প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫
উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় ইতিহাসে সৈয়দ আহমদ খান এক বিশিষ্ট পুরুষ। তিনি ১৮১৭ সালের ১৭ অক্টোবর দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন।
তাকে বাদ দিয়ে যেমন সেদিনকার ভারতীয় ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়, তেমনি ১৮৫৭ এর বিপ্লবোত্তর ভারতীয় মুসলমানদের ভাগ্য নির্মাতা হিসেবে তার নামকে খাটো করাও অসম্ভা। তিনি ছিলেন একাধারে সুপণ্ডিত, ধর্মতত্ত্ববিদ, লেখক, সংস্কারক ও কুশলী রাজনীতিবিদ। ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা ও আধুনিক চিন্তার প্রসারে তিনি অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছেন। অন্যদিকে ভারতবর্ষে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক রাজনীতির উত্থানেও তার ভূমিকা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে যে একটা পৃথক জাতি- এটা ভারতে সৈয়দ আহমদের পথ ধরেই প্রতিষ্ঠা হয়। আর সৈয়দ আহমদের দেখানো পথে ভারতীয় মুসলমানরা সেকুলার জাতীয়তাবাদের বেড়া ভেঙে মুসলিম জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে একত্রিত হয়। সৈয়দ আহমদ যে ধারা তৈরি করেছিলেন, তার পরম্পরায় মোহাম্মদ আলি, আল্লামা ইকবাল, সলিমুল্লাহ, জিন্নাহ এগিয়ে এসেছিলেন। এই পরম্পরা তৈরি না হলে ভারতবর্ষের মুসলমানরা সম্প্রদায় থেকে জাতিতে পরিণত হতে পারত না এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তারা পিছিয়ে যেত। রামমোহন যেমন করে খ্রিষ্টান রাজের সহযোগিতায় তৎকালীন সময়ের হিন্দুদের ভেতর জাগরণ আনার চেষ্টা করেছিলেন, তেমনি সৈয়দ আহমদও রাজের অনুকূল্যে এক ধরনের মুসলিম জাগরণ আনার চেষ্টা করেছিলেন। ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্য থেকে তিনি মুসলমানদের একটি আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো এটা না হলে খ্রিষ্টান ভারতের মুসলমানরা একটা সর্বব্যাপী আত্মপরিচয়হীনতার অন্ধকারে ডুবে যেত। সৈয়দ আহমদের ধর্মীয় চিন্তার সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকলেও তার রাজনৈতিক চিন্তা মুসলমানদের সুদূরপ্রসারী কল্যাণের পথ দেখিয়েছে।
মোঘল সাম্রাজ্যের পতন ও অপসারণের ফলে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছিল ভারতের মুসলিম রাজনীতি। সেই রাজনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করে ভঙ্গুর মুসলমান সমাজকে নবযৌবন দান করে বাস্তববাদী এই অভিজাত রাজনীতি-কুশল ব্যক্তিটি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। সৈয়দ আহমদের বাস্তব বুদ্ধির কারণে ভারতে মুসলিম জাতি তার প্রতিপত্তি ও ইজ্জত ফিরে পেয়েছিল। তিনি শেষ জীবনে দেখে গিয়েছেন মুসলমানরা ব্রিটিশের সঙ্গে এক আসনে বসে নীতি নির্ধারণ করছে। আধুনিককালে ভারতে মুসলিম জাগরণের উৎপত্তি হিসেবে কেউ কেউ স্যার সৈয়দ আহমদ খানের মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নির্ধারণ করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলমানদের আধুনিক ও ইংরেজি শিক্ষার জন্য ১৮৭৭ সালে আলীগড়ে অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এ কাজের জন্য তাকে আলেমদের কাছে অপদস্থ ও নিগৃহীত হতে হয়েছিল নানাভাবে। একজন বিশিষ্ট আলেম তাকে অপমান করার জন্য তার কলেজের সাহায্যার্থে একজোড়া ছেঁড়া জুতা তাঁর নামে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। স্যার সৈয়দ সেই জুতা মুচির দ্বারা মেরামত করে বাজারে বিক্রি করেন এবং মুচির মজুরি বাদে দুইআনা লাভ করেন। শেষে জুতার মালিককে কলেজের চাঁদার দুইআনার পাকারশিদ সহ চিঠি পাঠিয়েছিলেন। উক্ত পত্রের মর্ম ছিল এমন- ‘জনাব, আপনার প্রেরিত জুতা সারা হিন্দুস্তানের মুসলমানদের পক্ষ থেকে আমি মাথায় তুলে নিয়েছি। জুতা বিক্রি করে যে দুইআনা লাভ হয়েছে তা কলেজের তহবিলে জমা দেওয়া হয়েছে।’ অন্যদিকে স্যার সৈয়দ আহমদকে ইংরেজি শিক্ষার পক্ষে ফতোয়া দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন মাওলানা কেরামত আলি জৈনপুরী।
সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর মুসলমানদের ওপর যে চরম দুর্দশা নেমে আসে, সে সম্পর্কে সৈয়দ আহমদ চিন্তা করেন এবং এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এসব কিছুর মূল কারণ হলো অজ্ঞতা। এ সম্পর্কে অধ্যাপক আবু মহামেদ হবিবুল্লাহর মন্তব্য সবিশেষ প্রণিধানযোগ। তিনি লিখেছেন, ‘মোটামুটিভাবে বলা চলে যে, ইংরেজ শাসনের সঙ্গে উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের একটা আপোষ মীমাংসার আশু প্রয়োজন থেকে এ চিন্তাসূত্রের উদ্ভব হয়। সিপাহী বিদ্রোহের ব্যর্থতায় ওহাবিদের সংগ্রামী প্রচেষ্টার নিষ্ফলতা স্পষ্টরূপে প্রমানিত হয়ে যাওয়ার পর মুসলমানদের আত্মরক্ষার অন্য কোনো উপায় ছিল না। একদিকে অভিজাতরা প্রভাব ও প্রতিপত্তি হারাতে বসেছিল, আর অন্যদিকে শিক্ষক, উকিল, আমলা, চিকিৎসক প্রমুখ বুদ্ধিজীবীর জীবিকার ক্ষেত্র পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রাধান্যের ফলে ক্রমেই সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় বোম্বাই, মাদ্রাজ ও বাংলাদেশের হিন্দুরা ইংরেজদের ওপর আস্থা স্থাপন করে যে সহযোগিতা ও আনুগত্যের নীতি গ্রহণ করে লাভবান হয়েছিল, উত্তর ভারতীয় মুসলমানদেরকেও সেই একই নীতি গ্রহণ ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। খ্রিষ্টান শাসনকে গ্রহণ ও তার সঙ্গে সহযোগের মনোভাব মুসলমানদের মধ্যে জাগাতে হলে অবশ্য তাদের মনের অভ্যাসের আমূল পরিবর্তন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে নতুন পথে চালিত করা প্রয়োজন। একটি সম্প্রদায়কে তার অভ্যস্ত চিন্তারীতি ও কর্মপদ্ধতির ঐতিহ্য ছাড়াতে হলে শুধু নতুন চিন্তাসূত্র ও দিকদর্শনেরই প্রয়োজন নয়, তার সঙ্গে পরম আত্মপ্রত্যয়, একটি অনন্যতাবোধ ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিরও প্রয়োজন ছিল। একারণেই সৈয়দ আহমদ শাসক ও শাসিত উভয়কে শিক্ষা দেওয়ার কাজ হাতে নেন এবং সম্ভাব্য সংঘাত ও ভুল বুঝাবুঝির কারণ দূর করতে সচেষ্ট হন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি ভারতে বিদ্রোহের কারণ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তিনি লক্ষ্য করেন তাঁর স্বধর্মীয় মুসলমানদের শিক্ষাদীক্ষা যুগের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। তাইতো তিনি সারা জীবন মুসলমানদের শিক্ষার উন্নতির জন্যে কাজ করে গেছেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থতার পর ভারতীয় হিন্দুরা মুসলমানদের ওপর মনের সাধ মিটিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছিল, পূর্বাপর সমস্ত শত্রুতার প্রতিশোধ গ্রহণ করছিল। মুসলমানদের অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য কোনো প্রমাণের প্রয়োজন ছিল না। মুসলমান হওয়াটাই তাদের অপরাধী হবার জন্য ছিল যথেষ্ট।
ভারতে বিদ্রোহের কারণ বইটি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব-উত্তর উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে লেখা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের রচিত আসবাব-এ বাগাওয়াত গ্রন্থের অনুবাদ। এতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান সিপাহী অভ্যুত্থান-উত্তর উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ওই বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার প্রকৃত কারণগুলো তুলে ধরেন । এই রচনার মাধ্যমে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ওই বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুঃশাসনকে দায়ী করেন।
পাশ্চাত্য কীভাবে তার উনবিংশ শতাব্দীর অবস্থায় উপনীত হয়েছিল সেই সম্পর্কে মুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন বেখবর। তাদের মধ্যে যখন কেউ একবার ইউরোপ ভ্রমণে যেতেন আর ইউরোপ সম্পর্কে ভাঙাচুরা কিছু জ্ঞান অর্জন করতেন অমনি তার চাকচিক্যে তারা হতভম্ব ও অভিভূত হয়ে পড়তেন। তখন তখনই তারা ভাবতে শুরু করতেন প্রাচ্যের মুসলমানরা কিছুতেই খ্রিষ্টান পাশ্চাত্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হবার দাবি করতে কিংবা তাদের প্রতিরোধ করবার কল্পনাও করতে পারেন না। স্যার সৈয়দ আহমদ খান প্রথম জীবনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিলেন। কিন্তু ব্রিটেন সফর সৈয়দ আহমদকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পাশ্চাত্যের বিশাল সভ্যতা এবং তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি দেখে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তার সংগ্রামের বাসনাশূন্যে মিলিয়ে যায়। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম তার কাছে মনে হলো প-শ্রম। তিনি এটিও মনে করতেন যে, ব্রিটিশদের পরাজিত করতে হলে তাদের মত জ্ঞান ও শক্তি অর্জন করতে হবে। পরবর্তীতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান পাশ্চাত্যে সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবক্তা হয়ে উঠেন। ১৮৯৮ সালের ২৭ মার্চ সৈয়দ আহমদ ইন্তেকাল করেন।