ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মদিনার মসজিদে নববিতে জুমার খুতবা

নবীজীবনের মুগ্ধকর গল্প

শায়খ ড. আবদুল বারি বিন ইওয়াজ আস সুবাইতি
নবীজীবনের মুগ্ধকর গল্প

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর জীবনবৃত্তান্ত শুধু অতীতের কিছু ঘটনার বর্ণনা নয়, কিংবা ইতিহাসের পাতায় লেখা কোনো ঘটনা নয়; বরং এটি একটি জীবন্ত বার্তা, যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, আত্মাকে জাগ্রত করে ও ফিতনার সময়ে পথ দেখায়। এটা এমন এক জীবনযাত্রার গল্প, যা শিক্ষা ও উপলব্ধিতে ভরপুর- শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত। গারে হেরার নির্জনতায় অহির (প্রত্যাদেশ) সূচনা থেকে শুরু করে মদিনার মিম্বারে দাঁড়িয়ে বার্তা পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত। দুঃখ-কষ্ট ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে নেতৃত্ব ও বিজয়ের দিকে যাত্রা। নবীজির প্রথম আহ্বান ছিল, ‘পড়ো’ ও শেষ উপদেশ ছিল, ‘তোমরা নামাজের প্রতি যত্নবান থেকো ও নিজেদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে খেয়াল রেখো।’

মহানবী মুহাম্মাদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন এতিম অবস্থায়। কিন্তু এতিম হওয়া দুর্বলতা নয়- যদিও বাইরে থেকে তা বঞ্চনা মনে হতে পারে। বরং এটি আল্লাহর ওপর ভরসা করার অনুপ্রেরণা, আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি ও বড় কিছু হওয়ার প্রস্তুতি। যখন ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে এতিম একত্র হয়, তখন তা এমন এক আলোয় পরিণত হয়, যা পথ দেখায়। এটি মহানবী (সা.)-এর জীবনেই স্পষ্ট ছিল। অনেক মহাপুরুষের জীবনেও এমনটি দেখা যায়- যারা এতিম হয়েও ঈমান, জ্ঞান ও সংকল্প দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন ও সভ্যতার নির্মাতা হয়েছেন।

৪০ বছর বয়সে, যখন বিশ্বনবী (সা.) গারে হেরায় নির্জনে বসে আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করছিলেন, তখন জিবরাইল (আ.) মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে মহান আহ্বানটি নিয়ে আসেন যে, ‘পাঠ করো তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা আলাক : ১)। এটি শুধু পড়ার আদেশ ছিল না; বরং এটি ছিল এমন একটি নতুন জাতির ঘোষণা, যারা আল্লাহর নামে পড়বে, জ্ঞানের পথ দেখাবে ও ঈমানকে আঁকড়ে ধরবে। এই মহান বার্তা ‘পড়ো’ শব্দ দিয়ে শুরু হয়েছিল, যাতে এমন এক মানুষ তৈরি হয়, যে বুঝে, চিন্তা করে, বিশ্বাস করে ও অহির আলোয় পথ চলে।

অহি গ্রহণের পর, নবী (সা.) আতঙ্কিত হয়ে ঘরে ফিরে এলেন। এ সময় তার শরীর কাঁপছিল। তখন খাদিজা (রা.) তাকে ভালোবাসা ও শান্তির আশ্রয় দিলেন। তিনি দৃঢ়চিত্তে বললেন, ‘না, আল্লাহ কখনোই আপনাকে অপমান করবেন না। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, দুর্বলদের বোঝা বহন করেন, অসহায়দের সাহায্য করেন, অতিথিকে আপ্যায়ন করেন ও বিপদগ্রস্ত লোকদের পাশে থাকেন।’ (বোখারি : ৩)। এই কথাগুলো তার ভয় দূর করে দিল।

সুতরাং, যারা নবীর পথে চলে, দয়াকে নীতি বানায় ও তার চরিত্রকে অনুসরণ করে, আল্লাহ কখনোই তাদের অপমান করেন না।

নবী করিম (সা.)-এর দাওয়াতের পদ্ধতি ছিল প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে লোকদের দ্বীন ও ইসলামের প্রতি আহ্বান করা। কেননা, দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ ছিল, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত ও সদুপদেশ দিয়ে। আর তাদের সঙ্গে তর্ক করবে উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল : ১২৫)।

এই নির্দেশ অনুযায়ী, তিনি মানুষকে এমন কথায় দাওয়াত দিয়েছেন যা হৃদয়ে পৌঁছায়। ধৈর্য সহকারে তিনি অবজ্ঞা মোকাবিলা করেছেন, মূর্খতার জবাব দিয়েছেন সহনশীলতা দিয়ে। আর কঠোর ব্যবহার পেয়েও জবাব দিয়েছেন কোমলতায়।

নবী করিম (সা.)-এর দাওয়াত ছিল দয়া ও করুণায় পূর্ণ, কোনো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয়। আল্লাহতায়ালা নিজেই বলেছেন, ‘আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি শুধু রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)।

তিনি বিভ্রান্তদের প্রতি ছিলেন সহানুভূতিশীল, কাঠিন্যকারীকে বুঝিয়েছেন কোমলভাবে, অন্যায়ের জবাব দিয়েছেন ধৈর্য ও সহনশীলতা দিয়ে। কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি কখনও মূর্খতার জবাবে মূর্খতা দেখাননি, কিংবা রুঢ়তার জবাবে রুঢ়তা প্রদর্শন করেননি। তিনি মানুষের হৃদয় জয় করেছেন নম্রতা দিয়ে, কঠিন হৃদয়কে ভালোবাসা দিয়ে গলিয়েছেন।

আজকের সময়ে, যখন কথার জোর বাড়ছে, অজ্ঞতা ছড়াচ্ছে, আর প্রজ্ঞার অভাব দেখা দিচ্ছে- ঠক এই সময়ে আমাদের নবীজির সেই শান্তিপূর্ণ দাওয়াতের পথে ফিরে যাওয়া জরুরি। সেই পথে যা মানুষের বুদ্ধিকে প্রজ্ঞায়, হৃদয়কে মমতায় ও আল্লাহর পথে ডাকে কোমল পন্থায়- যা জীবন দেয়, দূরে ঠেলে দেয় না।

আর যদি মহানবী (সা.)-এর চরিত্র নিয়ে কথা বলতে যাই, তাহলে কোনো ভাষা তা যথাযথভাবে বোঝাতে পারবে না। তার চরিত্র ছিল জীবন্ত নমুনা, তার দয়া যেন চলমান করুণা। ক্ষমা ছিল তার স্বভাব, দান ছিল অভ্যাস, আর নম্রতা ছিল তার পথ। তিনি ক্ষমা করতেন তাকে কষ্ট দেওয়া লোকদের, সম্পর্ক রাখতেন যারা তা ছিঁড়ে দিয়েছে, সম্মান দিতেন যারা তাকে অপমান করেছে। তিনি দুঃখীদের সান্ত¡না দিতেন, এতিমদের মাথায় হাত রাখতেন, ছোটদের স্নেহ করতেন ও বড়দের সম্মান করতেন। তিনি কখনও ধনী-গরিবের মাঝে বৈষম্য করতেন না। সাথীদের সঙ্গে তিনি মিশতেন, মন দিয়ে তাদের কথা শুনতেন, তাদের আপনজন মনে করতেন। তবুও তার মধ্যে এমন এক সম্মান ও মহত্ব ছিল, যা হৃদয়কে আকৃষ্ট করত ও মনকে জয় করে নিত।

উহুদের যুদ্ধে, যখন তার পবিত্র কপাল ভেঙে গিয়েছিল, মুখ রক্তে ভেসে গিয়েছিল- তখনও তার অন্তর প্রতিশোধ ভাবনায় ভরেনি, তার মুখে কোনো বদদোয়া আসেনি। তিনি কষ্টের ঊর্ধ্বে উঠেই বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আমার জাতিকে ক্ষমা করো। কেননা, তারা জানে না।’ (বোখারি : ৩৪৭৭)।

মক্কা বিজয়ের দিন, যারা তাকে কষ্ট দিয়েছিল, তাড়িয়ে দিয়েছিল, তারা মাথা নিচু করে যখন তার সামনে দাঁড়িয়েছিল- তখন নবী করিম (সা.) ছিলেন ক্ষমতার শীর্ষে। তিনি চাইলে কঠিন প্রতিশোধ নিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তরবারি তোলেননি, বরং ক্ষমার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। আর তিনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ (সুরা ইউসুফ : ৯২) অতএব, ভাবুন তো, যদি একটি জাতি এই মহানুভবতা, এই চরিত্র ধারণ করে- তাহলে কেমন হতো তাদের অবস্থা? যদি তাদের আত্মা এই নৈতিকতা দিয়ে গড়া হতো, হৃদয়গুলো যদি এই সুবাসে স্নাত হতো- তাহলে তাদের ব্যবহার হতো পবিত্র, সম্পর্ক হতো উদার ও ঐক্য হতো সুদৃঢ়। তারা হয়ে উঠত মর্যাদা ও বিজয়ের চূড়ায় উন্নীত এক জাতি।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সবদিক থেকেই মহান ছিলেন। তিনি ছিলেন এমন এক নেতা যিনি মানুষকে গড়তেন, এমন এক শাসক যিনি একটি জাতিকে পরিচালনা করতেন ও একটি সভ্যতার ভিত্তিস্থাপন করতেন। তিনি ছিলেন, প্রেমময় স্বামী, যিনি নিজের ঘরের দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি ছিলেন- কৃতজ্ঞ বান্দা, যিনি গভীর রাতে আল্লাহর সামনে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়াতেন যে, তার পা ফুলে যেত।

তিনি ছিলেন জ্ঞানী ও সংস্কারক, যিনি সমাজের নানা সমস্যার সমাধান করতেন। প্রতিটি দিকেই তিনি ছিলেন অনন্য এক আদর্শ- যাকে নির্দ্বিধায় অনুসরণ করা যায়।

মহানবী (সা.) যখন জীবনের শেষদিকে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখনও তার চিন্তা ছিল তার উম্মত। তার শেষ কথাগুলোর মধ্যে ছিল, ‘তোমরা নামাজের প্রতি যত্নবান থেকো ও তোমাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদের প্রতি খেয়াল রেখো।’ জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি সাহাবিদের দিকে মমতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, যেন বিদায় নিচ্ছেন। তারপর ঘরে ফিরে গিয়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশা (রা.)-এর কোলে মাথা রেখে পৃথিবীকে বিদায় জানান।

মদিনা কেঁপে উঠেছিল; কিন্তু তার আলো নিভে যায়নি। তার সুন্নাহ আজও জীবন্ত, তার শিক্ষা আজও উজ্জ্বল। শরীর বিদায় নিয়েছে; কিন্তু প্রভাব, শিক্ষা ও আমানত রেখে গেছেন উম্মতের জন্য- যেন তারা তার দেখানো পথে চলে, তার সুন্নাহ অনুসরণ করে ও তার বার্তা দুনিয়ার মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন ও তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)।

(১১-১১-১৪৪৬ হিজরি মোতাবেক ০৯-০৫-২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ তারিখে মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন আবদুল কাইয়ুম শেখ)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত