প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ নভেম্বর, ২০২৫
এক ইহুদি, একজন খ্রিষ্টান ও একজন মুসলমান একসঙ্গে সফরে যাচ্ছিলেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, চিন্তা ও বিশ্বাসে মিল নেই এমন দুজন খারাপ লোকের সঙ্গে একজন মুসলমান কীভাবে সফরসঙ্গী হল? মওলানা বলেন, মানুষের ভেতরে নফস আছে, তার দোসর শয়তানও আছে। উভয়ই খারাপ। কিন্তু জীবন পরিচালনার জন্য উভয়ের সঙ্গে রুহকেক বসবাস করতে হয়। ব্যাপারটিও এই রকম। অনেক সময় কাক, প্যাঁচা ও বাজপাখি একই খাঁচায় বন্দি হয়। অথবা কারাগারে ভালো মানুষ, মুত্তাকী লোককে দাগি অপরাধির সঙ্গে সময় কাটাতে হয়। খাঁচা ভাঙলে, কারাগার থেকে মুক্তি পেলে প্রত্যেকে উড়ে যায় আপন ভুবনে।
এরা তিন মুসাফির একটি মহল্লায় গিয়ে যাত্রা বিরতি করে। গ্রামের দানশীল এক ব্যক্তি তিন মুসাফিরের জন্য একবাটি হালুয়া পাঠায়। ভিনদেশি আগন্তুকদের মেহমানদারি তো গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য। মওলানা বলেন, এই ঐতিহ্য আল্লাহ প্রদত্ত্ব। আল্লাহতায়ালা গ্রাম্য লোকদের মনে মেহমানদারীর একটি যোগ্যতা ও আন্তরিকতা আমানত রেখেছেন, যা শহুরে লোকদের দেননি।
আজ জেয়াফা লিল গরিবে ওয়াল কেরা
আওদাআর রাহমানু ফি আহলিল কুরা
আগন্তুকদের মেহমানদারি আর আপ্যায়ন
গ্রামের লোকদের আল্লাহ করেছেন দান।
গ্রামের দানশীল লোকটির পক্ষ হতে যখন হালুয়ার বাটি আসে, তখন মুসলমান লোকটি ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিল। সে হালুয়া খেতে চাইলে ইহুদি ও খ্রিষ্টান তাকে বাধা দিল। বলল, তাড়াহুড়ার দরকার নেই। আজ আমাদের ক্ষিধা নেই। সবর কর, সবরে মেওয়া ফলে। কাল সকালে এই হালুয়া দিয়ে ভালো নাশতা হবে। ক্ষুধার্ত মুসলমান বলল, সবর সবরের জায়গায় থাক। সবরকে কালকের জন্য রেখে দাও। আজ রাতেই হালুয়াটা হালাল করা হোক। তারা দুজনে একই ভাষায় মুসলমানকে অভিযুক্ত করে বলল, তোমার দার্শনিক কথাবার্তার উদ্দেশ্য হলো, তুমি হালুয়া একাই সাবাড় করতে চাও। মুসলমান বলল, দেখ, আমরা তিনজন। তোমরা এখন খেতে না চাইলে তিন ভাগ কর। যার ইচ্ছা এখন খাবে যার ইচ্ছা কাল সকালের জন্য জমা রাখবে। কিন্তু তারা তাতে রাজি নয়। তাদের আনন্দ হলো, মুসলমান সারা রাত যেন উপোষ কাটায়। মুসলমমান শেষ পর্যন্ত তাদের দাবির কাছে হার মানে। সাব্যস্ত হল, আজ রাতে যে যা স্বপ্ন দেখবে সকালে উঠে তার বিবরণ দেবে। যার স্বপ্ন অধিক সুন্দর ও উন্নত হবে হালুয়া তারই ভাগ্যে জুটবে।
সকাল হলে তিনজন যার যার মতো নামাজ দোয়া প্রার্থনা শেষে বসে গত রাতের স্বপ্নের বর্ণনা শুরু করল। ইহুদি বলল, আমি গেল রাতে স্বপ্নে দেখি যে, মুসা (আ.) এসে আমাকে কুহে তুরে নিয়ে গেছেন। আল্লাহর প্রেমে মত্ততার নানা কথা শোনালেন। কীভাবে কুহে তুর আল্লাহর নুরের তাজাল্লিতে উন্মাতাল হয়ে জ্বলে গিয়েছিল আর মুসা (আ.) মুর্ছিত হয়েছিলেন তার বিবরণ দিচ্ছিলেন। তার কথা শেষ হলে খ্রিষ্টা লোকটি বলল, হ্যাঁ, গেল রাতে আমার স্বপ্নটা আরও বিস্ময়কর ছিল। আমি ঘুমিয়ে আছি। এমন সময় দেখি স্বয়ং ইসা (আ.) আমাকে জাগিয়ে তুললেন। বললেন, চল, আমার সঙ্গে চতুর্থ আসমানে চলো। সেই যে আল্লাহর নবীর হাত ধরে চতুর্থ আসমানে গেলাম, আধ্যাত্মিক জগতের কত রহস্য আমার সামনে উদ্ভাসিত হলো তার বর্ণনা দেয়া কী সম্ভব। খ্রিষ্টান লোকটি ইহুদিকে বলল, তোমার স্বপ্ন সুন্দর, তবে তার সবটাই ছিল কূহে তূরে। পৃথিবীর মাটিতে। কিন্তু পৃথিবীর চেয়ে আসমানের মর্যাদা যে অনেক বেশি তা তো অস্বীকার করতে পার না। কাজেই যে স্বপ্নে আমি চতুর্থ আসমানে বিচরণ করেছি তার মর্যাদা অনেক বেশি।
এবার মুলসমান লোকটির পালা এলো। সে তো এতক্ষণ স্বপ্নের নামে কতক মিথ্যার বেসাতি শুনছিল উভয়ের কাছ থেকে। সে বলল, গেল রাতে নবীকুল শিরোমনি, প্রিয়নবী মুহাম্মাদ মুস্তফা (সা.)-কে স্বপ্নে দেখলাম। তিনি বললেন, তোমার দুই সাথি তো আল্লাহর নবীদের সঙ্গে ফেরেশতাদের মাঝে বিচরণ করছে। একজন কুহে তুরে পায়চারী করছে আরেকজন চতুর্থ আসমানে গেছে।
পস মোরা গোফত অন য়্যকি বর তুর তাখত
বা কলিমে হক ও নর্দে ইশক বাখত
আমাকে বললেন, একজন গেছেন প্রেমের তুর পর্বতে
মুসা কলিমুল্লাহর সাথি সে মত্ত প্রেমের আলাপনে।
অন দিগর রা ইসা সাহেব কেরান
বোর্দ বর অউজে চাহারোম আসেমান
আরেকজনকে আল্লাহর নবি ঈসা এসে
নিয়ে গেছেন চার আসমানে প্রেমের টানে।
ওদের বিচরণ আধ্যাত্মিক জগতে। তাদের মান মর্যাদার জুড়ি নেই। কিন্তু তুমি হে মুসলমান! তুমি তো সাদা মনের মানুষ। মজলুম। বসে আছ কিসের আশায়। তাড়াতাড়ি যাও। হালুয়াটা খেয়ে নাও।
ইহুদি ও খ্রিষ্টান তখন বলে উঠল, তাহলে কি তুমি হালুয়া খেয়ে ফেলেছ। মুসলমান বলল, উপায় ছিল না। আমি কী নবীজির আদেশ অমান্য করতে পারি? তুমি ইহুদি! মুসা (আ.)-এর অনুসারী। মুসা (আ) যদি তোমাকে আদেশ দেন তুমি কী সে আদেশ অমান্য করতে পারবে?। তোমার পছন্দ হোক বা অপছন্দ হোক, তোমাকে অবশ্যই সে আদেশ মানতে হবে। তুমি খ্রিষ্টান হয়ে বল, যদি ইসা (আ.) তোমাকে কোনো আদেশ দেন তুমি কি সে আদেশ লঙ্ঘন করতে পারবে? আমিও তো আখেরি নবীর উম্মত।
মন যে ফখরে আম্বিয়া সর চোন কশম
খোর্দে আম হালুয়া ও ইন দম সরখোশম
নবীদের যিনি গৌরব কী করে তার হুকুম অমান্য করি
হালুয়া খেয়েছি তাই এ মুহূর্তে ফুরফুরে আছি।
ইহুদি ও খ্রিষ্টান পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পালল, তারা সম্পূর্ণ ধরা খেয়েছে। অগত্যা তারা বলল, হ্যাঁ, হে মুসলমান ভাই! তোমার স্বপ্ন আমাদের স্বপ্নের চেয়ে শতগুণ উত্তম। তোমার স্বপ্নের কাছে আমাদের স্বপ্নের মান-উজ্জত ভূলুণ্ঠিত। আমাদের স্বপ্ন ছিল কল্পনার ভুবনে। অলিক অবাস্তবের পেছনে। কিন্তু তোমার স্বপ্ন ছিল বাস্তব। তোমার স্বপ্ন তোমাকে বেঘোর নিদ্রায় আচ্ছন্ন করেনি। বরং তোমার মধ্যে জাগৃতি এনে দিয়েছে। এই স্বপ্ন এই নিদ্রা শত জাগৃতির চেয়ে উত্তম।
হ্যাঁ, ভাই! কথার ফুলঝুরি দিয়ে নিজেকে জাহির করার বাতিক ছাড়। চালাকি, জ্ঞানের গরিমা, যোগ্যতার বাহাদুরি ফলানোর চেষ্টা বাদ দাও।
দর গুজার আজ ফজলো আজ জালদিও ফন
কার খেদমত দারদ ও খুলকে হাসান
জ্ঞানের বাহাদুরি, চালাকি ও চাতুর্য ছাড়
আসল হল আনুগত্য, মানুষের সেবা, সুন্দর চরিত্র।
আল্লাহর খাঁটি বান্দা হও। কৃত্রিমতা থেকে নিজেকে মুক্ত কর। চালাকি বুজরুকি দেখিয়ে মানুষের বাহবা নেওয়ার মানসিকতা ত্যাগ কর, এটিই জীবনের সুন্দর পথ। এজন্যেই মানুষকে আল্লাহর দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। কোরআন মজিদে আল্লাহ পাক এ কথাই বলেছেন, আমি জিন ও ইনসান, মানুষ ও জিন জাতিকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। ইবাদতের তাৎপর্য এটিই। এর বিপরীত পথটি গোমরাহীর। ধোঁকা ও প্রতারণার। চালাকি বাহাদুরি করে কেউ আল্লাহর কাছ থেকে নিস্তার পাবে না। তার উদাহরণ সামেরি।
মুসা (আ.)-এর সময়ে বনি ইসরাইলের মাঝে গোবাছুর পূজার প্রচলন করেছিল সামেরি। ফেরাউনের সলিল সমাধির পর নীলনদ পার হয়ে বনি ইসরাঈল যখন স্থিতিশীল হয় তখন মুসা (আ.) কূহে তুরে গমন করেন, তখন সামেরি নিজের যোগ্যতা বিচক্ষণতার জোরে বনি ইসরাইলকে তওহীদের ধর্মের বিপক্ষে দাঁড় করান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রতারণ তার গলার ফাঁশ হয়ে যায়। শত অণুনয়-বিনয় করে মুসা (আ.)-এর কাছ থেকে রসায়নবিদ্যা শিখেছিল কারুন। কিন্তু বিদ্যার অহংকার তাকে মুসা (আ.)-এর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল। কারণ বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছিল বটে; কিন্তু সেই সম্পদ তার শেষ রক্ষা করতে পারেনি। আবু জাহলের নাম ছিল আবুল হাকাম। জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের আধার। কিন্তু তার জ্ঞান পাণ্ডিত্য শেষ পর্যন্ত জাহান্নামে নিয়ে গেছে।
কাজেই হে যুক্তিবাদী! নিজের জ্ঞানবুদ্ধি যুক্তির জোরে তুমি সত্যকে আবিস্কার বা অস্বীকার করতে চাও, তোমার আগে যারা অহংকারের পথে অগ্রসর হয়ে ধ্বংসের গহ্বরে তলিয়ে গেছে তাদের জীবনের বাস্তব উদাহরণ সামনে রাখ। শুধু যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে সবকিছু মূল্যায়ন করার প্রবণতা পরিত্যাগ কর। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ২৩৮৬-২৫০৯)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন CHAYAPATH PROKASHONI)