আল্লাহর বিধান পালনে সমস্যা হলে ঈমান-আমল রক্ষার্থে নিজ অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে যাওয়াকে হিজরত বলে। হিজরতের বিধান কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। মক্কার জীবনে প্রিয়নবী (সা.)-এর ওপর কাফেররা বহু নির্যাতন করে। তিনি নীরবে তা সহ্য করেন। একপর্যায়ে আল্লাহতায়ালা তাকে মদিনায় হিজরতের আদেশ দেন। আল্লাহর আদেশ পেয়ে তিনি আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে নিয়ে মদিনার পথ ধরেন। হিজরতের শুরু-শেষ এমন কিছু ঘটনা রয়েছে, যা আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন ও তৌহিদের আলোকবর্তিকা।
নবীজি (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা : নীতি-আদর্শে যখন মানুষ কুলিয়ে ওঠতে না পারে, তখন গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন কলা-কৌশলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। মক্কার কাফেররা-এর ব্যতিক্রম ছিল না। রাসুল (সা.) মক্কাবাসীকে মূর্তির পূজা ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য আহ্বান করতেন। পাথরনির্মিত ৩৬০ খোদার পূজারীরা তা মেনে নিতে পারেনি। তাই একপর্যায়ে তারা মহানবী (সা.)-কে হত্যার পরিকল্পনা করে। এ জঘন্যতম কাজসম্পন্ন করতে প্রত্যেক গোত্রের শক্তিশালী যুবকদের নির্বাচন করে। যেন হত্যা-পরবর্তীকালে নবীর গোত্রের লোকেরা সব গোত্রের বিপক্ষে হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারে। সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা ঘোষণা করল, মুহাম্মদ (সা.)-কে যে জীবিত বা মৃত ‘নদওয়া’ ঘরে হাজির করতে পারবে, তাকে ১০০ উট দেয়া হবে। মক্কার সব গোত্রের শক্তিশালী যুবক একত্রিত হয়ে শপথ নিল, সেদিন রাতেই মুহাম্মদ (সা.)-এর বাড়ি ঘেরাও করবে; তাকে চিরতরে শেষ করে দেবে। তাদের সব পরিকল্পনা আল্লাহ নস্যাৎ করে দিলেন। রাতেই তিনি অহির মাধ্যমে এ চক্রান্তের কথা রাসুল (সা.)-কে জানিয়ে দিলেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! আপনি ওই সময় স্মরণ করুন, যখন কাফেররা চক্রান্ত আঁটছিল যে, তারা আপনাকে বন্দি, হত্যা বা দেশান্তর করবে। তারা তাদের ষড়যন্ত্র করছিল আর আল্লাহ আপন কৌশল করছিলেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বোত্তম কৌশলী।’ (সুরা আনফাল : ৩০)।
ঘরহারা নিরুদ্দেশ মুসাফির : শত্রুরা রাসুল (সা.)-এর ঘর বেষ্টন করল। অপেক্ষায় রইল, রাসুল (সা.) ঘর থেকে বেরুলেই তারা তাকে হত্যা করবে। এদিকে আল্লাহতায়ালা অহির মাধ্যমে নবীজি (সা.)-কে জানিয়ে দিলেন। তাকে নির্দেশ দিলেন, রাতে নিজ ঘরে না শুয়ে তার স্থানে আলী (রা.)-কে রাখতে। প্রিয়নবী (সা.) আলী (রা.)-কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাদরামি চাদর গায়ে জড়িয়ে আমার বিছানায় শুয়ে থাক। ওদের হাতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৪৮২-৪৮৩)। নবীজি (সা.) হিজরতের জন্য আল্লাহর আদেশের অপেক্ষায় ছিলেন। যে রাতে শত্রুরা তাকে হত্যার ষড?যন্ত্রে মেতেছিল, সে রাতেই হিজরতের নির্দেশ পান। জিবরাইল (আ.) হিজরতের নির্দেশ সংবলিত আসমানি বার্তা নিয়ে এলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, হে আমার রব! কল্যাণের পথে আমাকে প্রবেশ ও বের করুন। আমাকে আপনার পক্ষ থেকে সাহায্যকারী শক্তি দান করুন।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৮০)। এরপর রাসুল (সা.) একমুঠো ধুলো নিয়ে বাইরে এলেন। কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করলেন। ধুলো গিয়ে পড়ল সবার চোখেমুখে। এতেই আল্লাহতায়ালা তাদের অন্ধ করে দিলেন। ফলে তারা আল্লাহর রাসুল (সা.)-কে দেখতে পেল না। সে সময় নবীজি (সা.) এ আয়াত পাঠ করছিলেন, ‘আমি ওদের সামনে ও পেছনে প্রাচীর স্থাপন করছি। ওদের আবৃত করছি। ফলে ওরা দেখতে পায় না।’ (সুরা ইয়াসিন : ৯)। এরপর তাদের ওই অন্ধ অবস্থায় তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন। ওৎপেতে থাকা লোকদের কেউ কিছুই দেখতে পেল না। নবীজি (সা.) তখন আবু বকর (রা.)-এর বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন। সেই ঘরের একটি জানালাপথে বেরিয়ে উভয়ে মদিনার উদ্দেশে রওনা দিলেন। কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত সওর পাহাড়ের একটি গুহায় তারা যাত্রাবিরতি করলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৪৮৩, জাদুল মাআদ : ২/৫২)। রাসুল (সা.) তাদের সামনে দিয়েই চলে গেলেন, অথচ তারা তাকে দেখতে পেল না।
আসমা (রা.)-এর সাহায্য : রাসুল (সা.) যে তার ঘরে নেই, সূর্যোদয়ের পর কাফেররা তা জানতে পারল। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিন্তু কূটবুদ্ধির কুমির আবু জাহেল আবু বকর (রা.)-এর ঘরের দিকে ছুটল। তখনও সে জানত না, আবু বকর (রা.) ও রাসুল (সা.) একসঙ্গে হিজরত করেছেন। তবে এতটুকু বুঝেছে, নবীজি (সা.)-এর কথা আবু বকর (রা.) জেনে থাকবেন। বাড়ি পৌঁছেই আবু জাহেল প্রচণ্ডভাবে দরজায় ধাক্কা দিল। আসমা (রা.) দরজা খুললেন। সে জানতে চাইল, ‘আবু বকর কোথায়?’ আসমা (রা.) খুব শান্ত গলায় উত্তর দিলেন, ‘আমি কী করে জানব?’ আবু জাহেল এতে প্রচণ্ড রেগে আসমা (রা.)-কে কষে চড় মারল। এতে তার কানের দুল ছিটকে পড়ল। মক্কায় তখন থমথমে পরিবেশ। সে সময় রাসুল (সা.)-এর হিজরতের খবর লুকানোই নয়, বরং তিনদিন পর্যন্ত আসমা (রা.) এমনভাবে তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিতেন, যেন কেউ টের না পায়। পুরো বিশ্বের মুসলিমদের জন্য তিনি আল্লাহর ওপর নির্ভরতার, সাহসিকতার এক মূর্তপ্রতীক। একজন নারী দীনের জন্য, আল্লাহর নবীর ভালোবাসায় কতটা ত্যাগ ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন, তা অভাবনীয়। সে মুহূর্তটা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। আসমা (রা.) এ সময় ভড়কে গেলে কিংবা ভেঙে পড়লে নবীজি (সা.)-এর হিজরত বাধার মুখে পড়ে যেতে পারত। এ বিপন্ন মুহূর্তে ঠিক বাবার মতোই শক্ত ভূমিকা পালন করেন তিনি। আর আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের অধিকারী আসমা (রা.) দৃঢ়তার সঙ্গে মক্কার সবচেয়ে প্রতাপশালী নেতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) মদিনায় হিজরতের উদ্দেশে রওনার সময় আমরা দ্রুত কিছু খাবার থলেতে রেখে দিই। কিন্তু থলেটি বাঁধার জন্য রশি জাতীয় কিছু পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বড় বোন আসমা (রা.) কোমরবন্ধ খুলে দু’টুকরো করে একটুকরোর মাধ্যমে থলের মুখ বাঁধলেন। এ কাজটি তার এত সম্মান বয়ে এনেছে যে, ইতিহাসে তাকে ‘জাতুন নিতাকাইন’ বলে স্মরণ করা হয়। (বোখারি : ৩৯০৫)।
সাওর গুহায় আত্মগোপন : শত্রুরা যেন টের না পায়, সেজন্য মক্কা থেকে উল্টো পথ ধরলেন নবীজি (সা.)। প্রায় পাঁচ মাইল পথ দক্ষিণে ইয়েমেনের দিকে হেঁটে সাওর পর্বতের গুহায় এসে যাত্রা বিরতি করেন। পাহাড়টি ছিল খুব উঁচু। পর্বতের চূড়ায় ওঠার পথ ছিল আঁকাবাঁকা। ওঠাও ছিল কষ্টসাধ্য। নবীজি (সা.) উঠতে গিয়ে আঘাতে রক্তাক্ত হলেন। পদচিহ্ন মুছে দিতে আঙুলে ভর দিয়ে হেঁটে আসায় যাত্রা ছিল আরও কষ্টসাধ্য। গুহায় আবু বকর (রা.) আগে প্রবেশ করলেন। পরিচ্ছন্ন করে গুছিয়ে নিলেন। কাপড় ছিড়ে গর্তগুলো আটকে নিলেন। কাপড়ের টুকরো কম থাকায় দুটো ছিদ্রের মুখ বন্ধ করা সম্ভব হলো না। সে দুটো নিজের পা দিয়ে বন্ধ করে রাখলেন।
আবদুল্লাহ ও আমির ইবনে ফুহাইরা : আবু বকর (রা.)-এর পুত্র আবদুল্লাহও তাদের সঙ্গে রাতযাপন করতেন। তবে সুবহে সাদিকের আগেই মক্কায় এসে সবার সঙ্গে মিশে যেতেন। মুশরিকরা নবীজি (সা.)-এর বিরুদ্ধে কী ষড?যন্ত্র করত, সে তথ্য অত্যন্ত সঙ্গোপনে তিনি সরবরাহ করতেন। অন্যদিকে আবু বকর (রা.)-এর গোলাম আমির ইবন ফুহাইরা পাহাড়ে ছাগল চরাত। যখন রাতের একাংশ পার হতো, তখন সে ছাগল নিয়ে গারে সওরের কাছে যেত। নবীজি (সা.) ও তার সাহাবিকে দুধ পান করাত। আবার ভোর হওয়ার আগে ছাগলের পাল নিয়ে দূরে চলে যেত। পরপর তিন রাতেই সে এরূপ করল। এমনকি আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.)-এর আসা-যাওয়ায় পথে তার পায়ের চিহ্নগুলো যেন মিশে যায়, সেজন্য আমির ইবনে ফুহাইরা সে পথে ছাগল খেদিয়ে নিত।
গুহামুখে এসেও ফিরে গেল : মক্কার কাফেররা থেমে নেই। হন্যে হয়ে খুঁজছে নবীজি (সা.)-কে। একশ উট পাওয়ার নেশা তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তারা এমন তুখোড় মেধা ও পদচিহ্ন বিশারদ ছিল, খুঁজতে খুঁজতে সাওর পর্বতের মুখে এসে উপস্থিত হলো। নবীজি (সা.)-এর জীবন শঙ্কায় আবু বকর (রা.) আঁতকে উঠলেন, এই বুঝি নিচে তাকাল আর দেখে ফেলল! কী হবে প্রাণপ্রিয় নবীজির? শত প্রশ্ন মনে। এ সময় রাসুল (সা.) বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহতায়ালা আমাদের সঙ্গে আছেন।’ বিষয়টির বর্ণনা আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে, ‘যদি তোমরা তাকে (রাসুলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখ, আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন; যখন কাফেররা তাকে বের করেছিল। যখন তিনি ছিলেন দুজনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা গুহার মধ্যে ছিল। যখন সে তার সঙ্গীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না। আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন। এরপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাজিল করলেন। তার সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখ নি। আল্লাহতায়ালা কাফেরদের শিরকি কথা নিচু করে দিলেন। বস্তুত আল্লাহর তৌহিদের কালিমা সদা উন্নত আছেই। আল্লাহ হলেন পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা তাওবা : ৪০)। রক্তপিপাসু শত্রুকে সামনে রেখে ওই সময়ের নাজুক অবস্থায় ‘চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন’ কথাটি মুখ দিয়ে বের হওয়া কেবল তখন সম্ভব, যখন একজন মানুষ সম্পূর্ণরূপে নিজেকে আল্লাহর ওপর সোপর্দ করে দেন। রাসুল (সা.) জানতেন, আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া শক্তিতে এদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আর আল্লাহই সাহায্য করেছেন। মোমিন বান্দার বিপদে আল্লাহ তার সঙ্গে থাকেন, যদি বান্দা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন।
আল্লাহর সাহায্য : সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা পর্বতজুড়ে নবীজি (সা.)-কে খুঁজেছে। এরপর গুহামুখে পৌঁছে কী মনে করে গুহার ভেতরেও তাকায়নি! অথচ নবীজি (সা.) শুধু তাদের পায়ের আওয়াজ শোনেননি। তাদের দেখেছেনও। ‘গুহামুখ থেকে ফিরে যাওয়া’ তাদের এ মনের পরিবর্তনটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল সরাসরি গায়েবি মদদ ও রাসুল (সা.)-এর অন্যতম মোজেজা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমার রবের সেনাবাহিনীর খবর তোমার রব ছাড়া কেউ জানে না’ (সুরা মুদ্দাসসির : ৩১)। এ কারণেই হাজারো প্রস্তুতি নিয়েও অবশেষে কুফরির ঝাণ্ডা অবনমিত হয় ও তৌহিদের ঝাণ্ডা সমুন্নত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন, যারা আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল।’ (সুরা নাহল : ১২৮)।
হিজরতের উপকারিতা : যে মুসলমানরা সহিষ্ণুতার পাশাপাশি নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন, হিজরত তাদের জন্য নতুন কোনো স্থানে স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা নির্যাতিত হওয়ার পর আল্লাহর জন্য ঘর ছেড়েছে, আমি অবশ্যই তাদের দুনিয়াতে উত্তম আবাস দেব। পরকালের পুরস্কার তো সর্বাধিক। হায়! যদি তারা জানত।’ (সুরা নাহল : ৪১)।
হিজরতের তাৎপর্য ও শিক্ষা : হিজরত প্রকৃতপক্ষে নির্যাতন থেকে সাময়িক বিরতিমাত্র; সহিংসতা উপেক্ষা করে ও শক্তি সঞ্চয় করে অপ্রতিরোধ্য সাহস গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ। হিজরত অত্যন্ত শক্তভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। মুসলমানরা শুধু কোনো নির্দিষ্ট জমিন বা সময়ের জন্য নয়, বরং বিশ্বময় সর্বকালে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠায় বিশেষ নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের জন্য নির্বাচিত এক জাতি। নবীজি (সা.)-এর পথ ধরে গাইরুল্লাহকে ছেড়ে এক আল্লাহর পথে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করাই হিজরতের মূল শিক্ষা।