ঢাকা রোববার, ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মওলানা রুমির মসনবি শরিফ (কিস্তি- ৫/২৪০)

আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আয়াজ

ড. মওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আয়াজ

সুলতান মাহমুদ গজনভি একদিন দরবারে আসীন। উজির-নাজির আমির-ওমরার উপস্থিতিতে দরবার হল সরগরম। রাষ্ট্রের শীর্ষব্যক্তিরা সমবেত সুলতানকে ঘিরে। তাদের সামনে সুলতান একটি অমূল্য মণিরত্ন বের করলেন পকেট থেকে। তিনি বুঝি রাজ্যের শীর্ষ ব্যক্তিদের জ্ঞান, মেধা, আইকিউ, আনুগত্যের পরীক্ষা নেবেন। রত্নটি মন্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, বলুন তো এই রত্নের মূল্য কত হবে? মন্ত্রী তাৎক্ষণিক উত্তর দিলেন, ১০০ মণ স্বর্ণের চেয়েও দামি হবে জাহাঁপনা। সুলতান বললেন, এই রত্নটি ভেঙে ফেলুন তো।

গোফত বেশকান গোফত চোনাশ বেশকানাম

নীকখাহে মাখযান ও মালাত মানাম

বললেন ভাঙুন বললেন কীভাবে ভাঙতে পারি

আমি যে আপনার কোষাগার ও সম্পদের প্রহরী।

আপনার রাজকোষ ও সম্পদের পাহারাদানের দায়িত্ব আমার ওপর। আমার পক্ষে কীভাবে এমন অমূল্য রত্ন ভেঙে ফেলা সম্ভব। আপনার মন্ত্রী হয়ে কীভাবে আপনার সম্পদের এমন ক্ষতি সাধন করতে পারি?

সুলতান বললেন, সাবাস, আমার মন্ত্রীপ্রবর। তাকে রাজকীয় খেলাত দিয়ে বললেন, আমার মন্ত্রিত্বের যোগ্য যথার্থ ব্যক্তি আপনি। নিজের পরিধেয় রাজকীয় পোশাক খুলে উজিরকে উপহার দিলেন আর রত্নটি তার হাত থেকে নিয়ে নিলেন। এরপর কিছুক্ষণ দরবারে বর্তমান অতীতের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা চলল। সবাই দেখল মন্ত্রীর উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে সুলতান কত বিরাট উপহার দিয়েছেন।

সুলতান আবার রত্নটি একজন দ্বাররক্ষীর হাতে দিয়ে জানতে চাইলেন, বলো তো, নিলামে দিলে এই রত্নের দাম কত হতে পারে? প্রহরী বলল, জাহাঁপনা! আপনার বিশাল রাজত্বের অর্ধেক সম্পদের বিনিময়ে এই আলোকিত অমূল্য রত্ন বিক্রি হতে পারে। আল্লাহ আপনার রাজত্বকে সকল প্রকার দুর্বিপাক থেকে রক্ষা করুন।

সুলতান বললেন, এই রত্নটি আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেল। প্রহরী বলল, জাহাঁপনা! আপনার রাজত্বের দোহাই, আমি কীভাবে এমন অমূল্য রত্ন ভেঙে ফেলতে পারি। দামের কথা বাদ দিন। তার দ্যুতি, কিরণ দেখুন দিনের আলোকেও হার মানায়। কীভাবে আপনার রত্নের আমি ক্ষতি সাধন করতে পারি। বস্তুত মন্ত্রীর অন্ধ অনুকরণে প্রহরীও একই জবাব দিল। সুলতান তাকেও খেলাত দিলেন। তার বেতন-ভাতা বৃদ্ধির নির্দেশ দিলেন আর প্রসংশায় তাকে সিক্ত করল।

আলাপচারিতায় বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর বাদশাহ রত্নটি প্রধান বিচারপতির হাতে দিয়ে একই প্রশ্ন করলেন এবং একই নির্দেশ দিলেন, এটি ভেঙে ফেলুন। প্রধান বিচারপতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জাহাঁপনা! আমি বিচারপতি হয়ে কি আপনার রাজত্বের এত ক্ষতি করতে পারি। সুলতান বললেন, সাবাস আপনার বিচক্ষণতার জন্য। তাকেও মূল্যবান পুরস্কার দিলেন। এভাবে সুলতান রত্নটি একে একে পঞ্চাশ জনকে দিয়ে একই প্রশ্ন ও একই নির্দেশ দিলেন।

কিন্তু সবাই পূর্ববর্তীদের অন্ধ অনুকরণে উত্তর দিলেন ও প্রায় একই ধরনের রাজকীয় খেলাত ও উপহার লাভ করলেন। মওলানা রুমি এবার বলেন,

গরচে তাকলিদ আস্ত উস্তুনে জাহান

হাস্ত রুসওয়া হার মুকাল্লেদ যেমতেহান

যদিও অনুকরণ দুনিয়ার খুঁটি চালিকাশক্তি

কিন্তু লজ্জিত অনুতপ্ত হয় অন্ধ অনুকরকারী।

অন্ধ অনুকরণকারী লজ্জিত হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে মওলানা বলেন, দুনিয়ার যাবতীয় কাজ যদিও অনুকরণের ভিত্তিতে সম্পন্ন হচ্ছে; কিন্তু অন্ধ অনুকরণকারীকে শেষ পর্যন্ত লজ্জিত হতে হবে।

সুলতান সবশেষে রত্নটি প্রিয় কৃতদাস আয়াজকে দিলেন। আয়াজ বিচক্ষণতার পরিচয় দিল। তিনি কারও অন্ধ অনুকরণ করলেন না। বাদশাহ যে সবাইকে খেলাত দিলেন, পুরস্কৃত ও প্রশংসিত করলেন তাতে তিনি প্রলুব্ধ হলেন না। নিজের জ্ঞানবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সতর্কতার পরিচয় দিলেন। কারণ, অন্ধ অনুকরণকারীকে মুমিন বলাই উচিত নয়। মুমিন হলেও যারা না বুঝে অন্যের অন্ধ অনুকরণ করে তারা নিজের আকিদার ওপর অবিচল থাকে না। পরিস্থিতি জটিল হলে তারা পরীক্ষায় ফেল করে বসে। কারণ দৃষ্টিবানদের অবিচলতা তাদের মধ্যে নেই। হ্যাঁ, আল্লাহ যদি চান, অন্ধ অনুকরণকারীকেও আল্লাহ রক্ষা করেন। অন্ধ অনুকরণকারীর এমন দুর্বলতার কারণ হলো, সত্য একটি। তবে সত্যের বিপরীত বা সত্যের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয় অনেক থাকে। কাজেই সত্যের ওপর অটল থাকতে হলে আগে সত্যের বিপরীত মিথ্যাকে চিনতে হবে। যদি মিথ্যাকে না চেনে তাহলে সত্য-মিথ্যা কীভাবে পার্থক্য করবে। অন্ধ অনুকরণকারী যেহেতু সত্য-মিথ্যা বুঝে না, চিনে না, ফলে উভয়ের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। তাই যেকোনো সময় তার পদস্খলন হতে পারে।

যাইহোক সুলতান বললেন, আয়াজ কোথায়? আয়াজ! এই রত্নের দাম কত হতে পারে বল দেখি। আয়াজ জবাব দিল, জাহাঁপনা আমার পক্ষে যত দাম বলা সম্ভব হতে পারে তার চেয়েও বেশি। সুলতান বললেন, এখনই এই মণিরত্নটি ভেঙে ফেল।

আগে থেকেই আয়াজের পকেটে পাথর রাখা ছিল। সেই পাথর দিয়ে সুলতানের অমূল্য রত্নটি চুরমার করে দিলেন তিনি। কারণ তার দৃষ্টিতে এটিই ছিল যথার্থ কাজ। সৌভাগ্য আয়াজের সহায় হয়েছিল, তাই ওই মুহূর্তে দুর্লভ একটি হিকমত তার অন্তরে উদ্ভাসিত হয়েছিল। কিংবা আগে থেকে ঘটনাটি তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, যার কারণে চুপিসারে বগলে দুটি পাথর লুকিয়ে এনেছিলেন। ঘটনাটি ইউসুফ (আ.)-এর ভাগ্যের মতো। তাকে ভাইয়েরা কুয়ায় নিক্ষেপ করেছিল। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটনার শেষ পরিণতি তাকে আল্লাহপাক জানিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখানো তার পক্ষে সম্ভবপর হয়েছিল। আসলে আল্লাহর সাহায্য যার সহায় হয়, তার আশা পূরণ হওয়া না হওয়া এক সমান। পরম বন্ধুর সঙ্গে যার যোগাযোগ হয়ে গেছে জীবনযুদ্ধে তার জয় পরাজয়ের চিন্তা কিসের। সাধক, জাহেদ তো চিন্তায় থাকে তার পরিণাম শুভ ও জয়যুক্ত হবে কি না তা নিয়ে? কিন্তু আরেফ; আল্লাহর পরিচয় পেয়ে সমৃদ্ধ যার অন্তর, তিনি তো পরিণাম নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন না। সারাক্ষণ মগ্ন থাকেন আল্লাহর প্রেমে। আরেফরা শুরু থেকেই বিচক্ষণ। কেয়ামতের দিনের হাল হাকিকত নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় ভোগেন না। আরেফরা প্রথমে আল্লাহর ভয়ে শংকিত থাকেন। কিন্তু আল্লাহর রহমতের আশা তাকে আশাবাদী করে। পরে ভয় ও আশা দুটিই তার কাছে এক সমান হয়ে যায়।

বুদ উ রা বিমো উমিদ আয খোদা

খউফ ফানি শুদ আয়ান গশ্ত আন রজা

আরেফের ছিল শুরুতে আল্লাহর প্রতি ভয় জড়তা

পরে ভয় তিরোহিত হয়ে জাগে বুকভরা আশা।

আরেফও শুরুতে আল্লাহর প্রতি ভয় ও আশার দোলাচালে থাকে। কিন্তু কামালিয়াতে পৌঁছার পর তার মন নিরাপত্তার অনুভবে সমৃদ্ধ হয়ে যায়। আল্লাহর খাস দয়াই তাকে নিয়ে আসে এই মাকামে।

আয়াজের কথায় ফিরে এসে মওলানা বলেন, আয়াজ অমূল্য মণিরত্নটি ভাঙার পর তীব্র প্রতিবাদ জানাল উজির, নাজির, আমির ওমরাগণ। তুমুল হট্টগোল, কী করলে আয়াজ, এমন অমূল্য রত্ন কেন ভাঙলে? কতবড় ধৃষ্টতা তোমার?

সত্য কথা হলো, তারা উজির-নাজির জ্ঞানীপ্রবর হলেও অজ্ঞতায় আড়ষ্ট ছিলেন। সুলতানের প্রতি ভালোবাসার দাবি ছিল, তারা সুলতানের আদেশ মান্য করুক। কিন্তু তাদের মনে মণিরত্নের ভালোবাসাই প্রবল হয়েছিল। ফলে সুলতানের আদেশের মর্যাদা তারা রক্ষা করতে পারেননি।

প্রতিবাদী মন্ত্রী আমির নেতাদের উদ্দেশ্যে আয়াজ বললেন, ওহে নামীদামি ব্যক্তিবর্গ সভাসদগণ! আমার প্রতিবাদ করার আগে আপনারা আমার একটি কথার জবাব দিন। বাদশাহর আদেশের মূল্য বেশি নাকি মনিরত্নের মূল্য অধিক। ওহে যাদের দৃষ্টি ধন-সম্পদ মণিরত্নের দিকে, বাদশাহর আদেশ নিষেধের দিকে যাদের মনোযোগ নেই তারা তো দৈত্যের পেছনে ঘুরপাক খায়। আমি কোনো অবস্থাতেই বাদশাহর দিক থেকে আমার মনোযোগ অন্য কারও দিকে ফিরাব না। পাথর-গাছ-সাগরের দিকে মনোসংযোগ করে আমি পৌত্তলিক মুশরিক হব না। কাজেই রঙিন মূর্তির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তোমার জ্ঞানবুদ্ধিকে রঙের সৃষ্টিকর্তা যিনি তার জন্য অভিভূত করে দাও। এই দুনিয়া রঙিন মূর্তির মতো সেজেগুজে আছে। তার বিচিত্র সাজ ও রঙ পেয়েছে আল্লাহর কাছ থেকে। কাজেই তুমি একান্ত আল্লাহর হয়ে যাও।

আয়াজের বক্তৃতা শুনে সুলতান মাহমুদ গজনভির দরবারের মন্ত্রী, আমির, সচিব ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা লজ্জায় মাথা নোয়ালেন। সবাই ক্ষমা প্রার্থনার সুরে হাহুতাশ করতে লাগলেন। মুহূর্তে দরবারে মাতম আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠল।

সুলতান মাহমূদ জল্লাদকে হুকুম দিলেন, এই মন্ত্রী, বিচারপতি, আমির ওমরা সবার গর্দান উড়িয়ে দাও। যারা সামান্য পাথরের জন্য আমার আদেশ লঙ্ঘন করল, রাজকীয় পদে আসীন থাকার কোনো অধিকার তাদের নেই।

এমন চরম মুহূর্তে আয়াজ এগিয়ে গেলেন। বাদশাহর সিংহাসনের সামনে নতজানু হয়ে যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আরজ করলেন: জাহাঁপনা! আপনি তাদের ক্ষমা করুন। দোষ আমি করেছি। আপনার কাছে তাদের জান ভিক্ষা চাই। আয়াজের ভাষায় এতটুকু বর্ণনায় মওলানার চেতনা চলে গেল উর্ধ্বলোকে। আল্লাহর দরবারে তার ক্ষমা প্রার্থনা কান্নার সুর হৃদয়বিদারী। তুমি দয়াবান, মহিয়ান গরিয়ান। আমরা তোমার গোনাহগার বান্দা, মাফ করে দাও, তুমি রহমান রহিম অতি মেহেরবান।

(মওলানা রুমির মসনবি শরিফের গল্প, ৫ খ. ব: ৪০৩৫-৪১৯৫)

(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন-

CHAYAPATH PROKASHONI)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত