প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫
তৃণ-লতাহীন মাঠে দাঁড়ানো জীর্ণশীর্ণ এক গাধাকে শিয়াল পাশের বনভূমিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। তার যুক্তি ছিল, রিজিক আল্লাহ দেবেন সত্য; কিন্তু তোমাকে খেটে খেতে হবে, কষ্ট করতে হবে, চেষ্টা-শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু গাধা তাকদিরের ফয়সালার দোহাই দেয়। তার সাফ কথা, আমার তাকদিরে যা লেখা আছে, তা ঘটবে। আমার জন্য বরাদ্দ রিজিক আমার কাছে আসবেই। প্রমাণ হিসেবে বুজুর্গবেশী এক লোকের গল্প শোনাল।
এক বুজুর্গ লোকালয় ছেড়ে মরু বিয়াবানে এক পাথুরে পাহাড়ের ধারে চলে গেল। একটি গাছের ছায়ায় ক্ষুধার্ত ক্লান্ত শরীরে শুয়ে রইল। মরুচারি একটি কাফেলা পথ হারিয়ে চলে যাচ্ছিল ওই পথে। কাফেলার লোকেরা লক্ষ্য করল, একজন লোক নিঃসঙ্গ একাকী ঘুমিয়ে আছে। কেন লোকটির এ অবস্থা? তাকে নাড়া দিল। লোকটি ইচ্ছা করেই কোনো কথা বলল না, নড়াচড়াও করল না। তারা ভাবল, নিশ্চয় লোকটি ক্ষুধায় কাতর হয়ে নিথর পড়ে আছে। গাটরি থেকে রুটি আর পানি বের করে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু বুজুর্গ মুখ খুলল না। খিল ধরে আছে দাঁতের দু’পাটিতে। তার মনের কথা, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেকের জন্য তাকদিরে বরাদ্দ খাবার অবশ্যই খেতে হবে।’ এ হাদিসের সত্যতা আজ পরীক্ষা করব। কাফেলার লোকেরা তড়িঘড়ি চামচ বের করে তার দাঁতের দু’পাটির মাঝখানে ঢুকিয়ে ফাঁক করল।
রীখতন্দ আন্দর দাহানাশ শূরবা
মী ফেশোরদান্দ আন্দরো নান পারেহা
ঢালছিল তার মুখ ফাঁক করে স্যুপ শুরবা
এর ফাঁকে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল রুটির টুকরা।
বুজুর্গ মনে মনে বলল, আমি পেয়ে গেছি। নবীজি (সা.)-এর বাণীর সত্যতা আমার সামনে দিবালোকের মতো সত্য হলো। সবর করলে প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ খাবার অবশ্যই আসবে। গাধার মুখে গল্পটি শোনার পর শিয়াল বলল, ছাড় তোমার এসব সাজানো গল্প। এই যে জগৎ সংসার, এখানে কলকারখানার মতো সব মানুষ কাজে তৎপর। এ সম্মিলিত তৎপরতার মাঝ থেকেই তোমার রিজিক খুঁজে পেতে হবে। মুফ্ত খাওয়া, সমাজের ওপর বোঝা হওয়া ইনসাফের কথা নয়। কষ্ট করা, পরিশ্রম করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করা পয়গম্বরের সুন্নত। আল্লাহর শ্বাশ্বত বিধান এটিই। এর বাইরে আল্লাহর ওপর ভরসার দোহাই দিয়ে নিষ্কর্ম বসে থাকা চরম বোকামী।
গাধা শিয়ালকে পাল্টা যুক্তি দিলো, তুমি যে আয়-উপার্জন, সংগ্রাম-সাধনার কথা বলছ, আমি তো মনে করি, আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করাই বড় সাধনার কাজ। আমি আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে তার শোকর আদায় করতে থাকব। এ শোকরই আমার জন্য আল্লাহর আরো নেয়ামত নিয়ে আসবে। শিয়াল যুক্তি দিল, আল্লাহ তো বলেছেন, তুমি নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না। যদি তুমি মরু বিয়াবানে পাথুরে জমিতে ভরসার নামে তপজপ কর আর মুখে তাওয়াক্কুল ও ভরসার দোহাই দাও, তা হবে নিজেকে ধ্বংস করার শামিল। শিয়াল আরো বলল, এ মাঠের ধারে সবুজ বনানী, হরেক রকম গাছপালা-উদ্ভিদ। দেখ বিস্তৃত নয়নজুড়ানো চারণভূমি। ফাঁকে ফাঁকে প্রবাহিত সুপেয় পানির ঝরনা। সেখানে গিয়ে কয়েক দিনেই তোমার শরীর মোটাতাজা হবে। চেহারায় নুরের ঝলক লাগবে।
কিন্তু গাধা তো গাধা। সে বলতে পারত, ওহে প্রতারক শিয়াল! এ বনের যদি এত জৌলুস হয়, তুমি তো সেখানে বাস কর, তুমি কেন এমন ক্ষীণকায়! তোমার চোখেমুখে কেন নুরের ঝলক নেই! তোমার চোখ দেখলে কেন প্রতারণার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। তুমি বনভূমির যে মহিমা বর্ণনা করছ, কই তোমার জীবনে তার চিহ্ন কোথায়? মওলানা রুমি (রহ.) আমাদের সম্বোধন করে বলেন-
নফসে তো তা মস্তে নুকল আস্ত ও নবীদ
দানকে রূহাত খোশেয়ে গাইবী নদীদ
মিষ্টান্ন ও শরাবে তোমার নফস মত্ত যখন
বুঝ যে তোমার রুহ দেখেনি গায়েবি ফুল কারণ।
তোমার মন যখন ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত, নফসে আম্মারার ফাঁদে পড়ে কামনা-বাসনার পেছনে জীবন উজাড় করে দিচ্ছ, তখন বুঝে নাও, তোমার রুহ গায়েবি জগতের ফুলের শাখা দেখেনি, আধ্যাত্মিক জগতের কোনো রহস্যজ্ঞান লাভ করেনি। অন্য কথায়- তুমি যে কামনা-বাসনা ও নফসের মধ্যে মজে আছ, তা এ কথার প্রমাণ, তুমি আধ্যাত্মিক জগতের সুবাস-সুসংবাদ পাওনি। হাকিকত থেকে তুমি অনেক দূরে।
কে আলামাত আস্ত যান দীদারে নূর
আত্তাজাফী মিনকা আন দারিল গুরুর
নুরের দেশের সন্ধানের আলামত যথা
প্রতারণার দেশ থেকে তোমার বিচ্ছিন্নতা।
তুমি যদি নুরের দেশের সন্ধান পেয়ে থাক, সেই দেশের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ থাকার দাবি যদি সত্য হয়, তাহলে অবশ্যই তুমি প্রতারণার এ দেশ, পার্থিব ভোগ-বিলাসিতা ও কামনা-বাসনা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে, সতর্ক দূরত্ব বজায় রাখবে। মুখে আমি আরিফ বিল্লাহ, আল্লাহর অলি-পীরে কামেল, ফানা ফিল্লাহ দাবি করলে হবে না। তার পক্ষে দলিল পেশ করতে হবে। সেই দলিল হলো, দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা থেকে বিচ্ছিন্নতা।
যারা দুনিয়া নিয়ে ব্যস্ত, ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত, অন্যায়-অপকর্মে লিপ্ত, তারা যদি ধর্মের দোহাই দেয়, ঈমানদারির দাবি করে আর বুজুর্গের মতো আধ্যাত্মিকতার ফুলঝুরি বিলায়, বুঝে নাও, তারা হাকিকতে ঈমানে পৌঁছেনি। এরা মুখের বুলিতে বুজুর্গ। ঈমানের স্বাদণ্ডবঞ্চিত বকধার্মিক। অন্ধ অনুকরণকারী। তাদের সামনের পথ বড় কঠিন। চোর, ডাকাত, শয়তান ওঁৎপেতে আছে। যে কোনো সময় গোমরাহিতে নিয়ে যেতে পারে। কাজেই শুধু মুখের বুলি, ভাষার ফুলঝুরি নয়, অন্তরের চোখ খুলতে হবে। হাকিকতে ঈমানে পৌঁছাতে হবে।
চোঁঙ্কে চশমশ বায শুদ ওয়ান নকশ খান্দ
দীভ রা বর ওয়েই দিগার দস্তী ন মান্দ
যখন তার চোখ খুলে যায় ও নকশা পড়ে
দৈত্যের প্রভাব আর চলে না তার ওপরে।
অন্ধ অনুকরণকারীর দিলের চোখ যখন খুলে যায়, যখন হাকিকতের নকশা তার নজরে আসে, তখন এমন আত্মিক শক্তিতে বলিয়ান হয়, যার ফলে শয়তান তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বিভ্রান্তদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, তারা ছাড়া আমার বান্দাদের ওপর তোমার (শয়তানের) কোনো ক্ষমতা থাকবে না।’ (সুরা হিজর : ৪২)। গাধার বেলায়ও কথাটি সত্য হলো। সে শিয়ালের জবাবে যত কথা বলল, সব ছিল অন্যের কাছ থেকে শোনা, অন্ধ অনুকীর্তি। তাকদিরের ফয়সালার ওপর আস্থার দোহাই দিলেও অন্তরে তার বিশ্বাস ছিল নড়বড়ে। ফলে শিয়ালের ধোঁকায় পড়ল। ব্যাপারটি ছিল মুনাফিকের ঈমানের মতো। মুনাফিকদের প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে এসেছে, ‘যা তাদের অন্তরে নেই, তারা তা মুখে বলে; তারা যা গোপন রাখে, আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবহিত।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৬৭)।
অন্ধ অনুকরণকারী কথায় কথায় শত রকমের যুক্তি দেয়। কিন্তু তার যুক্তিমালা অন্যের কাছ থেকে শোনা। হাকিকতকে দেখে নয়। এ অবস্থা থেকে নিস্তার পেতে হলে তোমাকে সন্ধান করতে হবে আধ্যাত্মিকতার ফুলের সুবাস। তোমার মধ্যে যদি পশুত্ব প্রবল হয়, তোমার নফস তোমাকে খোঁয়াড়ের দিকে আকর্ষণ করবে। আর যদি রুহানিয়াত প্রবল হয়, তাহলে সত্য, সুন্দর, ন্যায় তথা ফুলের বাগানের দিকে মন আকৃষ্ট হবে। তুমি নিজেই পরীক্ষা করে দেখ, তোমার মন এখন কোন দিকে! তোমার কি অন্যায়-পাপ, দুর্গন্ধ পছন্দ নাকি গোলাপ ও মিশকের সুবাস? তাতেই তোমার পরিচয় তোমার কাছে উন্মোচিত হবে।
আসেমান শো আবর শো বারান বেবার
নাওদান বারেশ কুনদ নবুয়াদ বেকার
আকাশ হও, হও মেঘমালা আন বরিষণ
ছাদের নালার বর্ষণে কাজ হয় না তেমন।
তুমি নিজেকে আকাশের মতো প্রসারিত কর, মেঘমালার মতো উদার হয়ে যাও, তাহলে আধ্যাত্মিক নুরে আলোকিত হবে তোমার মন ও জীবন। ছাদ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ার যে নালা, তা থেকেও বৃষ্টি নামে। কিন্তু সেই বৃষ্টি তার নিজস্ব নয়। তাই তেমন কাজে আসে না। আর যদি হাকিকতের সন্ধান পেয়ে আকাশের মতো বিশাল, মেঘের মতো উদার দিল হও, তাহলে তোমার অস্তিত্ব থেকেই বৃষ্টি নামবে। এক প্রকার জ্ঞানী আছেন, বড় বড় গ্রন্থ মুখস্থ করেন, তাদের কথায়-লেখায় রেফারেন্স-উদ্ধৃতির ছড়াছড়ি; আরেক শ্রেণির জ্ঞানীর জ্ঞান নিজের চেতনা ও অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত হয়। নিশ্চয় শেষোক্ত জ্ঞানীই সত্যিকার জ্ঞানী। আর প্রথমোক্ত জ্ঞানী অন্ধ অনুকরণকারী, যাকে বলে কপি-পেস্ট গবেষক। মওলানা আরও বলেন, বৃষ্টির পানিতে ক্ষেতখামার, বাগান হাসে, জীবন জাগে। অথচ নালার পানি গড়িয়ে পড়লে প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া লাগে।
গাধার যুক্তিগুলো ছিল অন্যের কাছ থেকে শেখা বুলি। তাই সে শিয়ালের নানা কথার ফাঁদে আটকে গেল। শেষ পর্যন্ত শিয়ালের সঙ্গে রাজি হলো বনভূমি যেতে। সেখানে অপেক্ষমাণ ক্ষুধার্ত সিংহ। শিয়ালের পথের দিকে চেয়ে আছে, কখন কোনো গাধা পটিয়ে আনে তার খাবারের জন্য। শিয়াল গাধাকে নিয়ে চলল সিংহের কাছে। ক্ষুধার্ত সিংহের তর সইল না। দূর থেকে হামলে পড়ল শিকারের ওপর। কিন্তু তার দুর্বল পাঞ্জার থাবাটি গাধার গায়ে বসল না। গাধা পালিয়ে বাঁচল জমদূতের হাত থেকে। শিয়াল সিংহকে ভর্ৎসনার সুরে বলল, কাছে আসার আগে হামলা করলে কেন? আশাহত সিংহ অনুনয় করে শিয়ালকে বলল, যেভাবেই পার গাধাটি আরেকবার আমার নাগালে নিয়ে এসো। কথা দিলাম, এমন ভুল আর হবে না। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, ৫ম খণ্ড, বয়েত : ২৪০১-২৫৩৭)।
[ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন : ০১৭১১ ১১৫ ৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI]