গ্রীষ্ম মানেই দাবদাহ। গরমে হাঁসফাঁস করা অতিষ্ঠ সময়। কিন্তু এর মধ্যেই আশীর্বাদ হয়ে প্রকৃতিতে ফোটে নানা রঙের বাহারি ফুল। কৃষ্ণচূড়ার লাল আবির গ্রীষ্মকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা। যেদিকে চোখ যায়, যেন সবুজের মাঝে লালের মূর্ছনা। প্রকৃতিতে এখন চলছে গ্রীষ্মের রাজত্ব। ‘প্রখর তপনতাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে/বায়ু করে হাহাকার।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের অবিকল প্রতিমূর্তি যেন বৈশাখের প্রকৃতি। দাবদাহে ব্রহ্মতালু ফেটে যায় প্রায়। মাসের শুরুর দিনগুলোতে সবার মুখে মুখে ফিরেছে কেবল একটিই কথা, ‘নাহ?, এ গরমে আর টেকা যাচ্ছে না।’ এ ‘গ্রীষ্মলাঞ্ছনার’ মধ্যেই সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কখনও কখনও হয়েছে প্রকৃতির চরিত্র-বদল। দিবাভাগে প্রচণ্ড খরতাপ। দিন শেষে আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। খানিকবাদেই রুদ্ররূপে হাজির বৃষ্টি, বজ্রবৃষ্টি বা কালবোশেখি। একদিন ঝড়-বৃষ্টিতে বিদায় নেবে গ্রীষ্মকাল। আসবে বর্ষাঋতু। চিরাচরিত পঞ্জিকার পাতার মতোই যে প্রকৃতি তার পাণ্ডুলিপি রচনা করবে, এমন নয়। গ্রীষ্মে ফোটা ফুল আর কিছুদিন আয়ু পাবে বৃক্ষে ও শাখায়। ফুল ঝরার আগেই কিছুটা সময় কাটাতে এমন মুগ্ধতার কাছে, এমন নিঃশব্দ আনন্দের কাছে যাওয়া যায় সহজেই।
ফুলের জলসা : হাহাকার করা বায়ু বা প্রখর তপনতাপের বিপরীতে এ গ্রীষ্মেই প্রকৃতি আয়োজন করেছে ফুলের জলসা। বহুবর্ণের ফুল আর এর মনকাড়া ঘ্রাণ নাগরিকজীবন রাঙিয়েছে রঙে আর ঘ্রাণে। সময় হয়তো বৈরী, কিন্তু সংবেদনশীল মানুষ সড়কের দু’পাশে, অফিস বা বাড়ির চত্বরে বা পার্কে ফুটে থাকা ফুলের তীব্র আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেন না। মেঘাচ্ছন্ন বিকালে গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে সচিবালয় সড়কে ঢুকতেই নীরবে সম্ভাষণ জানায় গ্রীষ্মের লাজুক ফুলগুলো। বাঁ-পাশে ওসমানি উদ্যানে রক্তলাল কৃষ্ণচূড়ার বর্ণিল উপস্থিতি। গ্রীষ্ম কৃষ্ণচূড়ারই দিন। নিসর্গীরা বলে থাকেন, পলাশ-শিমুল যদি বসন্তের প্রতীক হয়, কদম যদি হয় বর্ষার, তবে কৃষ্ণচূড়া নিশ্চয় গ্রীষ্মের প্রতীক। এ নগরের ফুসফুস রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর সংসদ ভবন এলাকা ছাড়াও নানা প্রান্তে সবুজ পাতার ফাঁকে মোরগের লাল ঝুঁটির মতো মাথা উঁচু করে আছে কৃষ্ণচূড়া। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রশস্তি করেছিলেন কৃষ্ণচূড়ার। লিখেছেন, ‘কৃষ্ণচূড়ার রাঙা মঞ্জুরি কর্ণে/ আমি ভুবন ভোলাতে আসি গন্ধে ও বর্ণে।’
বাগানবিলাস ও মায়া : আবদুল গনি সড়কের বিভাজকে বাগানবিলাস আর দুইপাশে কাঠগোলাপের সাদা মায়া। মেঘশিরীষের ফুলের সুধা দেখে হাইকোর্ট এলাকায় প্রবেশ করতেই বিরহী কোকিলের কুহু ডাক। ফুলের হাসি আর পাখির গান মনে গেঁথেই রমনা উদ্যানে ঢোকেন পথচারীরা। ছুটির দিনে নগরবাসীরা পরিবারসহ বৈকালিক বিহারে আসেন। উদ্যানের গাছ ও পাখির নিস্তার নেই। ছবি তোলা হয় বিরামহীন। সেসব ছবিতে রং ছড়িয়ে রমনায় ফোটে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, নাগেশ্বর, রাধাচূড়া, গুস্তাভিয়া, কাঠগোলাপ, ডুলিচাপা, উদয়পদ্ম, মধুমঞ্জুরি, কনকচূড়া, ঝুমকো লতার মতো বহু রঙের ফুল। শুধু গ্রীষ্ম নয়, বৈচিত্র্যের কারণে রমনা পার্কে বছরজুড়েই কোনো না কোনো ফুলের হাসি ও সৌরভ চারদিক মাতিয়ে রাখে। সন্ধ্যার খানিক আগে হঠাৎ ঝিরঝির বৃষ্টিতে অভ্যাগতের সংখ্যা কমে আসে। উদ্যানের তৃষ্ণার্ত গাছ আর ফুলগুলো বৃষ্টির স্পর্শে আরও তাজা হয়ে ওঠে।
ধমুগ্ধতা ও প্রকৃতিপ্রেম : রমনার পাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ক্যাম্পাসে অনেক গাছ কাটা পড়লেও কিছুটা সবুজ এখনও টিকে আছে। কার্জন হলের বোটানিক্যাল গার্ডেনে শুভ্র হাসিতে স্বাগত জানায় কুরচি। সেখানে আরও ফুটেছে সোনালু, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, কাঠগোলাপ ও স্বর্ণচাপা। এর বাইরে হাতিরঝিল বা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান- যেখানেই সামান্য সবুজ, সেখানেই গ্রীষ্ম ঋতুর ফুলের হাসি। এ রূপমাধুর্য এড়িয়ে যায়, সাধ্য কার। সংসদ ভবন এলাকায় ফুটে থাকা কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, সোনালুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ নগরবাসীর অনেকেই চলতিপথে মোটরসাইকেল বা গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলেন। এ দৃশ্য নিত্যকার। তেজগাঁও এলাকা থেকে অশোক, স্বর্ণচাপা আর শিরীষের ছবি তুলে ফেসবুকে দেন অনেকে। তারা বলেন, প্রকৃতিপাঠ তাদের কাছে অফুরন্ত আনন্দের উৎস। নিজেরা তাই সব ঋতুর ফুল আর গাছের নাম জানার চেষ্টা করেন। তাদের ইচ্ছা, ছেলেমেয়েদেরও এতে আগ্রহী করে তোলার। যাতে ওদের মধ্যেও গড়ে ওঠে প্রকৃতিপ্রেম, পরিবেশের প্রতি সচেতনতা।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক