ঢাকা বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬ পৌষ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

নিভে গেল আশার বাতিঘর

নিভে গেল আশার বাতিঘর

নিভে গেল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র, আশার বাতিঘর, আপসহীন উপাধিতে ভূষিত চিরসংগ্রামী ও খাঁটি দেশপ্রেমিক কিংবদন্তিতুল্য নেত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পার্থিব জীবন। গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে দেশি-বিদেশি চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আপসহীন নেত্রী মাদার অব ডেমোক্রেসি বেগম খালেদা জিয়া ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বেগম খালেদা জিয়ার এই মৃত্যুর খবর ভোরের কনকনে শীত আর কুয়াশা ভেদ করেই ছড়িয়ে পরে বিদ্যুতের গতিতে। মানুষ যে যেখানে ছিল, সেখানেই যেন দাঁড়িয়ে যায়, থেমে যায় সব কোলাহাল। হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে ওঠে কান্নার রোল। শোকে মূহ্যমান হয়ে উঠে পুরো বাংলাদেশ। গতকাল আর দশটা দিনের মতো ছিল না রাজধানীর বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতাল এলাকা। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে হাসপাতালের সামনে জড়ো হতে থাকেন হাজারও মানুষ। নেতাকর্মী, সমর্থক, সাধারণ মানুষ সবাই মিলিয়ে জায়গাটি পরিণত হয় শোক, নীরবতা ও আবেগের এক প্রাঙ্গণে। হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের চোখেমুখে ছিল গভীর শোকের ছায়া। কেউ চুপচাপ দাঁড়িয়ে, কেউ চোখ মুছছেন, কেউ আবার দুই হাত তুলে দোয়া করছেন। ভিড়ের মধ্যে কোথাও কান্নার শব্দ, কোথাও দীর্ঘশ্বাস- সব মিলিয়ে এক ভারী আবহ। সাবেক তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যুতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ৭ দিনের শোক ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আজ সাধারণ ছুটিসহ ঘোষণা করা হয়েছে তিনদিনের জাতীয় শোক। বেগম খালেদা জিয়াকে যথাযোগ্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করতে সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা আজ বুধবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজাসংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে দুপুর ২টায় অনুষ্ঠিত হবে। দুপুর সাড়ে ৩টায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হবে শেরেবাংলা নগরে জিয়া উদ্যানে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারের পাশে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘আপসহীন নেত্রী’ অভিধা পাওয়া বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন ৪৩ বছর। তিনি পাঁচবারের সংসদ সদস্য, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী; আর বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন দুইবার। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে নাম লেখানো বেগম খালেদা জিয়ার চার দশকের রাজনৈতিক জীবনের বড় সময় কেটেছে রাজপথের আন্দোলনে। তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, জেল খেটেছেন; তবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কখনও তিনি হারেননি।

লিভার সংক্রান্ত জটিলতা, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিস ও ইনফেকশনজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। গত ২৩ নভেম্বর থেকে তিনি বসুন্ধরায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে তার বড় ছেলে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং পরিবারের সদস্যারা গত সোমবার দিবাগত গভীর রাতে হাসপাতালে ছুটে যান। রাত ২টার পর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন হাসপাতালের সামনে এসে সাংবাদিকদের বলেন, বেগম খালেদা জিয়া ‘অত্যন্ত সংকটকময়’ সময় অতিক্রম করছেন। উনার পরিবারের পক্ষ থেকে উনার সুস্থতার জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে দেশবাসীকে দোয়া করার আহ্বান জানাচ্ছি। এর কয়েক ঘণ্টা পর হাসপাতালের চিকিৎসকরা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন।

বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তার স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, বেগম খালেদা জিয়ার মরহুম ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান, দুই মেয়ে জাহিয়া রহমান, জাফিয়া রহমান, বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, মরহুম সাইদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার, বেগম খালেদা জিয়ার মেঝ বোন সেলিনা ইসলামসহ পরিবারের সদস্যরা এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সময় হাসপাতালে ছিলেন।

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে তাৎক্ষণিকভাবে শোকের ছায়া নেমে আসে। হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সদের অনেককে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। এই শোক সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়। অনেকেই শোক প্রকাশ করে পোস্ট দেন। বিএনপি নেতাকর্মী আর সমর্থকরা জড়ো হতে থাকেন এভারকেয়ার হাসপাতালের বাইরে। পরে সকাল ৯টায় বেগম খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার সাংবাদিকদের সামনে এসে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, ‘দীর্ঘ ১ মাস ১০ দিন বিভিন্ন চিকিৎসা করে উনাকে সুস্থ করার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল, বাট আমি মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে আজ ভোর ৬টায় উনাকে ক্লিনিক্যালি ডেড ঘোষণা করেছিলাম। আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে উনার জন্য দোয়া চাই। আপনারা দোয়া করবেন, উনি যেন বেহেশতবাসী হোন।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ সময় বলেন, এই সংবাদটি নিয়ে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে হবে, এটা আমরা কখনও ভাবিনি। এই শোক, এই ক্ষতি এটা অস্বাভাবিক, অপূরণীয়। এই জাতি কোনোদিন পূরণ করতে পারবে না। মির্জা ফখরুল বলেন, তাদের নেত্রীর মৃত্যুর খবর পেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করেছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বিএনপি সাত দিনের শোক ঘোষণা করেছে জানিয়ে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সকল কার্যালয়ে সাত দিন কালো পতাকা উত্তোলন থাকবে। দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীরা এই সাত দিনব্যাপী কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। প্রতিটি দলীয় কার্যালয় দেশনেত্রীর জন্য সাতদিন ব্যাপী কোরআন খতম ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ও গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে এবং জেলা পর্যায়ে দলীয় কার্যালয়ে শোক বই খোলা হবে।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক : বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর পর দুপুরে উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বৈঠক শুরু হয় ১ মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। সভায় প্রধান উপদেষ্টা বেগম খালেদা জিয়ার স্মৃতিচারণ করেন। এতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজাসংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বেগম খালেদা জিয়ার জানাজার সিদ্ধান্ত হয়। সভা শেষে ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, গোটা জাতির মতো সরকারে যারা আছেন তারাও শোকাহত। উপদেষ্টা পরিষদের সভায় খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে আজ বুধবার থেকে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। আজ বুধবার থাকবে সাধারণ ছুটি। তিনি বলেন, দেশের ইতিহাসে বেগম জিয়ার অবদান অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। এমন একজন নেত্রীর চলে যাওয়াটা একটি বিশেষ মুহূর্ত। সবাই শোকাহত। সবার উচিত জানাজা ও দাফনে যথাযথ সম্মানপ্রদর্শন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা। উপদেষ্টা পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিশ্বে বাংলাদেশের যত দূতাবাস ও হাইকমিশন আছে সেগুলোতে খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে শোক বই খোলা হবে।

স্থায়ী কমিটির বৈঠক : চেয়ারপারসনের মৃত্যুর পর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জরুরি বৈঠকে বসে বিএনপির স্থায়ী কমিটি। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে এই বৈঠক চলে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ অংশ নেন। বৈঠক শেষে বেলা পৌনে ৩টার দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা আজ বুধবার বেলা ২টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হবে। জানাজা শেষে তার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পাশে দাফন করা হবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা পড়াবেন জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব। পুরো জানাজা কার্যক্রমের সঞ্চালনা করবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। সবাই অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে জানাজায় অংশগ্রহণ করবেন। তাঁর দাফনে অংশ নেবেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে ৭ দিনব্যাপী বিএনপি শোক পালন করবে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সকল দলীয় কার্যালয়ে এসময় কালো পতাকা উত্তোলন এবং দলীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। দলের সকল স্তরের নেতাকর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করবে। প্রতিটি দলীয় কার্যালয়ে কোরআন খতম ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে গুলশানস্থ বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে ও নয়াপল্টনস্থ বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এবং জেলা পর্যায়ে দলীয় কার্যালয়ে শোকবই খোলা হয়।

কান্নার রোল নয়াপল্টনে : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর সংবাদে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জড়ো হন নেতাকর্মীরা। প্রিয় নেত্রীর মৃত্যুতে কান্নার রোল পড়ে যায় তাদের মধ্যে। অনেককেই হাউমাউ করে কাঁদতে দেখা গেছে। অনেক নেতাকর্মী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করে তার ফাঁসি দাবি করেন। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর সংবাদের পর থেকেই নয়াপল্টনে কোরআন খতম শুরু হয়। সকাল ১০টা থেকে দলীয় কার্যালয়ের নিচতলায় ওলামা দল কোরআন খতম শুরু করে। আজ বুধবার জানাজার আগ পর্যন্ত কোরআন খতম চলবে। দলীয় কার্যালয়ে উত্তোলন করা হয়েছে কালো পতাকা।

গুলশান কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের ভিড় : সকাল গড়াতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপির নেতাকর্মীরা গুলশানের কার্যালয়ের সামনে আসতে থাকেন। তবে এদিন দলীয় স্লোগান নয়, শোকই ছিল প্রধান ভাষা। অনেক নেতাকর্মীকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখা যায়। কেউ বলছিলেন, ‘এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।

হাসপাতালের সামনে কান্না আর দোয়া : হাসপাতালের আশপাশে জড়ো হওয়া সাধারণ মানুষের ভিড়ও ছিল চোখে পড়ার মতো। তাদের অনেকেই সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। কেউ এসেছেন দীর্ঘদিনের পরিচিত এক রাজনৈতিক চরিত্রের প্রস্থান দেখতে, কেউ এসেছেন শুধু শোক প্রকাশ করতে। ভিড়ের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক কর্মী স্মৃতিচারণা করছিলেন। কেউ আন্দোলনের দিনের কথা বলছিলেন, কেউ কারাবন্দি অবস্থায় বেগম খালেদা জিয়ার দৃঢ় অবস্থানের কথা স্মরণ করছিলেন। অনেকের ভাষ্যে উঠে আসে একজন আপসহীন রাজনৈতিক নেত্রীর প্রতিচ্ছবি, যিনি বিরোধিতা, কারাবাস ও অসুস্থতার মধ্যেও রাজনীতির কেন্দ্রেই ছিলেন। অনেক নেতাকর্মীকে হাউমাউ করে কাদতে দেখা গেছে। আবার অনেকে শুধু দোয়া করছিলেন। এর মধ্যে অনেকের উদ্যোগে কোরআন খতমের ব্যবস্থাও করা হয় হাসপাতালের সামনে। বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল চত্বর ও সংলগ্ন সড়কে মানুষের চাপ বাড়তে থাকে। ভিড় সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে দেখা যায়।

বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট জলপাইগুড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম ও মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার প্রকৃত নাম খালেদা খানম, ডাক নাম পুতুল। আগস্ট ১৫, ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ভাইয়েরা সবার ছোট। তার পিতামহ হাজী সালামত আলী, মাতামহ জলপাইগুড়ির তোয়াবুর রহমান। বাবা জনাব ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। বেগম খালেদা জিয়ার স্বামী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধে প্রথম ব্রিগেড জেড ফোর্স-এর কমান্ডার ও সেক্টর কমান্ডার হিসেবে রণাঙ্গনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁর এক ভাই মেজর (অবঃ) সাইদ ইস্কান্দার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল থেকে ফেনী-১ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। তার দুই ছেলের মধ্যে বড় তারেক রহমান (জন্মঃ ২০ নভেম্বর ১৯৬৭) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তার কনিষ্ঠ ছেলে আরাফাত রহমান কোকো (১২ আগস্ট ১৯৭০-২৪ জানুয়ারি ২০১৫)। আরাফাত রহমান কোকো ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি মালায়া হাসপাতালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। আরাফাত রহমান একজন ব্যবসায়ী ছাড়াও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ও সিটি ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন।

বেগম খালেদা জিয়ার স্থায়ী নিবাস : দিনাজপুর শহরের মুদিপাড়া। আদি পিতৃ-ভিটা ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মজুমদার বাড়ী। বাবা জনাব ইস্কান্দর মজুমদার ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। ইস্কান্দর মজুমদার ১৯১৯ সালে ফেনী থেকে জলপাইগুড়ি যান। বোনের বাসায় থেকে মেট্রিক পাস করেন ও পরে চা ব্যবসায়ে জড়িত হন। ১৯৩৭ সালে জলপাইগুড়িতে বিয়ে করেন। জল্পাইগুড়ির নয়াবস্তি এলাকায় ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বসবাস করেন। ১৯৮৪ সালের ১৫ নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। মা বেগম তৈয়বা মজুমদার ছিলেন একান্তভাবে একজন গৃহিণী। বেগম খালেদা জিয়ার শিক্ষা: বেগম খালেদা জিয়ার স্কুলজীবন শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুরের মিশন স্কুলে। এরপর দিনাজপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীতে পড়াশোনা করেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে।

বেগম খালেদা জিয়ার বিয়ে : ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে তার বিয়ে হয়। জিয়াউর রহমানের ডাক নাম কমল। জিয়া তখন ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডি এফ আই এর অফিসার হিসাবে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন।

সংসার : ১৯৬৫ সালে বেগম খালেদা জিয়া স্বামীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমানে পাকিস্তান) যান। ১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত করাচিতে স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন জয়দেবপুর থাকার পর চট্টগ্রামে স্বামীর পোস্টিং হলে তার সঙ্গে সেখানে এবং চট্টগ্রামের ষোলশহর একালায় বসবাস করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বেগম খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত থাকেন। ২ জুলাই সিদ্ধেশরীতে জনাব এস আব্দুল্লাহর বাসা থেকে পাক সেনারা তাকে দুই ছেলেসহ বন্দি করে। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি মুক্তি পান। রাজনীতিতে আসার আগ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়া একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীনও রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতি ছিল না।

১৯৮১ সালের ৩০ মে এক ব্যর্থ সামরিক অভুত্থ্যানে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের আহ্ববানে তিনি ১৯৮২ সালে ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। বেগম খালেদা জিয়া এর বিরোধিতা করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে পার্টির চেয়ারপার্সন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলতঃ বিএনপির পূর্ণ বিকাশ হয়।

আন্দোলন : ১৯৮৩ সালের বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়। একই সময় এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। একই সময় তার নেতৃত্বে সাত দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনের দলের সঙ্গে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি শুরু করে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ রাতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এরশাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিধান্ত নিলে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাঁধার সৃষ্টি হয়। ১৫ দল ভেঙে ৮ দল ও ৫ দল হয়। ৮ দল নির্বাচনে যায়। এরপর বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট আন্দোলন চালায় এবং নির্বাচন প্রত্যাখান করে।

১৯৮৭ সাল থেকে বেগম খালেদা জিয়া ‘এরশাদ হটাও’ এক দফার আন্দোলন শুরু করেন। এর ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। পুনরায় শুরু হয় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। অবশেষে দীর্ঘ আট বছর একটানা নিরলস ও আপসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।

গ্রেপ্তার ও কারাগার : প্রথম গ্রেপ্তার ১৯৭১ সাল পাকবাহিনী ২ জুলাই ঢাকায় এক আত্মীয় বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেবার পর থেকে মোট ৬ বার তিনি গ্রেপ্তার হন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর ৩ তারিখে দুদকের দায়ের করা মামলার অভিযোগে পুত্রসহ গ্রেপ্তার হন। ২০০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বার তিনি হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার হবার পর দীর্ঘ ১ বছর ৭ দিন কারাগারে অবস্থানকালে তাঁর বিরুদ্ধে চলতে থাকা কোন মামলারই উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি হয়নি এবং চলতে থাকা তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। ভোটারবিহীন দখলদার আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় দুদকের করা মামলায় ফরমায়েসী রায়ে ২০১৮ সাল ৮ ফেব্রুয়ারি সাজা রায় দেয়। তিনি ২ জুন ২০২৪ পর্যন্ত কারাগারে (সরকারের নির্বাহী আদেশে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেন)।

সেনানিবাসের বাসা ত্যাগ : ১৩ নভেম্বর ২০১০ বেগম খালেদা জিয়া তার ২৮ বছরের আবাসস্থল ছেড়ে যান। তিনি অভিযোগ করেন তাকে বলপ্রয়োগে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তবে সরকারি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তিনি স্বেচ্ছায় বাসা ত্যাগ করেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল হিসেবে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে শহীদ মইনুল সড়কের ৬ নম্বর বাড়িতে ওঠেন বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়া চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হলে ১২ জুন তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তার সেনানিবাসের ওই বাড়িটি বেগম খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ দেন।

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে খালেদা জিয়াকে : সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ। উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি সভা শেষে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। সংসদ ভবন এলাকার পাশে অবস্থিত জিয়া উদ্যানে তার স্বামী ও বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে খালেদা জিয়াকে দাফন করা হবে। তিনি আরও জানান, বুধবার (আজ) সংসদ প্লাজায় জোহরের নামাজের পর জানাজা হবে। মরদেহ আজ এভারকেয়ারে থাকবে। কাল সকালে সেখান থেকে বেগম খালেদা জিয়ার মরদেহ সংসদ ভবনে আনা হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত