বর্তমান যুগে ‘জড়বাদ’ জগতের সর্ব্বত্র পরিব্যাপ্ত। দৈহিক উপভোগ মানবের চরম ও পরম লক্ষ্য। দেশসেবা, সমাজসেবা, সংসার সেবা ও পর সেবার মূলে স্বার্থ নিহিত। স্বার্থের জন্য মানবের সর্ব্বপ্রকার কার্য্য নিয়ন্ত্রিত হয়। সর্ব্ব দেশেই আধ্যাত্মিক অবনতি চরম সীমায় উপনীত হইয়াছে। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ একবাক্যে স্বীকার করিতেছেন যে, অধুনা আধ্যাত্মিক জাগরণের সময় উপস্থিত। প্রত্যেক জাতির বিশ্বাস যে, তাহাদেরই ধর্ম পৃথিবীতে একটি নব আলোড়ন উৎপাদন করিবে।
তাছাওয়াফ সকল ধর্মের মূল-নীতির অনুকূল, সুতরাং তাছাওয়াফই ধর্ম-জগতে নূতন জাগরণ আনিবার একমাত্র উপযোগী। তাছাওয়াফ কার্য্য-নীতির নাম, বাক্য-নীতির নাম নহে।
সকল ধর্মের ক্রমিক সংস্কার সংঘটিত হইয়াছে, কিন্তু তাছাওয়াফ আদিকাল হইতে বর্তমান পর্যন্ত অপরিবর্তিত রহিয়াছে। লোকের ভ্রান্ত বিশ্বাস যে, ছুফী সংসার পরিত্যাগ করিয়া, সন্ন্যাস-ব্রত অবলম্বন করিতে তৎপর, প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে। ছুফীর শিক্ষা এই- ‘এই সংসারের মধ্যে অবস্থিতি কর, কিন্তু সংসার-কীট সাজিও না; তোমার সমগ্র চিন্তা-শক্তি আত্মার উন্নতি-পথে নিয়োগ কর, তবেই জাগতিক কর্তব্য প্রকৃতরূপে প্রতিপালিত হইবে।’ আত্মিক শক্তি ধারণের জন্য দেহের সৃষ্টি। আত্মাতেই সকল প্রকার গুপ্ত শক্তি নিহিত, উহার ক্রমিক বিকাশই জীবনের উদ্দেশ্য। পরম শক্তির বীজ আত্মাতে উপ্ত, শরীরের সাহায্যে উক্ত শক্তির বিকাশ মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।
কোরআনই তাছাওয়াফের মূল গ্রন্থ। হজরত মোহাম্মদ (দঃ) সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ছুফী। তাঁহার শিক্ষা সর্ব্বলোকের জন্য ও সর্বকালের জন্য মনোনীত। তাছাওয়াফের বিধিগুলি সম্যকরূপে অনুসৃত হইলে পৃথিবী বক্ষে এক অচিন্ত্য জাগরণ সংঘটিত হইবে।
কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, ‘আছহাবে ছাফা’ হইতে ছুফী শব্দের উৎপত্তি (ছাফা অর্থে পবিত্র)। কেহ কেহ বলেন, ছুফীগণ পশমী পরিচ্ছদ ব্যবহার করিতেন, সেই জন্য ইহাদিগকে ছুফী বলা হইত (ছুফী অর্থে পশম)। আবার কেহ কেহ বলেন, ইহারা তত্ত্বজ্ঞানী ছিলেন বলিয়া ছুফী নামে আখ্যাত হইতেন (গ্রীক ছোফিয়া অর্থে জ্ঞান)। শেষোক্ত শ্রেণী তাছাওয়াফকে প্লেটোর পরবর্তীগণের মত হইতে উদ্ভূত মনে করেন। কিন্তু মোছলেম আলেমগণ এই মতের সম্পূর্ণ বিরোধী। তাঁহারা বলেন, ইছলামের আভ্যন্তরীণ অর্থ লইয়া- তাছাওয়াফ গঠিত, গ্রীক বা আর্য্য ধর্মের সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই। নবম শতাব্দীতে বাদশাহ্ মনছুর ও তাঁহার উত্তরাধিকারী মামুনের রাজত্বকালে সর্ব্বপ্রথম গ্রীক দর্শনের অনুবাদ আরম্ভ হয়। ইতঃপূর্ব্বে মোছলেমগণ গ্রীক দর্শন সম্বন্ধে অনবগত ছিল। সুতরাং গ্রীক দর্শন হইতে তাছাওয়াফের উৎপত্তি মনে করা বড়ই ভুল। ষষ্ঠ শতাব্দীতে তাছাওয়াফের যে ব্যাখ্যা ছিল, দশম শতাব্দীতে অবিকল তাহাই ছিল, সুতরাং গ্রীক্ দর্শনের দ্বারা তাছাওয়াফ কোন নতুনভাবে ভাবাপন্ন হয় নাই। ছুফী-মত ষষ্ঠ শতাব্দী হইতে অপরিবর্তিতভাবে বিদ্যমান। ছূফীগণ নিদোষ জীবন যাপন করিতেন এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সর্ব্বোন্নত ছিলেন। ইছলাম হজরত আদম হইতে প্রচলিত, সুতরাং তাছাওয়াফও তৎকাল হইতে বিদ্যমান। তাছাওয়াফ ইছলামের অন্তরঙ্গ এবং শরীয়ত ইহার বহিরঙ্গ।
তাছাওয়াফ শরীয়ত বিরোধী নহে। ইছলামের অনুশাসন অনুসারে কার্য্য করিতে হইবে বটে, কিন্তু যে মৌলিক কারণে উক্ত অনুশাসনের সৃষ্টি- তাহা চিন্তা করিয়া তদনুসারে মনোবৃত্তি ও কার্য্য পরম্পরা উভয়কেই সুনিয়ন্ত্রিত করিতে হইবে।
ছুফী কার্য্যে ও চিন্তায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ঐশী ইচ্ছার উপর সমর্পণ করেন, ছুফী সকল যুগের ও সকল দেশের প্রত্যাদিষ্ট বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন করেন। কোরআনের উক্তি এই যে, ‘বল, আমরা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করি এবং এব্রাহিম, ইছমাইল, এছহাক, ইয়াকুব ও তাঁহাদের বংশধরগণের উপর যে সকল গ্রন্থ প্রেরিত হইয়াছে তাহাতেও বিশ্বাস স্থাপন করি এবং আমরা আরও বিশ্বাস করি, যাহা মুছা, ঈছা এবং অন্যান্য পয়গম্বরদিগের নিকট বিশ্বপালক কর্তৃক প্রদত্ত হইয়াছিল, আমরা তাঁহাদের সকলকে গ্রহণ করি এবং তাঁহাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য করি না।’
খৃষ্টান ও ইহুদী জাতি অন্য ধর্মকে দখল দেয় না। স্বধর্ম একমাত্র গ্রহণীয় মনে করে, কিন্তু ইছলাম উভয় ধর্মকে সম্মান করে। বায়ু, জল, অগ্নি, মৃত্তিকা ও খাদ্য সকল দেশের জনাই মনোনীত। এটা দেশ কিম্বা কাল বিশেষের জন্য তাঁহার অনুগ্রহ সীমাবদ্ধ করেন নাই। সর্বত্র, সর্বকালে সর্ব্ব জাতি সমভাবে তাঁহার দান উপভোগ করে। তিনি সকল জাতির প্রতিপালক, সকল যুগের প্রভু, সকল দেশের শাসক, সকল অনুগ্রহের প্রস্রবণ, সকল ক্ষমতার অধীশ্বর, সকল বস্তুর প্রতিপালক। ছুফী জাতি, স্থান ও কাল নির্বিশেষে সকলকে আলিঙ্গন করেন, সকলকে ভ্রাতৃবৎ জ্ঞান করেন। তাঁহার নিকট কোন ভেদাভেদ নাই। জগৎ-পিতার রাজ্যে সকলেই এক সমাজভুক্ত, জাতি-বিরোধ ইছলামের অনুশাসন-বিরুদ্ধ। ইছলাম বলিতে প্রেরিত-মহাপুরুষ দ্বারা প্রচারিত ধর্ম বুঝায়। ইহারা সকলেই একই সত্য প্রচার করিয়াছেন। প্রাচীনকালে মানবজাতির বসতি ভূপৃষ্ঠে ছিন্ন-ভিন্ন ছিল, সেই হেতু তাহাদের নিকট বিভিন্ন সংবাদবাহক আসিয়াছিলেন। কোরআন বলে, এমন কোনো জাতি নাই যাঁহার নিকট কোনো উপদেশক (নবী) আবির্ভূত হয় নাই।
মহাগ্রন্থ কোর-আন পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলে আবির্ভূত। ইহার অপরিবর্তনীয় ও বিশ্বভাব -জ্ঞাপক আরবী ভাষা বিশ্ব-প্রচারের উপযোগী। কোর-আন সকল সত্য ধর্মের সমন্বয়। ইহা প্রাচীন নিখুঁত ধর্মসমূহের সমর্থক, ইহা মানব মস্তিষ্ক-প্রসূত আবিলতা বিবর্জিত; ইহা বর্তমান যুগের নবাবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক তথ্যের অনুকূল। ইহার অনুশাসন সকল কালের, সকল শ্রেণীর, সকল সমাজ-শাসনের উপযোগী। ইহা একাধারে রাজনীতিজ্ঞ, অর্থনীতিজ্ঞ, সামরিক কর্মচারী, ব্যবসায়ী, শিল্পী, ধনী, নির্ধন, স্ত্রী-পুরুষ সকলেরই পথ-প্রদর্শক। সকল ধর্মই ইছলামের অনুশাসন গ্রহণ করিয়া লাভবান হইতে পারে। ছুফীর প্রভু সকল জগতের প্রভু, তিনি কোন বিশেষ জাতির প্রতিপালক নহেন, তিনি সকল আলমের প্রতিপালক। তিনি সকল বিশ্বের একমাত্র প্রভু। তাঁহারই সমস্ত মহিমা, সমস্ত শক্তি, সমস্ত মাহাত্ম্য। সকল সৃষ্টজীব একই ভ্রাতৃত্ব-বন্ধনে আবদ্ধ। অন্য কোন ধর্ম এই বিশ্বজনীন ভাব কার্য্যে পরিণত করিতে সমর্থ হয় নাই। প্রকৃতি একত্বের পরিচায়ক। উদ্ভিদণ্ডজগৎ প্রাণী-জগৎ, জড়-জগৎ একই নিয়মের অধীন। গ্রহ, উপগ্রহ, নদী, পর্ব্বত পরস্পর বিভিন্ন হইলেও একই বিধানের অনুবর্তী। সৃষ্টবস্তুর বহুত্বের মধ্যে একত্ব সর্ব্বদা বিরাজমান। ছুফীমত এই বিশ্বজোড়া একত্বের পরিপোষক।
বি.দ্র. (লেখকের বানানরীতি অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে)।