নিভু নিভু অবস্থায় জ্বলে উঠলেন নাজমুল হোসেন শান্ত। শুধু জ্বলে উঠেই ক্ষ্যান্ত হননি বাংলাদেশের অধিনায়ক, রীতিমত নিজেকে বিস্ফোরিত করে গড়লেন বিরল এক কীর্তি। অপরদিকে ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে এসেও মুশফিকুর রহিম বুঝিয়ে দিলেন এখনও ফুরিয়ে যাননি তিনি। ব্যাটে বলে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে ঘুরে দাঁড়াল লাল সবুজের প্রতিনিধিরা। টাইগারদের সময়টা ভাল যাচ্ছিল না মোটেও। দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ড্র এবং সবশেষ আরব আমিরাত এবং পাকিস্তানের সিরিজ হারের পর জাতীয় দল আত্মবিশ্বাসের তলানিতে অবস্থান করছিল। সেখান থেকে বিদেশের মাটিতে পাঁচ দিন দাপুটে ক্রিকেট খেলে ড্র করাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্ট দিয়ে শুরু হয়েছে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের নতুন চক্র। তাতে বাংলাদেশের শুরুটা স্বপ্নের মতো না হলেও অন্তত পরিস্থিতির বিচারে উতরে যায়।
জয়ের জন্য ৩৭ ওভারে শ্রীলঙ্কার সামনে ছিল ২৯৬ রানের অসম্ভব লক্ষ্য। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সেটা তাড়া করার দিকে এগোল না দলটি। বাংলাদেশও পারল না সীমিত সময়ের মধ্যে ১০ উইকেট তুলে নিতে। ফলে লঙ্কান তারকা অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসের বিদায়ী টেস্ট শেষ হলো সমতায়। গতকাল শনিবার গল টেস্টের পঞ্চম দিনে স্বাগতিকরা দ্বিতীয় ইনিংসে ৩২ ওভারে ৪ উইকেটে ৭২ রান তোলার পর ড্র মেনে নেয় দুই দল। এর আগে টাইগাররা দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে ৬ উইকেটে ২৮৫ রান তুলে। আগের দিনের ৩ উইকেটে ১৭৭ রান নিয়ে খেলতে নেমেছিল তারা। এদিন আরও ৩০ ওভার ব্যাট করে ১০৮ রান দলটি যোগ করে ৩ উইকেট খুইয়ে।
গল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ড্রয়ের দেখা মিলল প্রায় ১২ বছর পর। সবশেষ ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার ম্যাচই শেষ হয়েছিল সমতায়। মাঝে অনুষ্ঠিত ২৬ টেস্টের প্রতিটিতেই জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছিল। বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরির স্বাদ নিয়ে বেশ কিছু কীর্তি গড়েন। চারে নামা বাঁহাতি ব্যাটার দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৫ রানে অপরাজিত থাকেন। ১৯৯ বল মোকাবিলায় ৯ চার ও ৩ ছক্কা আসে তার ব্যাট থেকে। প্রথম ইনিংসেও শতরানের দেখা পেয়েছিলেন তিনি। ২৭৯ বলে ১৫ চার ও ১ ছয়ে করেছিলেন ১৪৮ রান।
শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৮ রান করতে হারিয়ে ফেলে ৪ উইকেট। এরপর ক্রিজে বাকি সময় কাটিয়ে দেন কামিন্দু মেন্ডিস (৩৫ বলে ১২ রান) ও অধিনায়ক ধনঞ্জয়া ডি সিলভা (৩০ বলে ১২ রান)। টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে ম্যাথিউস আউট হন ৮ রানে। ৪৫ বল খেলে তিনি শিকার হন তাইজুল ইসলামের। সিলি পয়েন্টে চমৎকার ক্যাচ নেন মুমিনুল হক। বাংলাদেশের দুই স্পিনার শেষদিনে বল হাতে আলো ছড়ান। আগের ইনিংসে হতাশ করা বাঁহাতি তাইজুল ২৩ রানে নেন ৩ উইকেট। অফ স্পিনে নাঈম হাসান ১ উইকেটের জন্য খরচ করেন ২৯ রান। পেসারদের মধ্যে হাসান মাহমুদ আক্রমণে গেলেও নাহিদ রানাকে দিয়ে বল করাননি শান্ত।
কিছুটা রোমাঞ্চের আভাস মিললেও বাংলাদেশ দল দ্রুত রান উঠিয়ে জেতার তাড়না দেখায়নি। শান্ত ও অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম দিনের শুরুতে ছিলেন সাবধানী। মুশফিকের বিদায়ের পর ৭৬ ওভারে সফরকারীদের রান যখন ছিল ৪ উইকেটে ২৩৭, তখন নামে বৃষ্টি। এরপর প্রায় তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকে খেলা। ফের তা চালু হলে আরও ১১ ওভার ব্যাট করে বাংলাদেশ। লিড তিনশর কাছে নিয়ে এরপর ইনিংস ঘোষণা করে তারা। ১৯০ বলে সেঞ্চুরি পূরণের পর উত্তাল হয়ে শান্তর ব্যাট। মুখোমুখি হওয়া পরের ৯ বলে ৩ ছক্কাসহ ২৫ রান আনেন তিনি। তবে ব্যক্তিগত মাইলফলক পূর্ণ করার আগে কোনো ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা ছিল না তার মধ্যে। একের পর এক বল ডট দেন তিনি। এছাড়া, মুশফিক ৪৯ রান করতে খেলেন ১০২ বল।
বাংলাদেশ ইনিংস ছেড়ে দেওয়ার সময়ই ধারণ মিলেছিল, ড্রয়ের সম্ভাবনাই প্রবল। শেষ পর্যন্ত ঘটেছে সেটাই। বাংলাদেশের স্পিনাররা লঙ্কানদের চেপে ধরলেও এই টেস্টের ফল বের হওয়ার মতো যথেষ্ট সময় ছিল না। চলমান দুই ম্যাচের সিরিজটি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। গল টেস্ট ড্র হওয়ায় প্রতিযোগিতার নতুন চক্র (২০২৫-২৭) বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা শুরু করল সমান ৪ পয়েন্ট করে পেয়ে।
এই ড্রয়ে নিকটঅতীতে বাংলাদেশ দলের কঠিন সময়ে ভালো কিছুর সুবাতাশ প্রাপ্তি। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি, তিন ফরম্যাটেই বাজে ফল আসছিল বাংলাদেশের জন্য। সে হিসেবে টেস্টের নতুন চক্রে ড্রয়ে শুরু অবশ্যই প্রাপ্তি। পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করার এলিট গ্রুপে শান্তর নাম লেখানোও বড় প্রাপ্তি। যে তালিকায় আছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, ওয়ালি হ্যামন্ড, রিকি পন্টিংদের মতো নাম। সেখানে শান্ত ১৬তম।
তবুও এই টেস্ট জয়ের জন্য চেষ্টা না করা বাংলাদেশের প্রাপ্তিতে কাঁটা হয়ে থাকবে। চতুর্থ দিন থেকেই শান্ত ও মুশফিক শ্রীলঙ্কাকে বড় লক্ষ্য দেওয়ার জন্য দ্রুত রান তোলেননি।
বরং ধীর ব্যাটিংয়ে নিজেরাই ড্রয়ের দিকে ঠেলে নেন ম্যাচটিকে। এমনকি পঞ্চম দিন শুরু থেকেও এই জুটি ঝড়ো রান তোলায় মন দেয়নি। দ্রুত রান তুললে আরও আগেই শ্রীলঙ্কাকে ম্যাচের শেষ ইনিংসে ব্যাটিংয়ের আমন্ত্রণ জানানো যেতো। তখন বেশি সময় স্বাগতিকদের ব্যাটিংয়ে রেখে জয়ের চ্যালেঞ্জ দেওয়া যেতো। টেস্ট ক্রিকেটে এগিয়ে যেতে হলে জয়ের মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ। এই টেস্টে শান্ত ও মুশফিকের ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ সেই চেষ্টায় এগিয়েছে এমনটা কখনই মনে হয়নি। তাই ড্রয়েই সন্তুষ্ট বাংলাদেশ। কলম্বোতে আগামী বুধবার শুরু হবে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট।