ইসলামে দুটি ইবাদত অধিক হারে করতে বলা হয়েছে। তা হলো- জিকির ও দরুদ শরিফ। এজন্য তা কোনো শর্তের জালে আবদ্ধ করা হয়নি। শুয়ে-বসে, চলে-ফিরে সবভাবে করা যায়। অন্যান্য ইবাদতে আধিক্যের পরিবর্তে ভারসাম্য বজায় রাখতে বলা হয়েছে। জিকিরের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, কোনো কিছু জবানে জারি হওয়া বা অন্তরে উদিত হওয়া। পরিভাষায়- বান্দার আল্লাহকে স্মরণ করাই হচ্ছে জিকির। (আল-মাওসুআতুল ফিকহিয়্যাহ : ২১/২১৯)। ‘জিকির’ শব্দটি কোরআনে ২৬৮ বার এসেছে। উল্লিখিত অর্থের বাইরে আরও কিছু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- সুরা আলে ইমরানের ৫৮ ও সুরা আম্বিয়ার ৫০ নম্বর আয়াতে জিকির শব্দটি ‘কোরআন’ অর্থে এসেছে। সুরা আম্বিয়ার ৭ ও ২৪ নম্বর আয়াতে ‘তাওরাত-জাবুর-ইঞ্জিল’ অর্থে, সুরা কমারের ১৭ নম্বর আয়াতে ‘উপদেশ গ্রহণ’ অর্থে এবং সুরা তালাকের ১০-১১ নম্বর আয়াতে রাসুল (সা.)-এর নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বোখারির এক হাদিসে জিকির শব্দটি ‘লওহে মাহফুজ’ অর্থেও এসেছে। (বোখারি : ৩১৯১)।
জিকিরের শর্ত ও তিন স্তর : কোরআনুল কারিমে মোমিনদের অধিকহারে জিকির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মোমিনগণ! তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহকে স্মরণ কর।’ (সুরা আহজাব : ৪১)। একদিকে অধিক হারে জিকিরের নির্দেশ দিয়ে অপরদিকে তা আবার সহজও করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর নামের জিকিরে শারীরিক কষ্ট হয় না। অন্যান্য ইবাদতের মতো এতে পবিত্রতা অর্জন, সময় হওয়া, কেবলার দিকে মুখ করা ইত্যাদি শর্ত করা হয়নি। জিকিরের তিনটি স্তর- শুধু জবানে, শুধু অন্তরে এবং জবান-অন্তর উভয়ের সমন্বয়ে। শেষোক্তটি সবচেয়ে বেশি উপকারী। হাকিমুল উম্মত থানবি (রহ.) জিকিরের দুটি ভাগ করেছেন- বাহ্যিক : মুখে উচ্চারণ করা, অন্তরে স্মরণ করা ও হাকিকি : পূর্ণ শরিয়ত পালন করা। অর্থাৎ আল্লাহর সঙ্গে এমন সম্পর্ক কায়েম করা যে, কোনো কাজ তাঁর মর্জি বিরোধী হবে না। (খুতুবাতে জুমা : ১/২৫৮)। গাফলতের কারণে জিকির বন্ধ করবে না। বরং জিকির করতে থাকবে আর মনোযোগ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাবে। অনেকে গাফলতের সময় আল্লাহর জিকির করে না। মনে করে, অমনোযোগিতার সঙ্গে জিকির করলে বোধয় কোনো ফায়দা হবে না। থানবি (রহ.) বলেন, এ ভেবে জিকির থেকে বিরত থাকা উচিত নয়। অন্যান্য অঙ্গ না হলেও অন্তত একটি অঙ্গ তো আল্লাহর জিকিরে মাশগুল থাকল।
জিকিরের নিয়মণ্ডপদ্ধতি : জিকিরে মনোযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে সুফিয়ায়ে কেরাম মুরিদদের বিভিন্ন পদ্ধতিতে জিকিরের সবক দিয়েছেন। আমাদের সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকার জিকির সেসব পদ্ধতিরই অন্তর্ভুক্ত। যেমন-
১. জিকিরে জাহরি : জিকিরে মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য অনেকে মুরিদকে জিকিরে জাহরি বা জোরে জোরে জিকির করতে বলেছেন। কেননা, চুপি চুপি নির্জনে জিকির করতে গেলে মনোযোগ বিভিন্ন দিকে চলে যায়। যদি উঁচু আওয়াজে জিকির করা হয়, তাহলে খেয়াল অন্যদিকে যাবে না।
২. জরব : জরব মানে ধাক্কা দেওয়া। জরবের একটি নিয়ম হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা’ বলার সময় চেহারা এবং ঘাড় একেবারে কলবের কাছে নিয়ে যাবে। তারপর ঘাড় ডানদিক দিয়ে পেছনের দিকে ফেরাবে। তখন খেয়াল করবে যে, আল্লাহ ছাড়া সব কিছুর মোহাব্বত পেছনে নিক্ষেপ করছি। এরপর ‘ইল্লাল্লাহ’ বলার সময় চেহারা ও ঘাড় কলবের কাছে নিয়ে গিয়ে জোরে ধাক্কা দেবে। তখন খেয়াল করবে যে, আমি কেবল আল্লাহর মোহাব্বতই অন্তরে প্রবেশ করাচ্ছি। সুফিয়ায়ে কেরাম মনে করেন, জরবের মধ্যে মশগুল থাকলে অন্যদিকে মনোযোগ যাবে না। যখন নিয়মিত এভাবে জিকির করতে থাকবে, তখন একটা সময়ে গিয়ে মনোযোগ আর গাইরুল্লাহর দিকে যাবে না।
৩. কিমাস রগ আটকে ধরে জিকির : বাঁ পায়ের হাঁটুর ভেতরের দিকের রগকে বলে কিমাস রগ। চারজানু হয়ে বসে ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি ও তার সঙ্গের আঙ্গুল দিয়ে বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের রগ চেপে ধরে জিকির করা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ পদ্ধতিতে জিকির করলেও অন্যদিকে মনোযোগ যায় না।
৪. পাসআনফাস : প্রতিটি নিঃশ্বাসে, তথা নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা, আবার নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়ও আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা।
৫. সুলতানুজ জিকির : অর্থাৎ এ খেয়াল করা, আমার সঙ্গে ঘর-দরজা, চাঁদণ্ডসূর্য, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা সবকিছুই আল্লাহর জিকির করছে। দাউদ (আ.)-এর সঙ্গে পাহাড় ও পাখির জিকির করার কথা কোরআনে উল্লেখ আছে। (সুরা আম্বিয়া : ৭৯)।
জিকিরে বিশেষ সতকর্তা : মনে রাখতে হবে, সুফিয়ায়ে কেরামের বাতলে দেওয়া জিকিরের উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো জায়েজ। কিন্তু শরিয়তের মাকসাদ, মাসনুন বা মুস্তাহাব নয়। মাকসাদ, মাসনুন কিংবা মুস্তাহাব মনে করলে বিদাত হবে। জায়েজ শুধু এ শর্তে যে, পদ্ধতিগুলো প্রাথমিক মুরিদদের জিকিরে মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য চিকিৎসাস্বরূপ। আমাদের সমাজের একদল জিকিরের এ পদ্ধতিগুলোকে সরাসরি বিদাত বলে ছাড়াছাড়িতে লিপ্ত আছে, আরেক দল কোনো শর্ত ছাড়াই নির্ধারিত একটি পদ্ধতিকে উত্তম মনে করে বাড়াবাড়িতে লিপ্ত আছে। জিকিরের মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে, জিকিরে খফি বা আস্তে জিকির করা। সুরা আরাফের ৫৫ এবং ২০৫ নম্বর আয়াতে নিচু স্বরে আল্লাহকে ডাকার কথা বলা হয়েছে।
জিকিরের যত উপকারিতা : জিকিরের নানাবিধ উপকার রয়েছে। যেমন-
১. জিকিরকারীকে আল্লাহ স্মরণ করেন : আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখব। আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : ১৫২)। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ বলেন, ‘আমি বান্দার সঙ্গে তেমন ব্যবহার করি, যেমন সে আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি তার সঙ্গে থাকি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে। সে যদি আমাকে মনে মনে স্মরণ করে, আমিও তাকে মনে মনে স্মরণ করি। সে যদি কোনো মজলিসে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমি তার মজলিসের চেয়ে উত্তম মজলিসে তার আলোচনা করি।’ (বোখারি : ২/৭৪০৫, মুসলিম : ২৬৭৫)।
২. অন্তর প্রশান্তি লাভ করে : আল্লাহ বলেন, ‘জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরগুলো শান্তি পায়।’ (সুরা রাদ : ২৮)।
৩. জিকিরকারী জীবিত : রাসুল (সা.) বলেন, ‘যারা আল্লাহর স্মরণ করে আর যারা করে না, তাদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে জীবিত ও মৃত।’ (বোখারি : ৬৪০৭)।
৪. জিকিরকারী সফলকাম : আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে, যাতে সফলতা অর্জন কর।’ (সুরা আনফাল : ৪৫)।
৫. জিকিরকারীর জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার : আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহকে অধিক পরিমাণ স্মরণকারী পুরুষ-নারীর জন্য আল্লাহ প্রস্তুত করে রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’ (সুরা আহজাব : ৩৫)।
লেখক : শিক্ষাসচিব, জামিয়া নুরিয়া কাসেমুল উলুম, মিরপুর, ঢাকা