হাজার হাজার বছর আগে আধুনিক নৌকা, মানচিত্র বা ধাতব যন্ত্রপাতি ছাড়াই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথে যাত্রা করতেন প্রাচীন মানুষেরা? কিন্তু তারা কীভাবে এমন অসম্ভবকে সম্ভব করতেন? এমন প্রশ্নের কিছু উত্তর উঠে এসেছে ‘ইউনিভার্সিটি অফ টোকিও’র অধ্যাপক ইয়োসুকে কাইফুর নেতৃত্বে পরিচালিত নতুন এক গবেষণায়। প্রাচীন মানুষ কীভাবে আজকের তাইওয়ান থেকে জাপানের দক্ষিণের দ্বীপপুঞ্জ, যেমন- ওকিনাওয়ার দিকে সমুদ্র পাড়ি দিতেন তা কম্পিউটার মডেল ও বাস্তব পরীক্ষার মাধ্যমে খতিয়ে দেখেছেন তিনি ও তার গবেষণা দলের সদস্যরা।
গবেষকরা বলছেন, প্রাচীন মানুষরা ৩০ হাজার বছরেরও বেশি আগে পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছেছিলেন, যা আমাদের জানা। তবে আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি তারা কীভাবে দ্বীপ থেকে দ্বীপে যাতায়াত করতেন, বিশেষ করে উত্তাল সমুদ্র কীভাবে পাড়ি দিতেন তারা। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও দ্রুততম সাগর স্রোত হচ্ছে কুরোশিও স্রোত, যা জাপানের এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে বয়ে যায়। অনেকের দাবি, এ স্রোত পাড়ি দিয়ে সরাসরি যাত্রা করা অসম্ভব এবং পথভ্রষ্ট হওয়ার শতভাগ আশঙ্কা রয়েছে। তাই, কাইফুর গবেষণা দলটি পরীক্ষা করে দেখেছেন, প্রাচীন মানুষদের এ কাজ করার দক্ষতা ছিল কি না। গবেষকরা প্রাচীন যুগের পাথরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে একটি নৌকা তৈরি করেছেন, ঠিক যেমনটি প্রাথমিক মানুষেরা ব্যবহার করতেন বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ। এজন্য জাপানি দেবদারু গাছ থেকে ৭.৫ মিটার লম্বা ‘সুগিম’ নামের একটি নৌকা তৈরি করেছেন গবেষকরা। তারপর ২০১৯ সালে এটি ব্যবহার করে তারা পূর্ব তাইওয়ান থেকে ওকিনাওয়ার কাছে ইয়োনাগুনি দ্বীপ পর্যন্ত ২২৫ কিলোমিটারের বেশি দূর পর্যন্ত যাত্রা করেন। এ যাত্রায় তাদের ৪৫ ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে এবং এ সময় তাদের কাছে কোনো মানচিত্র, কম্পাস বা জিপিএস ছিল না। তাদের কাছে পথ দেখানোর জন্য কেবল ছিল সূর্য, ঢেউ ও তাদের স্বাভাবিক অনুভূতি।
গবেষকরা বলছেন, এটি ছিল কঠিন এক যাত্রা। অধিকাংশ সময় তারা যে দ্বীপটির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন তা দেখা যেত না। তবুও তারা সফল হন, যা থেকে ইঙ্গিত মেলে, এ ধরনের যাত্রা পাথর যুগের যন্ত্রপাতি ও জ্ঞান দিয়েও সম্ভব। বিভিন্ন ভ্রমণ পথ, যাত্রা শুরুর জায়গা ও নৌকা চালানোর কৌশল পরীক্ষার জন্য শত শত কম্পিউটার সিমুলেশন চালিয়েছে গবেষণা দলটি। তারা বলছেন, একক নৌকা সফর দিয়ে যে সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেত না সেগুলো জানতেও তাদের সাহায্য করেছে এসব ভার্চুয়াল যাত্রা। গবেষণার এসব সিমুলেশন থেকে ইঙ্গিত মিলেছে, তাইওয়ান থেকে উত্তরে যাত্রা শুরু করার সবচেয়ে ভালো বিকল্প ছিল প্রাচীন মানুষের কাছে। এমনকি সরাসরি লক্ষ্যের দিকে যাওয়ার চেয়ে একটু দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নৌকা চালানো কুরোশিও স্রোতের শক্তি সামলাতে সাহায্য করেছে তাদের।
গবেষকরা বলছেন, প্রাচীন মানুষদের কাছে মানচিত্র বা আধুনিক বিজ্ঞান না থাকলেও তাদের কাছে ছিল সমুদ্র সম্পর্কে চমৎকার জ্ঞান। গবেষকরা প্রথমে ভেবেছিলেন প্রাচীন মানুষরা হয়তো ভেলা ব্যবহার করতেন তবে আগের বিভিন্ন পরীক্ষায় উঠে এসেছিল, কুরোশিও স্রোতের সঙ্গে টিকে থাকতে ভেলা খুব ধীর ও ভঙ্গুর। অন্যদিকে গবেষকদের খোদাই করা নৌকাটি ছিল মজবুত ও সমুদ্র যাত্রার জন্য উপযোগী। তবে গবেষকদের অনুমান, হাজার হাজার বছর আগে যারা এ পথে যাত্রা করেছিলেন সম্ভবত তারা আর এদিকে ফিরে আসতে পারেননি। ওই সময় মানচিত্র বা সাগরের স্রোতের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান ছাড়া ফিরে আসা প্রায় অসম্ভবই ছিল। এ প্রাচীন যাত্রীরা ছিলেন সত্যিকারের সাহসী অনুসন্ধানকারী, যারা নতুন ভূমিতে পৌঁছাতে সবকিছু ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলেন, এমনকি নিজেদের জীবনও। এ প্রকল্পটি ১৯৪৭ সালের বিখ্যাত ‘কন-টিকি’ যাত্রার মতোই এক ধরনের ‘প্রায়োগিক প্রত্নতত্ত্ব’। কেবল হাড় বা যন্ত্রপাতি খনন করে নয়, বরং বিভিন্ন প্রাচীন অভিজ্ঞতাকে বাস্তবে পুনর্গঠন করেই ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করেছে এ গবেষণা। এভাবে গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, আমাদের পূর্বপুরুষরা কতটা বুদ্ধিমান, সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। গবেষণাটি প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ।