প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৬ আগস্ট, ২০২৫
বেলাল হাবশি (রা.) আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে বারবার কথা দেন, ঈমানের কথা প্রকাশ্যে বলব না। কিন্তু প্রিয় রাসুলের প্রেমের আকর্ষণে সে কথা রাখতে পারেন না। নিজেকে সামলাতে তিনি অক্ষম। ফলে যখনই আহাদুন আহাদ বলা শুরু করেন, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কাফেরদের অবর্ণনীয় নির্যাতন।
আবু বকর সিদ্দিক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে গিয়ে আরজ করেন, বেলালের অবস্থা হলো, সে এই জগৎ ছেড়ে ভ্রমণ করে ঊর্ধ্বজগতে। আপনার প্রেমে সে আত্মহারা। এত অত্যাচার-নির্যাতন তার কাছে কিছুই না।
কান ফালাক পয়মায়ে মায়মুন বালে চুসত
ইন জামান দর ইশক ও আন্দর দামে তুস্ত।
সৌভাগ্যের ডানা মেলে পাড়ি দেয় সে ঊর্ধ্বলোক
আপনার প্রেমের শিকল গলায় বন্দি তার অন্তর্লোক। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ৯৫৪)।
আবু বকর সিদ্দিক নবী করিম (সা.)-কে জানালেন, উত্তপ্ত বালুকায় শুইয়ে রেখে বেলালকে পাথর চাপা দেয়া হয়। নগ্ন গায়ে কাঁটাদার লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার করা হয়। শরীরের নানা স্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে। এরপরও আহাদ আহাদ বলা ছাড়তে রাজি নয় সে। তাকে বহু উপদেশ দিয়েছি। বলেছি, তোমার ঈমানের কথাটি আপাতত অন্তরে লুকিয়ে রাখ। কাফেরদের কাছে প্রকাশ করে নিপীড়নের শিকার হয়ো না। কিন্তু সে বারণ মানে না।
আশেকাস্তো উরা কেয়ামত আমদাস্ত
তা দরে তওবা বরো বস্তে শুদাস্ত
সে তো প্রেমিক তার যেন কেয়ামত হয়ে গেল
তওবার দরজা বন্ধ যেন সবকিছু খুলে গেল। ( খণ্ড : ৬, বয়েত : ৯৬৮)।
বেলাল তো আশেক। যুক্তিবুদ্ধির ধার সে ধারে না। ঈমানের কথা প্রকাশ্যে বলবে না বলে তওবা করলেও সে তওবা রাখতে পারে না। তার জন্য যেন তওবার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এখনই যেন কেয়ামত হয়ে গেছে। কেয়ামতের দিন যেভাবে সবার মনের কথা প্রকাশ হয়ে পড়বে, বেলালের মনের গোপন ভেদ এখানেই প্রকাশ হয়ে পড়ছে। বেলালের যে প্রেম তা প্রকাশ্য। আল্লাহর জন্যই তার জীবন-মরণ নিবেদিত। সমস্ত সৃষ্টি প্রেমের সাগরে নিমজ্জিত। কেউ তা বুঝতে পারে, কেউ পারে না। বস্তু ও দুনিয়ার প্রেমে মত্ত হয়ে আল্লাহকে ভুলে দেউলিয়া হয়ে যায় দুনিয়াপূজারীর জীবন।
এশকে রব্বানিস্ত খুরশিদে কামাল
আমর নুরে উস্ত খালকান চোন জেলাল
হাকিকি প্রেম তো দেদিপ্যমান সূর্যের মতো
আদেশ জগত তার নুর, সৃষ্টিলোক ছায়ার মতো। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ৯৮৩)।
আবু বকর (রা.)-এর মুখে বেলালের কথা শুনছিলেন নবীজি (সা.) তন্ময় হয়ে। শেষে জানতে চাইলেন এ অবস্থায় করণীয় কি? সিদ্দিকে আকবর জানালেন, আমি বেলালকে কিনতে চাই। যে দামই বলুক, যত টাকাই লাগুক, লাভ হচ্ছে না ক্ষতি সে হিসাব আমি করব না। পৃথিবীতে বেলালের পরিচয় সে আল্লাহর জন্য বন্দি। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ছাড়া তার ধ্যানেজ্ঞানে আর কিছু নেই। যথার্থ অর্থেই সে আল্লাহর দাস, আল্লাহর বান্দা। এ কারণে সে আল্লাহর দুশমনদের ক্রোধের পাত্র।
প্রস্তাব শুনে নবীজি দারুণ খুশি হলেন। বললেন, যখনই তাকে কিনবে আমিও তোমার সঙ্গে শরিক হব। অর্ধেক টাকা আমি দেব, বাকি অর্ধেক তুমি। নবীজির সম্মতি পেয়ে আবু বকর (রা.) ছুটে গেলেন কাফের সর্দারের ঘরে। মনে মনে বললেন, আজ খেলায় মত্ত শিশুর হাত থেকে একটি অমূল্য রত্ন কিনে আনব তুচ্ছ জিনিসের বিনিময়ে। শিশুরা মূল্যবান রত্নের মূল্য বুঝে না। তাই তাদের হাতে মিষ্টান্ন দিয়ে অমূল্য রত্ন হস্তগত করা সহজ। এই জগতের রত্ন হলো ঈমান ও অন্তরের স্বচ্ছতা। দুনিয়ার তুচ্ছ ধনসম্পদ দিয়ে এই রত্ন কেনা যায় আত্মভোলা দুনিয়াপূজারীর কাছ থেকে। চিন্তা করে দেখ, এই দুনিয়া মরা লাশ। শয়তান এই মরালাশকে এমনভাবে সাজায়, যার বিনিময়ে শত শত ফুলবন কেনে নেয় দুনিয়াদারদের কাছ থেকে। দুনিয়ার ভোগ বিলাসিতার সামগ্রী দিয়ে শয়তান ঈমান ও রুহানি স্বচ্ছতার মহাসম্পদ কেড়ে নেয়।
অন চুনান জিনাত দাহাদ মুর্দার রা
কে খরদ জিশান দো সদ গুলজার রা
এমন জৌলুস দেয় মরা লাশকে শয়তান
লাশের বদলায় কিনে নেয় ২০০ বাগান। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ৯৯৪)
আল্লাহ বলেন, ‘এবং তারা যা করছিল শয়তান তা তাদের দৃষ্টিতে শোভন করেছিল।’ (সুরা আনআম : ৪৩)। বয়েতে যে মরালাশের কথা বলা হয়েছে তার মর্ম দুনিয়া। হাদিসে দুনিয়াকে মরালাশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আদ্দুনিয়া জিফাতুন...যারা এই পঁচা লাশের পেছনে জীবন উজাড় করে তারা কুকুর। শয়তান বহুরূপী। তার কারসাজি বিচিত্র। শয়তান জাদুকরের মতো। জাদুকর মানুষের দৃষ্টিশক্তি জাদুগ্রস্ত করে রাতের জোসনাকে বলে, এত আকাশে বিছানো ধবধবে কাপড়। জাদুগ্রস্ত নির্বোধ লোকদের কাছে সে কাপড় বিক্রি করে নগদ টাকার বিনিময়ে। এভাবেই শয়তান দুনিয়াপূজারীদের পুঁজি হাতিয়ে নেয়।
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) চললেন উমাইয়া ইবনে খালাফের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মনে মনে বললেন,
ইন গোহার আজ হার দো আলম বরতর আস্ত
হীন বেখর জিন তিফলে জাহেল কু খর আস্ত
এই রত্ন উভয় জগতের চেয়েও উত্তম বুঝে নাও তা
মূর্খ শিশুর কাছ থেকে কিনে নাও, সে তো গাধা। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ১০০০)
বেলালের যে রুহসত্তা আছে তার মূল্য যে বুঝে না তাকে মূর্খ শিশুর সঙ্গে তুলনা করলে যথার্থ হবে না। তাকে বলতে হবে আহম্মক গাধা। গাধা বুঝবে না মণিরত্ন মূল্য কতবড় অমূল্য ধন। তুমি কী দেখেছ কোনো গাধা কানে মণিরত্ন পরে? জওয়াব হবে, অবশ্যই না। কারণ, গাধা চিনে না কোনটা কান বা কানের দুলের রত্ন কেমন। আল্লাহ জন্তু জানোয়ারকে সেই বোধশক্তি দেননি। পক্ষান্তরে মানুষের অবস্থা দেখ। তাকে আল্লাহ দিয়েছেন মূল্যবান ও মূল্যহীনে পার্থক্যজ্ঞান। এর মর্ম বুঝতে হলে,
আহসানুত তাকবিম দর ওয়াত্তিন বেখান
কে গেরামি গওহার আস্ত আই দোস্ত জান
আহসানুত তাকবিম এর মর্ম পড় ওয়াত্তিন সুরায়
কারণ, প্রাণ অমূল্য রতন গচ্ছিত মানব কায়ায়। (খণ্ড : ৬, বয়েত : ১০০৫)।
মানুষকে যে আত্মা দেয়া হয়েছে এর সঙ্গে মণিরত্নের মূল্যও তুলনীয় নয়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে সুন্দরতম গঠনে।’ (সুরা ওয়াত্তিন : ৪)। ‘সুন্দরতম গঠন’ মানে তো মানুষকে দেওয়া সেই রুহ, অমূল্য প্রাণসত্তা, যা অন্য প্রাণিকে দেয়া হয়নি। সুন্দরতম গঠন- এই প্রাণসত্তা, পবিত্র আত্মার মূল্যমান কত তা কি আন্দাজ করতে পার?
আহসানুত তাকবিম আজ আরশ উ ফজুন
আহসানুত তাকবিম আজ ফিকরাত বুরুন
‘আহসানুত তাকবিম’ তা আরশের চেয়ে উত্তম
তোমার ধারণা কল্পনার ঊর্ধ্বে সে ‘সুন্দরতম গঠন’।
আবু বকর সিদ্দিক (রা.) দরজায় নাড়া দিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন কাফেরের ঘরে। তিনি অনেকটা বাধনহারা, অগ্নিশর্মা তার চেহারা। মুখ থেকে বেরিয়ে এল কয়েকটি কড়া কথা।
কিন ওয়ালিয়ুল্লাহ রা চোন মি জনি
ইন চে হেকদ আস্ত আই আদুববে রওশনি
কেন এই আল্লাহর অলির ওপর অত্যাচার চালাও
কেমন হিংসুটে অমানুষ তুমি মানবতার, শত্রু নও? (খণ্ড : ৬, বয়েত : ১০১১)।
তোমারও তো ধর্ম আছে। তোমার ধর্ম কি বলে যে, একজন নিরাপরাধ সৎলোকের ওপর এভাবে নিপীড়ন চালাও? কিসের ধর্মকর্ম কর। তুমি আল্লাহর কাছে ঘৃণিত, মানুষের নজরেও তুচ্ছ ঘৃণিত। তুমি তোমার বিকৃত মনের উল্টা চোখ দিয়ে সবকিছু দেখছ। তাই বেলালের মতো একজন বেহেশতি পুরুষকে শত্রু বলে ভাবতে পারছ।
আবু বকর (রা.)-এর মুখ দিয়ে সেদিন যা বের হলো তার ওজস্বীতা বর্ণনা দেওয়ার সাধ্য কোনো লিখনির বা কলমের নেই। ফুরাতের জলরাশি যেন দুকুল চেপে জলমগ্ন করছিল চারিদিক। তার ভাষা ছিল পাহাড়ি নির্ঝরের মতো। পাহাড়ি ঝরনা উৎসারিত হয় পাথরের বুক থেকে। কিন্তু আসলে কী পাথরের বুকে পানি আছে। না! আসল ব্যাপার পানি আসে আল্লাহর কাছ থেকে।
আল্লাহ পাথরকে স্বচ্ছ সলিলের বাহন হিসেবে নির্ধারণ করেন। তোমার চোখের জ্যোতির মতো। চোখের জ্যোতি কি চোখের গোশতের টুকরার ভেতর থেকে আসে, নাকি চামড়া থেকে? নিশ্চয়ই এই জ্যোতি আসে রুহের জগত হতে। কানে বাতাসের প্রবাহ বাজে, শব্দ তরঙ্গ হয়ে তা কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। সেই শব্দ তরঙ্গ থেকে সত্য মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ের কাজ কি কানের খোলস থেকে হয়, নাকি শব্দ তরঙ্গ থেকে?
এই যে কান, এই যে বাতাস আর শব্দতরঙ্গ তা আচ্ছাদন ছাড়া আর কিছু নয়। কান হলো শ্রবণের হাতিয়ার, শ্রবণের উৎস নয়। যারা বাহ্যদর্শী বস্তুবাদী তারা মনে করে শ্রবণশক্তি কানের নিজস্ব। কিন্তু যাদের অন্তর আত্মিক জ্ঞানে আলোকিত তারা বিশ্বাস করে, শ্রবণশক্তি স্বয়ং আল্লাহর দেয়া। আবু বকর সিদ্দিকের সেদিনের কথা ছিল আল্লাহর কাছ থেকে আগত। তাই তার প্রভাব ছিল ভূমিকম্পের মতো। উমাইয়া বলল, আবু বকর, এই কদাকার দাসের জন্য যদি তোমার এতই প্রাণ জ্বলে, উচিত দামে কিনে নাও, দিয়ে দেব তোমাকে? (মওলানা রুমির মসনবি শরিফ, খণ্ড : ৬, বয়েত : ৯৫৩-১০২৫)।
(ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী রচিত মসনিবি শরিফের গল্প ১-৬ খণ্ড প্রকাশ করেছে ছায়াপথ প্রকাশনী, মসজিদ বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্স, ১৪৯/এ, এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, ঢাকা। ফোন ০১৭১১১১৫৮২৯। মসনবিন গল্প-ভিত্তিক আলোচনা শুনতে ইউটিউবে ভিজিট করুন- CHAYAPATH PROKASHONI)