
জীবনের অধিকাংশ সময় মাঠেই কাটিয়েছেন মাহবুব আলি জাকি। গতকাল শনিবার সকালে দলের অনুশীলনেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। তরতাজা সেই মানুষটি সন্ধ্যায় হাসপাতাল থেকে আবার মাঠে ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে। যে মাঠে ঢলে পড়েছিলে তার দলের ম্যাচ শুরুর আগে, দলের জয়ের পর সেই মাঠেই পড়ানো হলো তার জানাজা। তার এমন বিদায়ে দেশের ক্রিকেট আঙিনায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বর্তমান ও সাবেক অনেক ক্রিকেটারের হৃদয়ে বইছে হাহাকারের ঝড়। বোলিং নিয়ে মাহবুবের সঙ্গে অনেক কথা বলতেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকেই এই কোচকে পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। মুস্তাফিজুর রহমান ও হাসান মাহমুদের ক্যারিয়ারের হাঁটি হাঁটি পা পা করার দিনগুলোতে এই কোচই তাদেরকে শিখিয়েছেন শক্ত পায়ে পথ চলতে। তাসকিন আহমেদের ক্যারিয়ারে তার অবদান তো অমূল্য।
এভাবেই দেশের বিভিন্ন প্রজন্মের পেসারদের কাছে মাহবুব ছিলেন ভরসার প্রতিশব্দ। তার সংস্পর্শ পাননি, এমন পেসার খুব একটা পাওয়া যাবে না দেশে। এমন একজনকে হারিয়ে হাহাকার বর্তমান-সাবেক অনেক ক্রিকেটারের কণ্ঠে।
খেলোয়াড়ি জীবন শেষে ২০০৮ সাল থেকে বিসিবির কোচ হিসেবে কাজ করছিলেন মাহবুব। গেম ডেভেলপমেন্ট বিভাগের এই কোচ বিপিএলে কাজ করছিলেন ঢাকা ক্যাপিটালসের সহকারী কোচ হিসেবে। টুর্নামেন্টে দলের প্রথম ম্যাচের ঠিক আগে মাঠেই হার্ট অ্যাটাক করেন ৫৯ বছর বয়সী কোচ। মৃত্যু হয় হাসপাতালে নেওয়ার পথে।
সামাজিক মাধ্যমে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন ক্রিকেটারদের অনেকেই। মাহবুবের সঙ্গে বোলিং নিয়ে কথোপকথনের স্মৃতি মনে করলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেশের সফলতম পেসার মাশরাফি। ‘জাকি ভাই, জীবনে আপনার সঙ্গে বোলিং নিয়ে কতবার কথা বলেছি, তার কোনো হিসাব নেই। বোলিংয়ের বায়োমেকানিক্স বাংলাদেশে সম্ভবত আপনিই সবচেয়ে ভালো বুঝতেন। আজ আপনি আপনার প্রিয় সেই মাঠ থেকেই বিদায় নিলেন। ওপারে ভালো থাকবেন ভাই। মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাত নসিব করুন, আমিন...।’
প্রিয় আঙিনা থেকে মাহবুবের বিদায়ের ব্যাপারটি ফুটে উঠল সাকিবের লেখাতেও। ‘কোচ মাহবুব আলি জাকির বিদায়ে আমি স্তব্ধ ও গভীরভাবে শোকাহত। পেশাদার ক্রিকেটের শুরুর দিনগুলি থেকে তাকে চিনতাম। তার সঙ্গে মেশার প্রিয় স্মৃতিগুলো মনে পড়ছে। তার শেষ মুহূর্তগুলি ছিল ক্রিকেট মাঠেই, যা করতে তিনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তার পরিবারের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা।’
মাহবুবের এমন মৃত্যুর ব্যাপারটি সবচেয়ে বেশি অনুভব করতে পারছেন হয়তো তামিম ইকবাল। গত মার্চে ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচে এভাবেই মাঠে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সাবেক অধিনায়কের শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তা ফুটে উঠলো। ‘জাকি ভাইয়ের আকস্মিক প্রয়াণে গভীর শোকে স্তব্ধ হয়ে আছি। ক্রিকেট মাঠে আমি নিজেও একই রকম ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম, আজও সেই স্মৃতি বুক কাঁপিয়ে তোলে। আল্লাহর অশেষ রহমতে তখন বেঁচে গিয়েছিলাম, কিন্তু জাকি ভাই আমাদের মাঝ থেকে চিরতরে চলে গেলেন। আল্লাহ জাকি ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এই অসহনীয় বেদনা সহ্য করার শক্তি ও ধৈর্য দান করেন।’
মোস্তাফিজুর রহমান ফিরে গেলেন ক্যারিয়ারের শুরুর সেই সময়টায়, যখন তিনি দেশের ক্রিকেটের মূল স্রোতে ঢুকছেন। সেই সময়টায় তিনি পাশে পেয়েছিলেন মাহবুবকে। ‘পেসার হান্টের মাধ্যমে যখন নির্বাচিত হই, মাহবুব আলি জাকি স্যার ছিলেন আমার প্রথম কোচ। ক্যারিয়ারে অনেকবার তিনি আমাকে সহায়তা করেছেন। জাকি স্যারের চলে যাওয়ার খবর জেনে হৃদয় ভেঙে গেছে।’ তাসকিনের ক্যারিয়ারে কোনো একজন কোচের কথা যদি বলা হয়, সবচেয়ে বেশি অবদান নিঃসন্দেহে মাহবুবের। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় বোলিং অ্যাকশনে ত্রুটির কারণে নিষিদ্ধ হয়ে যখন তার ক্যারিয়ার অনিশ্চয়তার মোড়ে, তখন তাকে ভরসা জুগিয়েছিলেন মাহবুব। সহজাত গতি ও ধার ধরে রেখেই তার অ্যাকশন শুধরে দেওয়া, তাকে শাণিত করার কাজটি করেছেন এই কোচ।
এবারের বিপিএলেও মাহবুবের দলেই আছেন তাসকিন। তবে আইএল টি-টোয়েন্টি খেলে এসে বিশ্রামে থাকায় শনিবারের ম্যাচে তিনি ছিলেন না। দুজনের আর দেখা হবে না। প্রয়াত কোচের প্রতি তিনিও জানালেন শ্রদ্ধা। ‘হুট করে হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা ক্যাপিটালসে আমাদের সহকারী কোচ মাহবুব আলি জাকি আজকে মারা গেছেন। ম্যাচের আগে ক্রিকেটারদের সঙ্গে গা গরম করছিলেন তিনি। শান্তিতে ঘুমান কোচ। তার পরিবার ও পুরো ঢাকা ক্যাপিটালস পরিবারের জন্য গভীর সমবেদনা।’ শরিফুল ইসলামের স্মৃতি এখনও অনেক টাটকা। বিপিএলে তিনি মাহবুবের দলে খেলছেন না, তবে একদিন আগেও দেখা ও আড্ডা হয়েছে। পঞ্চগড়ের প্রতিভা শরিফুল নানা ধাপ পেরিয়ে যখন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলে এলেন, তার ফিটনেস খুব ভালো ছিল না, পেস খুব বেশি ছিল না। তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে ফিটনেস ও অ্যাকশন নিয়ে কাজ করলেন মাহবুব। ১২৫ কিলোমিটার থেকে এই বাঁহাতি পেসারের গতি ছাড়িয়ে গেল ১৩৫। যুব বিশ্বকাপে তো ১৪০ কিলোমিটার ছাড়িয়েও গিয়েছিল।
প্রিয় কোচের এমন বিদায় মানতেই পারছেন না শরিফুল। ‘খবরটা শুনে এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, আপনি আর আমাদের মাঝে নেই মাহবুব আলি জ্যাকি স্যার। অনূর্ধ্ব-১৯ সময় থেকে আপনার হাত ধরেই আমাদের শেখা শুরু, এরপর বিশ্বকাপ জয়-প্রতিটি মুহূর্তে আপনি পাশে ছিলেন অভিভাবকের মতো। গত পরশু দিনও প্র্যাকটিসে আমরা কত হাসি-আড্ডা করেছি, ভাবতেই বুকটা ভার হয়ে আসে।’