ঢাকা শনিবার, ৩১ মে ২০২৫, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ধারাবাহিক উপন্যাস (পর্ব-২)

তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

আলম শাইন
তুষার বনে ভিন্ন মানুষ

অলস সময় পার করতে গবেষকেরা দাবা খেলায় মনোযোগী হয়ে পড়েছে। গুটির চাল দিতে দিতে কখন যে দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে তা টের পায়নি তারা। তবে বুঝতে পেরেছে সময়টা মন্দ কাটবে না। বিশেষ করে ফোন নেটওয়ার্ক থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়লে নিরানন্দ সময়টা কাটাতে দাবা খেলার প্রয়োজন আছে। দুজন মনোযোগ দিয়ে খেলছে। সোপানের দুর্দান্ত চালে গালিব গভীর চাপে পড়ে গেছে। উত্তরণের পথ খুঁজছে গালিব। ঠিক অমনি মুহূর্তে কেবিনের ভেতরে একটা মিষ্টি মিউজিক বেজে উঠল। মনে হচ্ছে কেউ একজন বাইর থেকে ডোর বেল ছেপে ধরেছে। তারা অনুমান করছে টিকিট চেকার অথবা অ্যাটেনডেন্ট হতে পারে। সোপান উঠে দরজা খুলে দিল। তাদের অনুমানই সত্য; দরজার সামনে ইউনিফর্ম পরা একজন তরুণ টিকিট চেকার দাঁড়িয়ে আছে। চেকার রুশ ভাষায় বলল, ‘কেবিনের কাগজপত্রগুলো দেখতে এসেছি, আমাকে সাহায্য করো।’

লোকটিকে দেখেই গবেষকেরা তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। টিকিট চেকারও অনুরূপভাবে তাকাল। তিনজনের চোখাচোখিতে এক অদ্ভুত মায়ার বন্ধন তৈরি হয়ে গেল মুহূর্তেই।

সোপান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি নিশ্চয়ই উপমহাদেশের?’ টিকিট চেকার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ একদম সঠিক। বাঙালি, বাঙালি..।’ ‘ভেতরে এসো।’ গালিব বলল। আক্ষেপের সঙ্গে টিকিট চেকার জবাব দিলো, ‘রেলের রীতি অনুযায়ী অপ্রয়োজনে কারো কেবিনে প্রবেশের নিয়ম নেই।’ সোপান হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে করতে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আগে পরিচিত হই; নিয়মের কথা পরে হবে। ভেতরে এসো।’ টিকিট চেকার ইতস্তত করতেই সোপান খানিকটা উচ্চস্বরে বলল, ‘আমরা অনুমতি দিলে তো তুমি আসতেই পারো, তাতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’

আপ্লুত হয়ে টিকিট চেকার বলল, ‘তা ঠিক।’ গালিব হাসিমুখে বলল, ‘তাহলে দেরি কেন ঝটপট এসে পড়।’ কথা শেষ করেই গালিব তার হাতের কব্জি টেনে ধরে কেবিনের ভেতরে নিয়ে এলো। কেবিনে প্রবেশ করেই টিকিট চেকার দরজাটা ঠেলে দিতে দিতে বলল, ‘রেলের নিয়ম মানতে হয়। না হলে..।’ সোপান তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘আমাদের কাছে তুমি আগে বাঙালি, পরে টিকিট চেকার। যতদিন আমরা এই কেবিনে আছি, ততদিন এখানে কোনো নিয়মণ্ডকানুন নেই।’ টিকিট চেকার আবেগ তাড়িত হলো। বিদেশের মাটিতে একই ভাষায় কথা বলার অনুভূতি তাকে প্রশান্তি এনে দিলো।

কেবিনে ঢুকেই টিকিট চেকার তার দুহাত দুজনের কাঁধে রেখে নিজের পরিচয় দিতে লাগল, ‘অরিন্দম বাগচি। জন্মস্থান দক্ষিণ ২৪ পরগনা। বাপ-দাদার বাড়ি বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঠাকুরদা পরিবার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ী হয়েছিলেন।’ এটুকু বলেই সে থামল, তারপর দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলতে লাগল, মস্কো এসেছিলাম ২০১২ সালে। স্টুডেন্ট ভিসায়। পড়াশুনা শেষ করে রুশ মেয়ে বিয়ে করেছিলাম। ফলে এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের ছাড়পত্রও পেয়ে গেলাম। সে সুবাদে রেলের চাকরিটা পেতে বেশ সুবিধাও হয়েছে। তারপর থেকে পরিবার নিয়েই মস্কোতে বসবাস করছি। দুঃখজনক হচ্ছে, ভারতবর্ষে যাওয়া হয়নি অনেক বছর ধরেই। গত বছর দেশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে যাওয়া হয়নি। এই বছর যেতে না পারলেও -২২ সালের শেষের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করব।’

গালিব তার পরিচয় জানাল, ‘কালিম উল্লাহ গালিব। মুন্সীগঞ্জ, বাংলাদেশ। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে নৃ-বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েশন করেছি। তারপর ‘মস্কো সেস্ট ইউনিভার্সিটি’ থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করে এমফিল করছি। থিসিসের কাজে বৈকাল পর্বতমালায় যাচ্ছি। আমাদের প্রথম গন্তব্য বুরিয়াতিয়ার বৈকাল স্টেশনে।’ এবার সোপান পরিচিত হলো, ‘সাইফ হাসান সোপান। বরগুনা, বাংলাদেশ। নৃ-বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েশন করেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দুজন একই ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করে থিসিসের কাজে যাচ্ছি।’

অরিন্দম বাগচি বলল, ‘জেনে খুব ভালো লাগছে। আরও ভালো লাগছে আগামী চারদিন বাঙালি ভাইদের সঙ্গে একত্রে কাটাতে পারব। বিশ্বাস করো তোমাদের পেয়ে মনে হচ্ছে আমার নিজের দুই ভাইকে কাছে পেয়েছি। তোমাদের শরীরজুড়ে দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের মানচিত্রের ছায়া। শোন আজকের ডিনারটা হবে আমার কামরায়। ডিউটি আছে, এখন চললাম। খেতে খেতে বাকি কথা হবে।’ গালিব সামান্য আপত্তি জানালেও তা ধোপে টিকেনি অরিন্দম বাগচির কড়া ধমকের কাছে। সোপান অনুরোধ করল, ‘একটু কফি খেয়ে যাও। ফ্ল্যাক্সে গরম কফি আছে। একদম রেডি। ঢেলে দেবো আর তুমি গিলে ফেলবে।’ ‘ঝটপট দাও। খেয়ে বের হতে হবে এখনি। সবগুলো কেবিনের কাগজপত্র চেক করতে হবে।’

সোপান দ্রুত ফ্ল্যাক্স থেকে এককাপ কফি ঢেলে অরিন্দম বাগচির সামনে ধরল। সে হাত বাড়িয়ে কাপটা নিয়ে কয়েক চুমুকেই কফি শেষ করে ফেলল। কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ‘তাড়া আছে, যাচ্ছি। ঠিক সময়ে তোমাদের নিতে আসবে কেবিন বয়। ওর সঙ্গে ডিনারের টেবিলে চলে এসো। ডিনারে বসে আরও গল্প হবে।’ দুই. রাত ১১টা। মস্কোর অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের রানওয়ের ব্যস্ততা খানিকটা কমে এসেছে। তবে এখনও কয়েকটি বিমান যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। এরই মধ্যে একটি হচ্ছে সাইবেরিয়া এয়ারলাইন্সের ‘এস-সেভেন’। দেখতে দেখতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সেই বিমানটিও গর্জন তুলে আকাশে পাখা মেলল। গন্তব্য পৃথিবীর অন্যতম শীতল শহর সাখা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ইয়াকুটস্ক।

বিমান অবতরণের নির্ধারিত সময় ভোর ৬টা ১৭ মিনিট। টাইমজোনের পার্থক্য আর প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়ালের কারণে সেখানে সূর্যোদয় হতে হতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে যাবে। তবে কখনও সাড়ে চারটা কখনও পাঁচটায়ও সূর্যোদয় হয় ইয়াকুটস্কে। অবশ্য সেটা নির্ভর করে ঋতু চক্রের উপরে। সাইবেরিয়ার শীতের রাত শুধু সময়ের হিসেবে দীর্ঘ নয়, বেশ নির্মমও। পর্যাপ্ত সূর্যালোকের অভাব, তীব্র ঠান্ডার দাপট আর সীমিত সুযোগ-সুবিধার কারণে ওখানে জীবনযাত্রা বেশ কঠিন। শীতের রাতের দৈর্ঘ্যরে ব্যাপ্তির কারণে সৌরশক্তি কাজে লাগানোরও সুযোগ পায় না স্থানীয়রা। তবে এপ্রিল মাসের রাত ততটা দীর্ঘ নয়।

এস-সেভেনে যাত্রীর সংখ্যা খুব বেশি নেই। এপ্রিলে সাইবেরিয়ার দিকে তুলনামূলকভাবে ট্যুরিস্টদের যাতায়াতও কম থাকে। ঠান্ডার প্রকোপ আরও কমে গেলে তখন ট্যুরিস্টদের যাতায়াত বেড়ে যাবে। শুধুমাত্র হিম ঠান্ডায় অতি প্রয়োজনে বিজনেস সংক্রান্ত কাজে যাত্রীরা মস্কো-সাইবেরিয়া যাতায়াত করে থাকেন। আজ বিমানে স্থানীয় যাত্রীর সংখ্যা অনেকটাই কম। আজকের যাত্রীদের মধ্যে রয়েছে শ্রীলঙ্কার দুই প্রবাসী, যারা রত্নপাথরের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাদের একজন নিকোলাস ডি সিলভা, অন্যজন উপাল সেনানায়েকে। দুজন ভিন্ন ধর্মের অনুসারী। একজন খ্রিস্টান, অন্যজন বৌদ্ধ। দুজন প্রায় সমবয়সী; ৩৪-৩৫ বছর বয়স। জন্ম শ্রীলঙ্কার ‘সাবারাগামুওয়া’ প্রদেশের ভিন্ন ভিন্ন জেলায়। যদিও শৈশব বা কৈশোরে তাদের মধ্যে পরিচয় ছিল না, পরে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে একে অন্যের সঙ্গে আন্তরিক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। চলবে...

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত