ঢাকা শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা ঈমান

ফরহাদ বিন মোস্তফা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা ঈমান

পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে এমনকি নিজের, নিজ পরিবারের ও সন্তান-সন্ততির চেয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সর্বাধিক ভালোবাসা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অবশ্য কর্তব্য। রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসার দাবি হলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল প্রদত্ত সকল বাণী ও বিধানকে মেনে নেওয়া এবং এগুলোর কোনো একটিকেও উপেক্ষা না করা। অথচ রাসুল (সা.)-এর ওপর পবিত্র এই ভালোবাসার ক্ষেত্রে কতিপয় মুসলমান অতিভক্তির আতিশয্যে বিভিন্ন রকম শিরক-বেদয়াতে লিপ্ত হয়ে থাকে।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসা ঈমানি দায়িত্ব

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ভালোবাসার বেশ কিছু ঈমানি আলামত বা নিদর্শন রয়েছে। এখানে কিছু আলামত উল্লেখ করা হলো-

সৃষ্টির সব কিছুর চেয়ে নবীজির ভালোবাসাকে প্রধান্য দেওয়া : রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল। তিনি পৃথিবীবাসীর প্রতি প্রেরিত রহমতস্বরূপ। তাই তাঁকে যথাসাধ্য ভালোবাসতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বলো, তোমাদের বাবা, ছেলে, ভাই, স্ত্রী, নিজ বংশ ও ধন-সম্পদগুলো তোমরা যা আয় কর, ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা হওয়ার আশঙ্কা কর এবং বাসস্থান, তোমরা যাকে ভালোবাস, আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে যদি এগুলো অধিক প্রিয় হয়; তাহলে তোমরা আল্লাহর শাস্তি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত দান করেন না।’ (সুরা তওবা : ২৪)।

বাবা-ছেলের চেয়ে রাসুল (সা.)-কে অধিক ভালোবাসা : আল্লাহ বলেন, ‘নবী (মুহাম্মাদ) মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ট এবং তাঁর স্ত্রীরা মুমিনদের মা। আল্লাহর কিতাবে রক্ত সম্পর্কীয়রা পরস্পরের অধিক নিকটবর্তী অন্যান্য মুমিন ও মুহাজিরদের চেয়ে। তবে তোমরা যদি তাদের প্রতি সদাচরণ কর সেটা স্বতন্ত্র বিষয়। আর এটাই মূল কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে।’ (সুরা আহজাব : ৬)।

পরিবার এবং ধন-সম্পদের চেয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে অধিক ভালোবাসা : রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে সর্বাধিক প্রিয় হব তার পরিবার, ধন-সম্পদ ও সকল মানুষ থেকে।’ (মুসলিম : ৪৪)।

জীবনের চেয়ে রাসুলল্লাহ (সা.)-কে সর্বাধিক ভালোবাসা : আব্দুল্লাহ বিন হিশাম (রা.) বলেন, ‘একবার আমরা নবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি তখন ওমরের হাত ধরেছিলেন। ওমর (রা.) তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার নিজের জীবন ছাড়া আপনি আমার কাছে সব কিছুর অধিক প্রিয়। তখন নবী (সা.) বললেন, ‘না। যার হাতে আমার প্রাণ, ওই সত্তার কসম! যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার জীবনের চেয়ে প্রিয় হবো (ততক্ষণ পর্যন্ত তুমি পূর্ণ মমিন হতে পারবে না)। এ কথা শুনে ওমর (রা.) তাঁকে বললেন, আল্লাহর কসম! এখন আপনি আমার কাছে আমার নিজের জীবনের চেয়ে অধিক প্রিয়। তখন নবী (সা.) বললেন, হে ওমর, তুমি এখন প্রকৃত ঈমানদার হতে পারলে।’ (বোখারি, ৬৬৩২)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত যথাযথভাবে ভালোবাসা : তাঁর নির্দেশিত যেকোনো বিষয় মেনে নেওয়া এবং সে বিষয়ে কোনোরূপ অপরাগতাণ্ডআপত্তি পেশ না করা। সেইসঙ্গে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহগুলোর কোনো একটি নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করা। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের কথা তো শুধু এটাই হবে, যখন তাদের আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের দিকে আহ্বান করা হয় তাদের মধ্যে মীমাংসা করার জন্য, তখন তারা বলবে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর তারাই হবে সফলকাম।’ (সুরা নুর : ৫১)।

নবীজির (সা.)-এর সিরাত গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করা : রাসুল (সা.)-এর জীবন চরিত গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করা এবং তাঁর আদর্শে মুমিনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনকে সাধ্যমতো ঢেলে সাজানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখা।

রাসুল (সা.)-এর ওপর অধিকহারে দরুদ ও সালাম প্রেরণ করা : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মর্যাদা স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত। তাই তাঁর ওপর অধিকহারে দরুদ ও সালাম প্রেরণ করা মুমিনের জন্য আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর প্রতি দরুদ প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ, তোমরা তাঁর প্রতি দরুদ ও যথাযথভাবে সালাম প্রেরণ করো।’ (সুরা আহজাব : ৫৬)।

রাসুল (সা.)-এর সাহাবি ও পরিবারকে ভালোবাসা : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবি এবং পরিবারদের ভালোবাসা প্রতিটি মুমিনের ঈমানি দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘যারা পরে ইসলামের ছায়াতলে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের ও আমাদের ভাইদের ক্ষমা কর, যারা ঈমানের ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রবর্তী। আর যারা ঈমান এনেছে তাদের ব্যাপারে আমাদের অন্তরে কোনোরূপ হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক, নিশ্চয়ই তুমি অতিশয় করুণাময়, পরম দয়ালু।’ (সুরা হাশর : ১০)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের উদগ্র বাসনা : রাসুুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে জান্নাতবাসী হওয়ার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের উদগ্র বাসনা সবসময় জাগ্রত রাখা। সেইসঙ্গে ফরজ ও সুন্নতসমূহের প্রতি পূর্ণভাবে যত্নশীল হওয়া আবশ্যক। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের মধ্যে আমাকে অত্যধিক ভালোবাসবে কিছু ব্যক্তি, যারা আমার বিগত হওয়ার পর আসবে। তাদের মধ্যে কেউ এমন আকাঙ্ক্ষা পোষণ করবে যে, যদি সে তার পরিবার-পরিজন এবং ধন-সম্পদের বিনিময়েও আমাকে দেখতে পেত!’ (মুসলিম : ২৮৩২)।

আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শত্রুদের সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করা : যারা ইসলামের শত্রু, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শত্রু, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী তাদের কাউকে তুমি এমন পাবে না যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। যদিও তারা তাদের পিতৃপুরুষ, সন্তানাদি, ভ্রাতৃত্বমণ্ডলি অথবা নিকটাত্মীয় হয়।’ (সুরা মুজাদালা : ২২)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নত রক্ষায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা : চতুর্থ হিজরিতে রাসুল (সা.) কর্তৃক প্রেরিত ‘বিরে মাউনা’র দাওয়াতি কাফেলার অন্যতম সদস্য হারাম বিন মিলহান (রা.)-কে যখন পেছন থেকে বর্শা নিক্ষেপ করা হয়, তখন তিনি নিজ দেহের ফিনকি দেওয়া রক্ত দু’হাতে নিজের চেহারা এবং মাথায় মেখে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার, কাবার রবের কসম! আমি সফলকাম হয়েছি। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অর্থাৎ রাসুল (সা.)-এর নির্দেশে দাওয়াত প্রদান ও সুন্নতকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আর শাহাদত লাভের মাধ্যমে তিনি সফল হয়েছেন।’ (ফাতহুল বারি শরহে বোখারি, ৪০৯০)।

শরিয়তের সর্বোচ্চ ধারক হিসেবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মেনে নেওয়া : রাসুল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন হলো, রাসুল (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত বিধান সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তোমার প্রতিপালকের কসম, তারা ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারে না, যতক্ষণ তারা তাদের মীমাংসার বিষয়ে তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে না নেবে। অতঃপর তোমার প্রদত্ত সিদ্ধান্তে তাদের অন্তরে কোনোরূপ কুটিলতা রাখবে না এবং সম্পূর্ণরূপে তা মেনে নেবে।’ (সুরা নিসা : ৬৫)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সম্মান যথাযথভাবে বজায় রাখা : পৃথিবীর দিকে দিকে নাস্তিক-মুরতাদরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের শান-মান হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য সদা অপতৎপর থাকে। তাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের উচ্চ সম্মান যথাযথভাবে বজায় রাখার জন্য মুমিনদের সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যারা আনুগত্য করে এই রাসুলের যিনি নিরক্ষর নবী, এ বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজিলে লিখিত পেয়েছে। যিনি তাদের সৎকর্মের নির্দেশ দেন ও অসৎকর্ম থেকে নিষেধ করেন। তিনি তাদের জন্য পবিত্রগুলো হালাল করেন ও অপবিত্রগুলো নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের ওপর থেকে বোঝা ও শৃঙ্খলগুলো নামিয়ে দেন যা তাদের ওপরে ছিল। অতএব, যারা তার ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাকে সম্মান করেছে ও সাহায্য করেছে এবং সেই জ্যোতির্ময় কোরআনের অনুসরণ করেছে, যা তার সঙ্গে নাজিল হয়েছে, তারাই হলো প্রকৃত সফলকাম।’ (সুরা আরাফ : ১৫৭)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণীকে উপেক্ষা না করা : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কোনো নির্দেশ, হাদিস অথবা বিধান পেলে মাথা পেতে মেনে নেওয়া জরুরি। আল্লাহ বলেন, ‘কোনো মুমিন পুরুষ বা মুমিন নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোনো অধিকার নেই, যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোনো নির্দেশ প্রদান করেন। যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্যতা করবে, সে সুস্পষ্টভাবে পথভ্রষ্ট হবে।’ (সুরা আহজাব : ৩৬)।

রাসুল (সা.)-এর আনীত বিধানকে বাস্তবায়ন করা : বিভিন্ন তন্ত্র-মন্ত্র, ইজমণ্ডতরিকা, জাতীয় ও বিজাতীয় মতবাদগুলোকে পরিহার করে আল্লাহ প্রেরিত অহির (প্রত্যাদেশ) আলোকে ঈমান আনয়ন করা প্রতিটি মুমিনের জরুরি কর্তব্য। কেননা, রাসুল (সা.)-এর আনীত বিধান আল্লাহরই প্রেরিত অহি। আল্লাহ বলেন, ‘কসম নক্ষত্ররাজির যখন সেগুলো অস্ত যায়। ‘তোমাদের সাথি ভ্রষ্ট হয়নি এবং ভ্রান্তও হয়নি। আর সে খেয়াল-খুশিমতো মনগড়া কোনো কথাও বলে না। সেটি তো শুধুমাত্র অহি ছাড়া নয়, যা তাঁর কাছে পাঠানো হয়। (সুরা নাজম : ১-৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনীত বিধানে ঈমান আনা ও তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়ন করা তাঁকে ভালোসার অন্যতম প্রধান শর্ত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত