মুহাম্মাদ ইবনে ওমর ওয়াকেদি বলেন, জুরহুম সম্প্রদায় মক্কা নগরি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছা করলে দুটি স্বর্ণের হরিণ, সাতটি কিল্লাই তরবারি ও পাঁচটি বর্ম সেখানে পুতে রেখেছিল। আবদুল মুত্তালিব সেগুলোই উদ্ধার করেন। এ ছিল জমজম পুনঃখননের কাহিনির একটি দিক।
মুহাম্মাদ ইবনে সাআদ তার তাবাকাত আল-কুবরায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস প্রমুখ সাহাবিদের সূত্রে মুহাম্মদ ইবনে ওয়াকেদি থেকে বর্ণনা করেন, আবদুল মুত্তালিব যখন জমজম কূপ খননের সময় নিজের সাহায্যকারী নগণ্য হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করেন, তখন মানত করেন যে, আল্লাহ যদি তাকে দশটি ছেলে সন্তান দেন এবং তিনি তাদের দেখেন তাহলে তাদের থেকে কোনো এক ছেলেকে আল্লাহর নামে জবাই করবেন। তার ছেলে সন্তানের সংখ্যা দশে পৌঁছল আর তারা ছিলেন, হারেস, জাবির, আবু তালেব, আবদুল্লাহ, হামজা, আবু লাহাব, গাইদাক, মুকওয়াম, জেরার ও আব্বাস।
মুহাম্মাদ ইবনে সাআদ বলেন, আবদুল মুত্তালিবের ছেলে-সন্তানের সংখ্যা দশজনে পৌঁছলে তিনি তাদের এক জায়গায় জমায়েত করে তাদের নিজের মানতের কথা জানিয়ে দিলেন এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে এই মানত পূরণের জন্য তাদের প্রতি আহ্বান জানালেন। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে একজনও দ্বিমত পোষণ করল না। তারা সবাই বলল, আপনি আপনার মানত পুরা করেন এবং আপনার যা ইচ্ছা সম্পাদন করেন। তিনি বললেন, তোমাদের প্রত্যেকে নিজের নাম একটি তীরের কাষ্ঠফলায় লেখ।
তারা তাই করল। আবদুল মুত্তালিব তখন কাবাঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন। তারপর সাদেনকে তাদের নামে লটারি টানার জন্য বললেন। (সাদেন হলো কাবাঘরে স্থাপিত মূর্তির সেবায়েত, সে তীরের কাষ্ঠনির্মিত ফলা নিয়ে লটারির টানার কাজ করত।) তাতে প্রথম যে ফলাটি বেরিয়ে এলো, তা ছিল আবদুল্লাহর নাম। অথচ আবদুল মুত্তালিব তাকে খুবই ভালোবাসতেন। তিনি আবদুল্লাহর হাত ধরে কোরবানি দেওয়ার জায়গার দিকে রওনা হলেন। তার হাতে ছিল ছুরি। তখন সেখানে দাঁড়ানো আবদুল মুত্তালিবের মেয়েরা কান্নাকাটি শুরু করল। তাদের একজন বাবাকে বলল, তার জন্য আপনি একটি বিকল্প ব্যবস্থা বের করেন। হেরেম এলাকায় আপনার চিহ্নযুক্ত উটনিগুলো থেকে আপনি আবদুল্লাহর জীবনের বদলায় কোরবানি দেন। তিনি তখন মূর্তিশালার খাদেমকে বললেন, তুমি তাই করো। আবদুল্লাহর নামের বদলায় উটনির সংখ্যা লেখে লটারি দাও। একটি ফলায় ১০টি উটনির সংখ্যা, আরেক ফলায় আবদুল্লাহর নাম লেখ। সাদেন লটারি টানল। তখনকার দিনে কাউকে হত্যার বদলায় রক্তপণের দাম ছিল ১০ উটনি। এতে আবদুল্লাহর নাম আসল। এরপর ১০টি করে উটের সংখ্যা বাড়িয়ে লিখে লটারি টানতে লাগল। প্রতিবারই আবদুল্লাহর নাম উঠে আসে। লটারির ফলায় উটের সংখ্যা যখন ১০০ লেখা হলো, তখন উটের নাম বেরিয়ে এলো, তখনই আবদুল মুত্তালিব তাকবির দিয়ে উঠলেন। অন্য লোকেরাও তার সঙ্গে তাকবির দিল। তখন আবদুল মুত্তালিবের মেয়েরা ভাইকে হাতে ধরে নিয়ে গেল।
আবদুল মুত্তালিব তার উটনিগুলো হাজির করলেন এবং সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সেগুলো কোরবানি দিলেন। কোরবানির পশুগুলো মানুষ, পশুপাখি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। কাউকে বাধা দিলেন না। আর সেখান থেকে তিনি নিজে বা তার সন্তানদের মধ্যে কেউ কোনো কিছু নিলেন না। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তখনকার দিন পর্যন্ত দিয়ত (কাউকে হত্যার বদলায় দেয় রক্তপণ)-এর পরিমাণ ছিল ১০টি উট। আবদুল মুত্তালিবই প্রথম ব্যক্তি যিনি ১০০ উটের রক্তপণের পরিমাণ প্রচলন করেন। এরপর থেকে কুরাইশ ও আরবদের মধ্যে দিয়তের পরিমাণ নির্ধারিত হয় ১০০ উট। রাসুুলুল্লাহ (সা.)-ও সে পরিমাণটি বহাল রাখেন। এই বর্ণনাটি মুহাম্মাদ ইবনে সাআদ তার তাবাকাতে এনেছেন। আবু মুহাম্মদ আবদুল মালেক ইবনে হিশাম তার সিরাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
ইবনে ইসহাক বলেন, আবদুল মুত্তালিব যখন জমজম কূপ খননের প্রশ্নে কুরাইশের পক্ষ থেকে বড় রকমের বাধার সম্মুখীন হন, তখন তিনি মানত করেন যে, যদি তার ১০টি ছেলেসন্তান হয় এবং তারা তার জীবিত থাকা অবস্থায় বয়ঃপ্রাপ্ত হয় ও তার প্রতিরক্ষা করতে পারে, তাহলে একটি ছেলেকে কাবাঘরের কাছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে কোরবানি দেবেন। অতঃপর আবদুল মুত্তালিবের ছেলের সংখ্যা যখন ১০ জন হলো এবং বুঝতে পারলেন যে, তারা সম্মিলিতভাবে তাকে প্রতিরক্ষা দিতে পারবে তখন তিনি তাদের ডেকে তার মানতের কথা বললেন এবং আল্লাহর জন্য মানত পূরণে তাদের আহ্বান জানালেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ২/২৪৮)।
ছেলেরা সবাই তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে বলল, আমাদের কী করতে হবে বলুন। তিনি বললেন, তোমরা প্রত্যেকে একটি করে লটারি টানার তীরের ফলা হাতে নাও। তারপর এর ওপরে প্রত্যেকের নাম লেখ। তারপর আমার কাছে নিয়ে এসো। (তারিখে তাবারি : ২/১৭৩; সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/১৬০)। তারা তাই করল এবং তার সামনে আসল। আবদুল মুত্তালিব তাদের নিয়ে কাবাঘরের অভ্যন্তরে হুবলের সম্মুখে এলো। (তারিখে তাবারি : ২/১৭২)। হুবল ছিল কাবাঘরের অভ্যন্তরে একটি কূপের কাছে। সেই কূপে কাবাঘরের জন্য যত নজর-মানত ইত্যাদি আসত, সব এই কুয়ায় জমা হতো। হুবলের কাছে সাতটি কাষ্ঠনির্মিত তীরের ফলা ছিল। প্রত্যেক ফলায় একেকটি কথা লেখা ছিল।
একটি ফলার মধ্যে লেখা ছিল দিয়াত বা রক্তপণ। একটি ফলার গায়ে লেখা ছিল ‘ হ্যাঁ’। আরেকটি ফলার লেখা ছিল ‘না’। একটি ফলার গায়ে লেখা ছিল ‘তোমাদের’। আরেক কাঠিতে লেখা ছিল ‘অন্যদের’। অপর কাঠিতে লেখা ছিল ‘তোমাদের সঙ্গে যুক্ত’। অনুরূপ একটি কাঠির গায়ে লেখা ছিল পানি।
আবদুল মুত্তালিব তীরের কাঠির সংরক্ষককে বলল, আমার এই ছেলেদের নামে ভাগ্যকাঠির সাহায্যে লটারি টান। তিনি তাকে কী মানত করেছেন তাও বলে দিলেন। তারা প্রত্যেকে নিজের নাম লেখা ফলাগুলো তাকে দিল। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ছিলেন তখন পর্যন্ত সবার ছোট আর পিতার কাছে অন্যদের চেয়ে অধিক প্রিয়। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পিতা। সাদান যখন লটারি টানার জন্য কাঠিগুলো হাতে নিল আবদুল মুত্তালিব হুবলের কাছে দাঁড়িয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে শুরু করলেন। অতঃপর সাদান লটারি টানলে তাতে আবদুল্লাহর নাম বেরিয়ে এল। আবদুল মুত্তালিব তার হাত ধরে এসাফ ও নায়েলার দিকে চললেন। তখন তার হাতে ছিল জবাই করার ছোরা।
তখন কুরাইশরা তাদের সভাস্থল থেকে বেরিয়ে এসে বলল, হে আবদুল মুত্তালিব, আপনি কী করতে চান। বললেন, আমি আবদুল্লাহকে জবাই করব। তখন কুরাইশের লোকেরা ও তার সন্তানরা বলল, খোদার কসম, তাকে জবাই করবেন না; বরং তার বদলায় আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা চিন্তা করতে হবে। (তারিখে তাবারি : ২/১৭৩; সিরাতুন্নবি : ১/১৬২; তারিখে কামেল, ইবনে আসির : ২/৬)।
আপনি যদি এ কাজ করেন তাহলে অন্য লোকেরাও একই কাজ করবে। তাদের ছেলে সন্তানদের এনে জবাই করতে থাকবে। এমন পরিস্থিতি হলে মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে। তখন কুরাইশ ও আবদুল মুত্তালিবের সন্তানরাও বলল যে, আপনি এ কাজ করবেন না। তাকে আপনি হেজাজ নিয়ে যান। ওখানে একজন জ্যোতিষি আছে, একটি জিন তার বশীভূত আছে। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ২/২৪৮)। তার সিদ্ধান্ত মতে কাজ করুন। সবাই তার কাছে গেলেন। আবদুল মুত্তালিব তার কাছে নিজের ও নিজের ছেলের সমস্ত ব্যাপার খুলে বললেন। গণক বলল, আমার কাছে খবরটি আগেই এসেছে। আপনাদের এলাকায় দিয়ত (মুক্তিপণ)-এর পরিমাণ কী রকম। (নুবাইরি এখানে সিরাতে ইবনে হিশামের ভাষ্য সংক্ষেপিত করেছেন। সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/২৪৮)।
তারা বললেন, ১০ উট। গণক বলল, আপনারা আপনাদের দেশে চলে যান। আবদুল্লাহর বিপরীতে ১০টি উট লিখে লটারি দেন। যদি এরপরও আবদুল্লাহর নাম উঠে আসে উটের সংখ্যা বাড়াতে থাকবেন। যতক্ষণ না আপনার প্রতিপালক আপনার ওপর সন্তুষ্ট হন। যখনই লটারিতে উটের নাম বের হবে তখন আবদুল্লাহর বদলায় উটগুলো জবাই করবেন। তাহলে বুঝবেন যে, আপনার প্রতিপালক আপনার প্রতি রাজি হয়েছেন এবং আপনার প্রিয়জন মুক্তিলাভ করেছেন। তারা মক্কায় পৌঁছে তাই করলেন। শুরুতে ভাগ্যকাঠিতে আবদুল্লাহর নাম বেরিয়ে এলো। আবদুল মুত্তালিব উটের সংখ্যা দশ দশ করে বৃদ্ধি করতে লাগলেন। আবদুল মুুত্তালিব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে দাঁড়ানো অবস্থায় দোয়া প্রার্থনা করছিলেন। যখন আবদুল্লাহর বিপরীতে লটারিতে উটের সংখ্যা ১০০ পূর্ণ হলো, তখন লটারির ফল আসল উটগুলোর নামে। (বিস্তারিত আকারে সিরাতে ইবনে হিশাম দ্রষ্টব্য : ১/১৬৩)।
কুরাইশ বংশীয় ও উপস্থিত লোকেরা বলল, উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আপনার প্রতিপালক আপনার প্রতি রাজি হয়েছেন। আবদুল মুত্তালিব বললেন, না, আল্লাহর কসম। অন্তত তিনবার লটারিতে উটগুলোর নাম আসতে হবে। অতঃপর আবদুল্লাহ ও উটগুলোর নামে লটারি টানা অব্যাহত রাখা হলো। তাতে পরপর তিনবার আবদুল্লাহর বিপরীতে ১০০ উটের সংখ্যা বেরিয়ে আসল। আবদুল মুত্তালিব তখনো দাঁড়ানো অবস্থায় দোয়া প্রার্থনা করছিলেন। অতঃপর আবদুল মুত্তালিব ১০০টি উট আল্লাহর নামে জবাই করেন। ঘটনার বিবরণ আগের বর্ণনার অনুরূপ। (সামান্য শাব্দিক তারতম্যসহ তারিখে তাবারি : ২/ ১৭৪; আল- বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ২/ ২৪৯)।
ইতিহাসের এই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমি হলাম দুই কোরবানির ছেলেসন্তান।’ একটি কোরবানি হলেন ইসমাইল (আ.)। আরেকটি কোরবানি নবীজি (সা.)-এর পিতা আবদুল্লাহ।
এসব ঘটনা প্রমাণ করে মানব ইতিহাসে কোরবানি সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়কারীর ভূমিকা পালন করে।
মানুষকে আল্লাহর পথে ধাবিত করে। বিশেষত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য অর্জনের পথ এই কোরবানি। কোরবানির মাধ্যমেই মুসলমানরা আত্মিক শক্তিতে বলিয়ান হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্বের গোড়ায় রয়েছে কোরবানির অবদান।