ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৯ মে ২০২৫, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজার সৈকতের সরকারি জমি দখলে ২০০ কোটি টাকার কারসাজি

জাল কাগজে ‘অস্তিত্বহীন’ মালিক!
কক্সবাজার সৈকতের সরকারি জমি দখলে ২০০ কোটি টাকার কারসাজি

কক্সবাজার শহরের কলাতলীর প্রধান সড়ক থেকে সুগন্ধা পয়েন্ট সৈকতে নামতেই চারলেনের সৌন্দর্যবর্ধন সড়ক। এ সড়কের বামপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে রঙ-বেরংয়ে উঁচু টিনের ঘেরা যে কারও নজর কাড়ে। ঘেরার উপরিভাগে সাঁটানো আছে কয়েকটি সাইনবোর্ড। একটি সাইনবোর্ডে বড় হরফে লেখা ‘নিষেধাজ্ঞার আদেশ’। অপরটি ছোট হরফে লেখা ‘সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি’। ‘নিষেধাজ্ঞার আদেশ’ সাইনবোর্ডটি দখলদারের আর সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি লেখা সাইনবোর্ডটি জেলা প্রশাসনের। ছয় মাস ধরে ঝুলে থাকা দুটি সাইনবোর্ড দেখে ঘেরার ভেতর কী হচ্ছে-তা বোঝার জো নেই।

শুধু তা-ই নয়, দখলদার চক্র তালাবদ্ধ ঘেরার প্রধান ফটকে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে। এতে লেখা হয়েছে- এই প্রতিষ্ঠান সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সংরক্ষিত এলাকা,উন্নয়ন কাজ চলিতেছে। বিনা অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। এভাবেই উঁচু ঘেরা দিয়ে সম্প্রতি হোটেল-মোটেল জোনের ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ২ একর ৩০ শতক সরকারি খাস জমি দখল করে শতাধিক দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে জবরদখলকৃত ২০০ কোটির এই সরকারিতে নির্মিত অবৈধ স্থাপনাসহ যাবতীয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন দুদকের এই দল।

এতে নেতৃত্ব দেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় কক্সবাজার এর সহকারী পরিচালক অনিক বড়ুয়া বাবু। তাদের সাথে ছিল থানা পুলিশের একটি দল। প্রায় এক ঘণ্টা ঘটনাস্থলে অবস্থান করেন অভিযুক্তদের সাথে কথা বলেন ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন দুদক কর্মকর্তা অনিক বড়ুয়া বাবুসহ অন্যান্যরা।

এসময় সংবাদ সংগ্রহের গেলে গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে প্রবেশে বাধা দেন শিমুল নামের এক জবরদখলকারী। শুরুতেই গেইট বন্ধ করে দিয়ে সংবাদকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেননি। তবে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ করে শেষ মুহূর্তে সাংবাদিকরা প্লটের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন।

এসময় দুদক কর্মকর্তা অনিক বড়ুয়া বলেন, ‘কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে জমিটি সরকারি মালিকানাধীন। জাল দলিল ও খতিয়ান তৈরি করে জমিটি অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে। যারা এই এই জবরদখলের সাথে জড়িত তাদের সবার বিরুদ্ধে আমাদের আইন মতে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ’

তিনি আরো বলেন, ‘যদি এই জবরদখলের সাথে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীও থাকে তাদের বিরুদ্ধেও আইনমতো ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের একটি দখলদারচক্র জাল কাগজ বানিয়ে জমিটি চার বছর ধরে দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রশাসনিক শিথিলতার সুযোগে এই চক্র হোটেল-মোটেলজোনের বাতিলকৃত প্লটের জমি দখল করে নিয়েছে। সম্প্রতি ঘেরার ভেতরের দোকান নির্মাণের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এ নিয়ে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) সূত্রে জানা গেছে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বরাদ্দকৃত হোটেল-মোটেলজোনের ৪৯টি প্লট ২০১১ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে বাতিল করা হয়। কলাতলীর হোটেল-মোটেল জোনের এ জমি পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) এবং বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নীতিমালা অনুসরণ না করায় প্লটগুলো বাতিল করা হয় বলে রায়ে জানানো হয়। এরপর থেকে প্লটগুলো জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

সেই বাতিলকৃত প্লটে ২ একর ৩০ শতক খাস জমি সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত নামের এক ব্যক্তিকে মালিকানা দাবি করে জাল কাগজপত্র বানিয়ে রাতারাতি মার্কেট নির্মাণের কাজ শুরু করেছে দখলদারেরা। চক্রটি গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর জাল কাগজ দাখিল করে হাইকোর্ট থেকে একটি নিষেধাজ্ঞার আদেশও নিয়ে আসেন।

এই আদেশের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসন হাইকোর্টে আপিল করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত স্থিতাবস্থা জারি করেন। কিন্তু দখলদার চক্রটি মাসখানেক ধরে রাতের আঁধারে মূল্যমান সরকারি জমিটি মাটি ভরাট করে ঘেরার ভেতরে সেমিপাকা করে আট লাইন দোকান তৈরি করে। প্রতিটি লাইনে ১২টি করে দোকান বানানো হয়েছে।

কার হাতে সরকারি এই খাসজমি

২০২১ সালের শুরুতে সুগন্ধা পয়েন্টের এই জায়গায় চকরিয়া উপজেলার ভেওলা মানিকচর এলাকার সায়রা খাতুন ১ একর ১০ শতক জমি রয়েছে কাগজ দেখিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ কক্সবাজার জেলা শাখার সহ-সভাপতি ওবাইদুল হোসেন নামের এক ব্যক্তির নেতৃত্বে জমিটির এক অংশ দখল হয়। সেখানে ওবাইদুল ও মোনাফ সিকদার একটি শুঁটকি মার্কেট তৈরি করেন। পাশের আরেকটি অংশে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী টং নামে একটি রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করেন। মূল্যবান এই জমির দখল নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের মধ্যে গ্রুপিং দেখা দেয়।

জমিটির দখলকে কেন্দ্র করে সে সময় ওবাইদুল হোসেনের অন্যতম সহযোগী জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মোনাফ সিকদার গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে থানায় মামলা হয়েছিল। প্রভাবশালী এই আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার ঘটনায় সে সময় দুইদিন আন্দোলন-সংগ্রামে অচল ছিল পর্যটন শহর।

দীর্ঘদিন দখল প্রক্রিয়া বন্ধ থাকার পর একই চক্র গত বছরের ৫ আগস্টের পরে ফের সক্রিয় হয়ে উঠে। চক্রটি সরকারের পরিবর্তনের পর বিএনপিসহ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন পেশার প্রভাবশালীদের নিয়ে নতুন চক্র গড়ে তুলে। চক্রটি সায়রা খাতুনের সাইনবোর্ডটি রাতারাতি গায়েব করে সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামের নতুন মালিক হাজির করেন। সায়রা খাতুনের নামে ১ একর ১০ শতক দেখালেও সচ্চিদানন্দের নামে এই জমি বেড়ে দাঁড়ায় ২ একর ৩০ শতক।

সম্প্রতি ওবাইদুল হোসেন নিজেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে। ওবাইদুল এও বলেছেন, সম্প্রতি জেলা বিএনপির কার্যালয়ে সংস্কারেও তার অনুদান রয়েছে।

জানা গেছে, জুলাই-আগস্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে ওবাইদুল হোসেন আসামি হয়ে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। সম্প্রতি জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বিএনপি সেজে দখল বাণিজ্যে নেমেছে। ওবাইদুল হোসেন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি সচ্চিদানন্দ সেনগুপ্ত নামের এক ব্যক্তি থেকে জমিটি চুক্তি মূলে ভাড়া নিয়ে মার্কেট করছেন।

যেভাবে ধরা পড়ে জাল-জালিয়াতি

ভূমি অফিসের নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ওই জমি ব্যবহারের জন্যে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কউক) বরাবর আবেদন করেন সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত। এরপর কউক ভূমি অফিসে জমির কাগজ যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে জাল-জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

গত বছরের ১২ জুন কউকের উপনগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল জেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কাছে এক চিঠিতে লেখেন, কক্সবাজার সদর ভূমি অফিসের দুটি সরকারি নথি জাল করে ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্রের আবেদন করেছেন। এই চিঠিতে আরও দেখা যায়, সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের দাখিলকৃত ৭৯০০ নং বিএস খতিয়ানটি জাল। তিনি পরপর দুইবার জাল কাগজ দাখিল করার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়।

উপ নগর পরিকল্পনাবিদ মো. তানভীর হাসান রেজাউল বলেন,‘ যে কোন স্থাপনা নির্মাণের আগে কউকের ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন নিতে হয়। সুগন্ধা পয়েন্টের ওই জমিতে কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।’

জাল খতিয়ানে স্বাক্ষর রয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামীর। তুলনাকারক হিসেবে ভূমি অফিসের নাজির মোহাম্মদ আলমগীর ও নকলকারক হিসেবে কর্মচারী মোহাম্মদ আয়াছের স্বাক্ষর আছে। আরিফ উল্লাহ নিজামী বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত।

এ বিষয়ে তিনি বলেন,‘ আমাদের স্বাক্ষর জাল করে খতিয়ান সৃজন করে একটি চক্র সরকারি জায়গাটি দখল করেছে।’

কক্সবাজার সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমিন সুলতানা জানান, জাল কাগজ বানিয়ে সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আসার পর সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তসহ দুইজনের বিরুদ্ধে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া ভূমি অফিসের রেকর্ডপত্র দেখে, সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত নামে কোনো ব্যক্তির খতিয়ানের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের অস্তিত্ব নেই

আলোচিত সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্তের বাড়ি দেখানো হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের কোতায়ালী থানার সতীশ বাবু লেইন এলাকায়। তাঁর পিতার নাম নুপেন্দ্র মোহন সেন গুপ্ত। এ পর্যন্ত জেলা প্রশাসন,ভূমি অফিস ,কউক কিংবা দখলে নেওয়া জমির আশপাশে সচ্চিদানন্দ নামের এই ব্যক্তিকে কেউ দেখেননি।

সদ্য বদলী হওয়া কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বিভীষণ কান্তি দাস বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত নামের এই ব্যক্তির জমি থাকার বিষয়টি আলোচনায় আছে। কিন্তু তাকে কোনো সময় ভূমি অফিস বা রেভিনিউ অফিসে দেখা যায়নি। তাঁর অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, মূলত জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী চক্র সচ্চিদানন্দ সেন গুপ্ত নামের অস্তিত্বহীন এই ব্যক্তির নামে সরকারি জমি দখল করেছে। এ পর্যন্ত সব কাগজ পর্যালোচনা করে তা দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নিজাম উদ্দিন আহমেদ বলেন,‘ সরকারি খাস জমি দখলের বিষয়টি নজরে আসার পর সবধরণের স্থাপনা সরিয়ে নিতে গত সোমবার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই না সরালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

গেল কয়েকদিন আগে কক্সবাজারে সফরে আসেন দুই উপদেষ্টা। এসময় সাংবাদিকদের নানা প্রশ্ন উত্তরে 'বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতের পাশে নির্মাণ কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যদি লাগাম টেনে ধরা না হয় তবে সাধারণ মানুষের সি বিচ ব্যক্তির সি বিচ বা প্রতিষ্ঠানের সি বিচ হয়ে যাবে। এটা হতে দেয়া যাবে না।’

সরকারি,জমি,দখল
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত