প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৯ আগস্ট, ২০২৫
বেলাল হাবশি (রা.)। পুরো নাম বেলাল ইবনে রাবাহ। ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন। হাবশা, আজকের ইথিওপিয়ায় তার জন্ম। কাফ্রি গায়ের চামড়া ছিল কালো। কিন্তু তার অন্তরাত্মা ছিল উজ্জ্বল, আলোকিত। প্রথম জীবনে কৃতদাস হয়ে মক্কার দাস বাজারে আসেন। কুরাইশ নেতারা ক্রয়সূত্রে তার মনিব হয়ে যায়। তখন ইসলামের প্রথম অবস্থা। প্রিয়নবী মুহাম্মাদ (সা.) মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। অতি সংগোপনে ইসলামের প্রচারকার্য চলছিল। তাওহিদের সে বাণী পৌঁছে যায় কাফ্রি বেলালের কানে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মুসলমান হয়ে যান। এতে ক্ষীপ্ত হয় মক্কার কুরাইশ নেতা তার মনিবরা। হাত বদল হয়ে তিনি দাস হয়ে আসেন মুশরিক সর্দার উমাইয়া ইবনে খালাফের ঘরে। মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার অপরাধে উমাইয়া তার ওপর অত্যাচারের খড়্গ চালায়। তাকে পেটানো হতো কাঁটাযুক্ত লাঠি দিয়ে। আধমরা অবস্থায় ফুটন্ত বালিতে ফেলে বুকের ওপর পাথর চাপা দিত মাঠে। বখাটে ছেলেরা বেলালের পায়ে রশি বেঁধে টানাহিঁচড়া করত পাথুরে জমিতে। কিন্তু বেলালের অবস্থা ছিল-
তন ফেদায়ে খার মি কর্দ আন বেলাল
খাজাআশ মি জাদ বরায়ে গুশেমাল
দেহখানি তাঁর সঁপেছিল কাঁটাদার লাঠির কাছে
মনিব চালাত অত্যাচার ঈমান আনার শাস্তিরূপে। ৮৮৮
কে চেরা তো য়াদে আহমদ মি কুনি
বন্দায়ে বদ মুনকেরে দিনে মনি
বলত, কেন তুমি জপ সেই আহমদের নাম
আমার দাস হয়ে দুষ্টু করেছ আমার ধর্ম ত্যাগ। ৮৮৯
তপ্ত মরুর কড়াইয়ে রেখে তার ওপর চলত কাঁটাদার লাঠির নিষ্ঠুর কষাঘাত। কিন্তু এতসব অত্যাচার সয়ে তিনি বলতেন আহাদুন আহাদ। তিনি এক অদ্বিতীয়। তাঁর বান্দা হয়ে আমি গর্বিত। একদিন আবু বকর সিদ্দিক (সা.) সে পথ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। বেলালের আহাদুন আহাদ ধ্বনি তখন তার কানে এসে বাজল। বেলালের করুণ দুর্দশা দেখে তার চোখ অশ্রুসিক্ত, অন্তর ক্ষতবিক্ষত হলো। কারণ আহাদুন আহাদ ধ্বনিতে আবু বকর (রা.) এক আপনজনের খুশব পাচ্ছিলেন।
বেলালকে একদিন তিনি একা পেয়ে যান। কাছে ডেকে বললেন, বেলাল! চারদিকে কাফির মুশরিকের শাপদরা কিলবিল করছে। পরিস্থিতি সম্পূর্ণ প্রতিকুল। কাজেই সাময়িকভাবে তুমি আহাদুন আহাদ বলা বন্ধ রাখ। তোমার ঈমানের বিষয়টি গোপন রাখ। অবস্থার পরিবর্তন একদিন অবশ্যই হবে। তখন তুমি মন খুলে আহাদুন আহাদ বলতে পারবে। আল্লাহ তো বান্দার অন্তরের খবর জানেন। বেলাল বললেন, মান্যবর, আপনার কথা শিরোধার্য। আমি আর বলব না প্রকাশ্যে। আরেক দিন ভোরে সে পথ দিয়ে সিদ্দিকে আকবর যাচ্ছিলেন। তখনও তিনি শুনতে পেলেন আহাদুন ধ্বনি আর কাঁটার লাঠির আঘাত সমান তালে বাজে। দেখে সিদ্দিকের অন্তরে ব্যথার আগুন জ্বলে উঠল দাউ দাউ লেলিহান শিখায়।
আবু বকর (রা.) আরও একবার একাকী তাকে উপদেশ দিলেন। বেলাল তওবা করলেন, ঈমানের কথা প্রকাশ করবেন না। আহাদুন আহাদ বলবেন না প্রকাশ্যে। কিন্তু প্রেম এসে গ্রাস করল তার এই তওবা। বেলাল মনে মনে বহুবার তওবা করেছেন আর বলব না, আহাদ আহাদ। কিন্তু পরক্ষণে তওবা ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেন আসল রূপে। তিনি ফাঁশ করে দেন আত্মপরিচয়। বলেন, আমি তো নবী মুহাম্মাদ (সা.)-এর পাগল। তাকেই জানি, তাকেই মানি। তার দাওয়াতে আল্লাহর পরিচয় পেয়েছি আমি। তাই আমার এই দেহ সঁপে দিয়েছি আল্লাহর শত্রুদের নিষ্ঠুর অত্যাচার বরণ করার জন্য।
হে প্রিয়তম আল্লাহর নবী, বলুন, এখানে আমার দোষ কোথায়? আপনিই তো আশেকদের তওবা ভেঙে দেন। আমার দেহ, আমার অন্তর, আমার রগরেশা সর্বত্র মুহাম্মাদ আর মুহাম্মাদ। আপনি বলুন, আমার অন্তরে তওবা রাখার আলাদা জায়গা কোথায়। তাই এখন থেকে তওবাকে বিদায় করলাম আমার অন্তরের আঙিনায় ঝাড়ু দিয়ে। বিপদ মুসিবত যাই আসুক আহাদুন আহাদ বলা ছাড়ব না। চিরন্তন যে জীবন তা থেকে কি তওবা করা যায়?
ইশক কাহহার আস্তো মন মকহুরে ইশক
চোন শেকার শিরিন শুদাম আজ শুরে ইশক
প্রেম প্রতাপশালী প্রেমের কাছে আমি সমর্পিত
প্রেমের মধুতে মজে মধুময় আমার পুরো অস্তিত্ব। ৯০২
তুমি আমার প্রেম। আমার অবস্থা শুকনো খড়ের পাতা। তুমি আমার প্রবল ঝড়। আমার অস্তিত্ব, আমার পরিণতি কী হবে আমি জানি না। আমার দেহ জীর্ণশীর্ণ লিকলিকে, তবে আমি নতুন চাঁদের মতো। চাঁদ সদা সূর্যের অনুগত, সূর্যের কাছ থেকে আলো পায়, আমার অন্তরও আপনার নুরের আলো পেয়ে আলোকিত। চাঁদ চিকন হলো না মোটা তা নিয়ে তার মাথাব্যথা কেন। ছায়ার মতো সূর্যকে অনুসরণ করাই চাঁদের কাজ।
মওলান রুমি এখানে বিশ্বব্যবস্থাপনায় একটি সত্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, তকদিরের ফয়সালা যখন এসে যায় তখন মানুষ অসহায়। তার কর্মক্ষমতা রহিত হয়ে যায়। এ সত্যটি যদি কেউ না বুঝে বলতে হবে তার জীবন ষোলাআনা মিছে। আশেকদের অবস্থাও তেমনি। প্রেমের তকদির লিখন এসে গেলে তারা স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো। অতীতে যাঁতাকল চলত পানির তীব্র গতির বেগে। প্রেমিকদের অবস্থা যাঁতার মতো। পানির গতির তোড়ে সারাক্ষণ ঘুর্ণন ছাড়া তার উপায় নেই।
গর নমি বিনি তো তদওয়িরে কদর
দর আনাসের জুশেশ ও গার্দেশ নেগর।
তুমি যদি না দেখ প্রেমের তকদিরের রহস্য
সৃষ্টির উপাদানে দেখ ঘুর্ণন গতি জোর সর্বত্র। ৯১৬
প্রেমের বিধিলিপির রহস্য যদি তুমি বুঝতে না পার, তাহলে সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বস্তুর গতিবিধি নিরীক্ষণ কর, তাতে তোমার অন্তরচক্ষু খুলে যাবে।
সাগর বুকের যে ফেনারাশি ঘুর্ণেয়মান তা সাগরের স্রোত ও তরঙ্গের দ্বারা চালিত। বাতাসের গতিবেগকে দেখ, কীভাবে উতালা হয়ে উঠে। কীভাবে তার হুকুমে সমুদ্রে জলরাশি তরঙ্গে দোলে। আকাশের বুকে চাঁদ ও সূর্য ঘুর্ণেয়মান। এই দুয়ের আকর্ষণে সৃষ্টিজগতের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রিত চলমান। গ্রহ-তারকারা আনাগোনা করে এই কক্ষ হতে ওই কক্ষপথে। তখন সৃষ্টির মাঝে ভূমিকা রাখে সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্যের বাহনরূপে।
আমাদের দেহে স্থাপিত গ্রহণক্ষত্রগুলো দেখ। আমাদের চোখণ্ডকান-চেতনা। লক্ষ্য কর, এগুলো রাতের বেলা কী করে আর দিনের বেলা এদের কী কাজ। আমাদের কান-চোখ জ্ঞানবুদ্ধির তারকারা কখনো খুশিতে মিলনে আহ্লাদিত, কখনও দুর্ভাগ্য বিচ্ছেদে সম্বিত হারিয়ে জর্জরিত। আকাশের চাঁদের অবস্থাও আমাদের চেয়ে ভিন্ন নয়; কখনও হাসে আলোর দ্যুতি ছড়ায়। কখনও অন্ধকারের সাগরে কাতরায়। কখনও বসন্ত আসে খুশির বার্তা লয়ে। কখনও শীতের প্রকোপে জীবন কাঁপে হীম প্রবাহে।
যেহেতু সমস্ত সৃষ্টি তার ইচ্ছার সম্মুখে অবনত, তার সামনে সিজদায় লুটে হয়ে যায় সমর্পিত। হে অন্তর, শত সহস্র সৃষ্টির মাঝে তোমার অবস্থান অতি ক্ষুদ্র নগণ্য, তুমি কেন তার সামনে হবে না বিনীত সিজদায় লুণ্ঠিত। কাজেই তুমি আস্তাবলের ঘোড়ার মতো হয়ে থাক। যখন আস্তাবলে বাঁধা হবে, হয়ে যাবে সুবোধ সুশীল। আর যখন তোমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, কাজের ময়দান উন্মুুক্ত হবে তখন এগিয়ে যাবে নিরলস গতিতে। কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর ইচ্ছা ও সম্মতির বিরুদ্ধে যাবে না। তোমার জ্ঞানবুদ্ধিকে চালিত কর আল্লাহর ইচ্ছা বুঝা ও বাস্তবায়নের দিকে।
বেলালের জীবনও ছিল আল্লাহতে সমর্পিত। আল্লাহর ভালোবাসায় যে কোনো পরীক্ষা মাথা পেতে নিয়ে তিনি পেয়েছেন দুঃখ-কষ্ট-যাতনার মাঝে সাফল্য। কাঁটাদার লাঠির আঘাতে তার দেহ জর্জরিত হয়েছে বটে, তার অন্তর্জগতে প্রস্ফুটিত হয়েছে বেহেশতি কানন। যত অত্যাচারের খড়গ কৃপাণ উত্তোলিত হয়েছে, বেলালের প্রাণ ততই উতলা হয়েছে আল্লাহ ও রাসুলের প্রেমে। সেই প্রেম তাকে নিয়ে গেছে এমন স্থানে, বেহেশতি কাননে, যেখানে আল্লাহর নবী বেলালের পদচারণার আওয়াজ শুনতে পান নিজ কানে।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) উর্ধ্বলোক ভ্রমণে গিয়েছিলেন মেরাজের রাতে। যখন তিনি বেহেশতে প্রবেশ করলেন বেহেশতের এক কোণা থেকে একটি অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসল নবীজির কানে। সফরসঙ্গী জিবরাইলকে জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাইল, কিসের অস্পষ্ট আওয়াজ যেন শুনতে পেলাম। জিবরাইল বললেন, হ্যাঁ, তিনি হচ্ছেন আপনার মুয়াজ্জিন বেলাল। নবীজি (সা.) মেরাজ শেষে যখন মানবসমাজে ফিরে এলেন, বললেন, বেললের জন্য সুসংবাদ, তার জীবন সাফল্যে ভরা। আমি তাকে বেহেশতে এভাবে এভাবে দেখেছি। হাদিসে এসেছে, ‘নবী করিম (সা.) ফজরের নামাজের সময় বেলালকে ডেকে বললেন, হে বেলাল, তুমি আমাকে বল, ইসলাম গ্রহণের সবচে উত্তম কোন আমলটি তুমি করেছ। আমি যে বেহেশতে তোমার খড়ম দুটির আওয়াজ শুনতে পেলাম। বেলাল বললেন, আমি আমি তেমন উত্তম আমল তো করিনি; তবে একটি আমল আমল আমি নিয়মিত করি, তা হলো, আমি দিনের বা রাতের যেকোনো সময়ে যখনই পবিত্রতা অর্জন করি, তার পরপর আমি আল্লাহর দেওয়া তাওফিক অনুপাতে দুই রাকাত নামাজ পড়ি।’ (বোখারি : ১১৪৯)।
বস্তুত কাফের মুশরিকরা অবর্ণনীয় অত্যাচার উৎপীড়ন চালালেও বেলাল (রা.)-এর হৃদয় ছিল আল্লাহ ও রাসুলের প্রেমে উজ্জীবিত, উদ্ভাসিত। তাই এই প্রেমের কথা বুকের সিন্ধুকে লুকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। আবু বকর (রা.) বেলাল হাবশির মনের এ অবস্থা বুঝতে পারলেন। ঈমান ও নবীজির প্রেমের কথা বেলালের পক্ষে গোপন রাখা সম্ভব নয়। তাই তিনি সে আশা ছেড়ে দিয়ে অন্য চিন্তা করলেন। (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ৮৮৮-৯৫২)
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবির গল্পভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)