।

এরপর ২০১৭ সালে ট্রাম্প প্রথবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৮ সালে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল করা হয়। এরপর থেকে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রমের গতি বাড়ায় এবং ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে থাকে। আইএইএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরান প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি। সাধারণত ৯০ শতাংশের বেশি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে এমন অভিযোগে দেশটির পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করে গত ১৩ই জুন হামলা চালায় ইসরায়েল। এই ঘটনায় ইরানও পাল্টা হামলা চালালে দুই দেশের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। বিবাদমান দুই দেশের পাল্টাপাল্টি হামলার দশ দিনের মাথায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করে ‘সুনির্দিষ্ট’ সামরিক অভিযান চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যাতে ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

ইরানের নতুন পারমাণবিক স্থাপনার তথ্য অজানা : এদিকে পারমাণবিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স বলফ্রাস বিবিসিকে বলেন, ইরানে ইসরায়েল হামলা চালানোর আগে, গত ১২ জুন ইরান আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাকে জানিয়েছিল যে, তারা একটি নতুন পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে, যেটি বেশ সুরক্ষিত এবং যেখানে তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে। অ্যালেক্স বলেন, আমরা যতটুকু জানি ওই স্থাপনা কোথায়- তা প্রকাশ করা হয়নি, হয়তো আমেরিকান বা ইসরাইলিরাও জানে না। সম্ভবত তারা ইউরেনিয়ামগুলো ওখানে সরিয়ে ফেলতে পারে। হামলার তিন দিনের মাথায় বুধবার পেন্টাগনের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ ধ্বংস হয়নি। এতে বলা হচ্ছে, ইরানের সেন্ট্রিফিউজগুলো প্রায় অক্ষত রয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি মূলত স্থলভাগের অবকাঠামোতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এছাড়া ইরানের দুটি পারমাণবিক স্থাপনার প্রবেশপথ বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছু অবকাঠামো ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, ভূগর্ভস্থ মূল স্থাপনাগুলো অনেকটাই অক্ষত রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোয়েন্দা সূত্র মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোকে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে মাত্র, সর্বোচ্চ এইটুকুই। যদিও এটিকে ভুয়া খবর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের এই দাবির পর, সিআইএ প্রধানও বলেন, তারা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ‘সেন্ট্রিফিউজ’ এর ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছেন।

ইরানের অসহযোগিতার সিদ্ধান্ত, যুক্তি কী? : ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম কেমন চলছে, তা তদারকি করতো আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা। ফোর্দো ও নাতাঞ্জ-এর পারমাণবিক স্থাপনায় নজরদারী বাড়ানোর জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং আইএইএকে তা সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে দিতে ইরানকে বলেছিল সংস্থাটি। ইসরায়েলি ও মার্কিন হামলার পর গত বুধবার ইরানি পার্লামেন্ট সদস্যরা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এর আগে, ইরানি পার্লামেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি কমিশন এর খসড়া অনুমোদন করে যাতে সরকারকে আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে বলা হয়। ইরানের ওই কমিশন আইএইএ এর প্রতিবেদনকে ইরানের ওপর হামলার অজুহাত বলে অভিহিত করে। আসহযোগিতার পরিকল্পনা অনুযায়ী, নিরীক্ষণ ক্যামেরা স্থাপন, পরিদর্শন এবং সংস্থায় রিপোর্ট প্রদান এর মতো কার্যক্রম স্থগিত থাকবে, যদি না ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এছাড়া ইরানের ইসলামি এডভাইজরি কাউন্সিলের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ বলেন, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় না, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি এবং একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। যদিও আইএইএ’র সর্বশেষ প্রতিবেদনে, ইরানকে অসহযোগিতার জন্য সমালোচনা করা হয়েছে। সংস্থাটি ইরানকে অঘোষিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেছিল এবং ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন : ইরানে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান ইসরাইলকে সতর্ক করে বলেছিলেন, কোনো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। জেনেভা কনভেনশনের ৫৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো দেশের পারমাণবিক স্থাপনার উপর হামলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আণবিক শক্তি সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা আছে, যদি কোনো দেশ এই আইন লঙ্ঘন করে, তাহলে তারা আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে পারে। এর অর্থ হলো, জেনেভা কনভেনশন যুদ্ধের সময় দেশগুলোকে তাদের কর্মের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনতে সহায়তা করে। এদিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে পর্যবেক্ষক দেশগুলোও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘে পাকিস্তানে স্থায়ী প্রতিনিধি অসীম ইফতেখার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার তত্ত্বাবধানে থাকা পারমাণবিক স্থাপনায় এই ধরনের হামলা আইএইএ, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুচ্ছেদ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অন্যদিকে জাতিসংঘে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি বারবারা উডওয়ার্ড নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে বলেন, আমাদের জানানো হয়েছিলো যে, ইরান কোনো ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না, আমরা এখনও চাই তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা করে এটার মিমাংসা হোক।

অন্যদিকে, ইরান আইএইএ-কে সহযোগিতা স্থগিত করা নিয়ে ইরানের পার্লামেন্টের নেওয়া সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাশিয়া। গত বুধবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে হামলাই দেশটিকে জাতিসংঘের আনবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ-এর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে বাধ্য করেছে। তিনি বলেন, বিনা উসকানিতে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় নজিরবিহীন হামলার সরাসরি পরিণতি হলো এমন সিদ্ধান্ত। এমন পরিস্থিতিতে আইএইএ-র সুনাম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেজন্যই এ পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

ইরানে ফিরতে চান জাতিসংঘ পরিদর্শকরা : ইরানের এমন সিদ্ধান্তের পরেও জাতিসংঘের আনবিক শক্তি সংস্থা বা আইএইএ প্রধান রাফায়েল গ্রসি বলেছেন, তার সংস্থার পরিদর্শকরা ইরানে ফেরত গিয়ে দেশটির সঙ্গে কাজ শুরু করতে চান। তিনি বলেন, এখন তার অগ্রাধিকার হলো ইরানে ফেরত যাওয়া। তবে তিনি এও বলেছেন যে বিষয়টি খুব একটা সহজ হবে না। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি শুধু কয়েক মাসের জন্য পিছিয়েছে এমন খবরের বিষয়ে তিনি বলেন, এই দৃষ্টিভঙ্গী আমি পছন্দ করি না, এটি দর্শকের চোখে দেখা, পরমাণু প্রযুক্তি সেখানে আছে। কারিগরি সক্ষমতাও সেখানে আছে। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। গ্রসি বলেন, এখন কূটনৈতিক সমাধানের একটি সুযোগ আছে। আমাদের সেই সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না। এটা দুই নাকি তিন মাসের জন্য, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের দরকার হলো সমাধান।

ইরান এখন কী করবে? : আমেরিকার গণমাধ্যমে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে ইরানে হামলার যে প্রাথমিক পর্যালোচনা রিপোর্ট এসেছে, সেটি সত্যি হলে ইরান এরপর কী করতে যাচ্ছে- তা নিয়ে প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি করবে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বিলম্বিত করার পরিবর্তে যতটা ক্ষতি হয়েছে, সেই ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার মেরামত ও হত্যার শিকার হওয়া বিজ্ঞানীদের জায়গায় নতুন বিজ্ঞানীদের নিয়ে আসার পর- এটা আরও গতি পাবে? এমন প্রশ্ন কিন্তু এখন উঠতেই পারে। হামলায় ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে সময় লাগবে।

একই সঙ্গে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে বলে ইসরায়েল যে দাবি করছিল, তা নিয়েও বিতর্ক চলতে থাকবে। ইরানের কর্মকর্তারা এরইমধ্যে বলেছেন যে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, ইরানের আর কখনওই পরমাণু কর্মসূচি থাকবে না। জেরুজালেম থেকে বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সংবাদতাতা হুগো বাগেচা লিখেছেন, ইরানের নেতারা জানেন যে এ ধরনের অস্ত্র থাকাটাই হবে ভবিষ্যত হামলা থেকে তাদের সুরক্ষা। ইরানের পার্লামেন্ট আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করার পরিকল্পনা সংক্রান্ত একটি বিল অনুমোদন করেছেন। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো প্রতিনিধি ভোট দেননি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত