ঢাকা রোববার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

আত্মগঠনে ধর্মীয় শিক্ষা প্রয়োজন

হাবিবুর রহমান
আত্মগঠনে ধর্মীয় শিক্ষা প্রয়োজন

বস্তুবাদিতার এ যুগে আমাদের ধর্ম, নীতি-নৈতিকতা, আচার-ব্যবহার ধ্বংসের দারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিটা ক্ষেত্রে বস্তুবাদ শিরা-উপশিরার ন্যায় প্রবেশ করেছে। এর জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই; আমাদের ধর্মীয় জ্ঞানের উদাসীনতা, অবহেলা, আত্মকেন্দ্রিকতা। যার ফলে বস্তুবাদ, প্রয়োগবাদ আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে। আমরা চাইলেও এসব থেকে দূরে থাকতে পারি না। কারণ, বস্তুবাদ, প্রয়োগবাদ আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীটাকে রঙিন করে সাজিয়ে রেখেছে। তারা বলে, এই চাকচিক্যময় দুনিয়াকে উপভোগ কর, বিলাসবহুল জীবনযাপন কর, জীবন তো একটাই; মৃত্যুর পর আর কোনো জীবন নেই। সুতরাং জীবনটা উপভোগ কর, খাও-দাও, ফূর্তি কর। এই বস্তুবাদিতা থেকে মুক্ত হওয়ার একটাই মাধ্যম, একটাই রাস্তা; তা হলো- আমাদের ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতা। আল্লাহ কিন্তু পবিত্র কোরআন নাজিল করেছেন আমাদের জ্ঞানার্জনের উপায় বলার মাধ্যমে- ‘পড়’। আর সে পড়াটা, সে জ্ঞানটা হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য। আল্লাহতায়ালা সুরা আলাকের প্রথমেই বলেছেন, ‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাকে। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একটুকরো রক্তপি- থেকে।’ (সুরা আলাক : ১-২)। আল্লাহতায়ালা এখানে মানুষের সৃষ্টির রহস্যও বলে দিয়েছেন; যা জীববিজ্ঞানের মূলকথা।

শিশুর ধর্মশিক্ষার প্রতি গুরুত্ব : শিশুকাল থেকেই ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের প্রতি আমাদের আগ্রহী হতে হবে। তা সম্ভব না হলে আমাদের বর্তমান সময় থেকেই শুরু করতে হবে। কারণ, কোনো কাজ শুরু করার সময় হলো এখনই। জানার, শেখার কোনো নির্দিষ্ট বয়স, নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। আশি বছরের বৃদ্ধও চাইলে তার প্রাথমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শুরু করতে পারে। তবে ধর্মীয় হোক বা যে কোনো শিক্ষাই হোক না কেন, শিশুদের আগে প্রাধান্য দিতে হবে। তাদের জ্ঞানের ভিতটা মজবুত হতে হবে। শিশুরা হলো অনুকরণপ্রিয়। তারা কান দিয়ে নয়, চোখ দিয়ে শোনে। তাদের কিছু বললে বিপরীত কাজটা করবে। তাদের সামনে যদি কোনো কাজ করা হয়, তাহলে শিশুরা সে কাজটাই করতে আগ্রহী হয়। মানে অনুকরণ করতে থাকে। শিশুর শিক্ষার প্রথম ও প্রধান বিদ্যালয় হলো তার পরিবার। পরিবারের প্রভাব তার ওপর আজীবন থাকে।

শিশুর ওপর পরিবারের প্রভাব : প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী এরিক এরিকসন বলেন, ‘জন্মের পর থেকে প্রায় ছ’মাস বয়স পর্যন্ত একটি শিশুর পৃথিবীকে চেনার প্রধান মাধ্যম হলো- তার মা, বাবা ও পরিবার। এ সময়টিতে শিশু তার মা-বাবাকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে। পরিবার তাকে প্রভাবিত করে। তাদের চালচলন, কথাবার্তা, ভিন্নতা ও সাদৃশ্যতার মাপকাঠিতে সে চেষ্টা করে পৃথিবীকে জানার। বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক সংঘাতকে সে কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার প্রস্তুতি শুরু হয় ওই বয়স থেকেই।’ আমাদের অনাগত ভবিষ্যতের জন্য, আমাদের দ্বীনের পথটাকে স্বচ্ছ রাখার জন্য আমাদের নিজেদেরও ধর্মীয় জ্ঞানে জ্ঞানী হতে হবে। তবেই আমাদের সন্তানেরা আমাদের দেখানো পথ অনুসরণ করে দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে। আমরা যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করি না কেন, আমাদের জ্ঞানটা হতে হবে পরিপূর্ণ জ্ঞান। পরিপূর্ণ সঠিক জ্ঞান ছাড়া আমরা সামান্য বিপদেই হতাশায় ডুবে যাব। আমাদের ধর্মীয় জ্ঞানটা হতে হবে গভীর, তবে স্বচ্ছ-শৃঙ্খলার সঙ্গে। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা নামাজ পড়ছি ঠিকই; না হচ্ছে রুকু, না হচ্ছে সেজদা। আর তেলাওয়াতের কথা তো বাদই দিলাম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কিছু নামাজি ক্ষতিগ্রস্ত। আর তারা হলো, যারা নামাজ পড়ে ঠিকই; কিন্তু জানে না কী পড়ছে এবং তারা লোক দেখানোর জন্য তা করে।’ (সুরা মাউন : ৪-৫)। এ জাতীয় ইবাদতে কোনো সুফল নেই; বরং আছে ভয়াবহ শাস্তি।

কোরআনের জ্ঞান শিখতে হবে : আল্লাহতায়ালা মোমিনকে জ্ঞান অন্বেষণের কথা বলেছেন। পড়তে বলেছেন তাঁর নামে। তাঁর গুণগান গাইতে বলেছেন। তিনি পবিত্র কোরআনে বলেই দিয়েছেন কোন ধরনের জ্ঞান আমাদের অন্বেষণ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘যে ইসলাম ছাড়া অন্য দ্বীন অন্বেষণ করে, তা কখনোই কবুল করা হবে না। আর সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৮৫)। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই ইসলামি জ্ঞানে পরিপূর্ণ জ্ঞানী হতে হবে। আমাদের ধর্মীয় জ্ঞানের মূল উৎস হলো আল্লাহর কোরআন আর মুহাম্মদ (সা.)-এর হাদিসগুলো। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আনুগত্য কর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের, যেন অনুগ্রহপ্রাপ্ত হতে পার।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৩২)।

প্রচলিত শিক্ষানীতি ও ইসলাম : আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মূল যে সূত্র, তা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আমদানি করা। লর্ড মেকলে ১৮৩৫ সালে পশ্চিমা ধাঁচে এ দেশে প্রথমবারের মতো শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। তার সে শিক্ষানীতির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষের মধ্যে এমন একটা শ্রেণি তৈরি করা, যারা রক্তমাংসে হবে ভারতীয়; কিন্তু রুচি, নীতি, শিক্ষায় হবে ইংরেজ। এ নতুন শিক্ষিত শ্রেণিই ভবিষ্যতে ইংরেজ শাসনকে মজবুত করতে সহায়ক হবে। ১৮৩৫ সালের দেয়া মেকলে শিক্ষানীতিই এখনও আমরা অনুসরণ করে চলছি। পশ্চিমাদের সংস্কৃতি ধরে সে পথে চলছি। সমাজে বেহায়াপনা, ধর্ষণ, অশ্লীলতা, লিভ টুগেদার, সমকামিতা ইত্যাদি হলো পশ্চিমাদের সংস্কৃতির নমুনা। অথচ এসব আমাদের ধর্ম, আমাদের ইসলামি অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ হারাম। কিন্তু আমরা বস্তুবাদিতার মোহে এমন ভাবে আটকে গেছি, সামান্য পরিমাণ ধর্মীয় জ্ঞান থাকলেও তা না মেনে উল্টো পথে ব্যবহার করছি। নিজেদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত স্বার্থে আমাদের ঈমানকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। পাশাপাশি আমাদের সমাজ এমনকি দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি। একবার ফুজাইল ইবনু ইয়ায (রহ.)-কে বলা হলো, ‘আপনার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার কোনটি?’ তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে যখন দেখি, একজন মানুষ আল্লাহ সম্পর্কে জানে, তবু সে আল্লাহর অবাধ্য হয়।’ এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের মধ্যে একদল আল্লাহর বাণী শুনত এবং তা বোঝার পরও জেনেশুনে তাকে পরিবর্তন করে দিত।’ (সুরা বাকারা : ৭৫)। আল্লাহ পরবর্তীতে এর কারণ বলে দিয়েছেন, কেন তারা আল্লাহর বাণীকে অস্বীকার করত বা তাতে পরিবর্তন আনত। তিনি বলেন, ‘এরাই সেই লোক, যারা পরকালের বিনিময়ে ইহকালকে ক্রয় করে।’ (সুরা বাকারা : ৮৬)।

বস্তুবাদী শিক্ষার কুফল : আমাদের বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থার কুফল হলো, সামান্য বিপদ দেখলেই হতাশায় ডুবে যাই। কারণ, বস্তুবাদিতা চমকপ্রদ, চাকচিক্যময়; যা আমাদের চারপাশে দেখতে পাই। যখন আমরা বস্তুবাদিতার পেছনে ছুটে আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারি বা সে জিনিসটা না পাই, তখন আমাদের জন্মই আজন্ম বৃথা মনে হয়। মরে যেতে ইচ্ছে করে। সেখানে আত্মহত্যা আমাদের কাছে সহজলভ্য। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে, প্রিয় মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের চির ধরলে, এমনকি পিতামাতার সামান্য শাসনেও আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা পত্রিকার পাতায় দেখি। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা এবং ধনপ্রাণ ও ফলফলাদির ক্ষতি দিয়ে।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫)। এতে প্রকৃত মোমিনরা কখনও হতাশায় ডুবে থাকে না। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ পরবর্তী আয়াতে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘তাদের ওপর যখন বিপদ আপতিত হয়, তখন তারা বলে, আমরা আল্লাহরই এবং আমরা তাঁরই কাছে ফিরে যাব।’ (সুরা বাকারা : ১৫৬)। তাই পশ্চিমা শিক্ষা-সংস্কৃতি ছেড়ে আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় জ্ঞানার্জন করতে হবে, জ্ঞানী হতে হবে। আমাদের হতাশার এ শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা যদি কাফেরদের কথা মান, তবে তারা তোমাদের উল্টোপথে ফেরাবে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪৯)। সুতরাং আমাদের ভালোমন্দের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। পশ্চিমা সমাজ স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে ব্যস্ত। যা শুরু করেছিল লর্ড মেকলের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে। কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেই দেশের সামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে আমরা আমাদের সমাজ-দেশকে সুস্থ, সুন্দর, সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলতে পারব।

আত্মগঠনে ভালো বন্ধু চাই : ধর্মীয় জ্ঞান প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে অবশ্যই ধার্মিক ও ভালো বন্ধু দরকার। কারণ, বন্ধু বন্ধুকে পরিবারের পর সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মোমিনরা; যারা নামাজ কায়েম করে আর জাকাত দেয়।’ (সুরা মায়িদা : ৫৫)। আর তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পুরস্কার আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘যারা আল্লাহ, তাঁর রাসুল ও মোমিনদের বন্ধু বানায়, তারাই আল্লাহর দল। তারাই বিজয়ী হবে।’ (সুরা মায়িদা : ৫৬)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত