জাগরণের অগ্নিবীণা বাজিয়ে যিনি আত্মভোলা, অসচেতন ও অলস জাতিকে তারুণ্যের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হতে বলেছেন, মুক্ত প্রাণ ধর্মের তারুণ্যকে জয়যুক্ত করার জন্য যিনি অমর যৌবনের আগ্নেয় দুর্দান্তকে দোড়রা মেরে সচেতন করে তুলেছেন তিনি হলেন মহাবিশ্বের এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, মহাবিদ্রোহের রণতুর্যবাদক বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর লাঞ্চনা শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর কোলে জন্ম নেয়া এক শ্রেষ্ঠ উপহার। নজরুলের জীবন গতানুগতিক সাধারণ মানুষের মতো ছিল না। কবিতার মতোই তাঁর জীবন ছিল ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম, দুর্নিবার, দুর্বিনীত। বাঁধা বন্ধনহীন হয়ে তিনি ছুটে বেড়াতেন বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। সকল লোকই ছিল তার আপন, সব বাড়িই ছিল তার নিজের বাড়ি। শ্রীকৃষ্ণের মতো, তিনি যখন যার তখন তার।
বাধঁনহারা জীবনের সমস্ত পাওয়া না পাওয়ার বেদনাই তাঁর সৃষ্টিকে বৈচিত্র্যে ভরে তুলেছিল। তৈল মাখা ক্ষুদ্র তনু ও নিদ্রারসে ভরা কোমলকান্ত নিস্তেজ ম্লান জীবনে নতুন উদ্দীপনা ও উৎসাহের সঞ্চার করে তিনি মানুষকে মুক্তজীবনের ডাক শুনিয়েছিলেন।
নজরুল-প্রতিভার একটি বিশিষ্ট পরিচয় বহন করত তার চেহারা। যৌবনে নজরুলের গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। চেহারায় ছিল আর্যের লক্ষণ। বড় বড় টানা কালো চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষè নাসিকা, উদ্দাম হাসি, বলিষ্ঠ সুগঠিত দেহ। বিদ্রোহীর মতোই উৎসাহে উজ্জ্বল চোখ। চোখ দুটি যেন পেয়ালা। হাঁটার সময় তার মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো নাচত। তার লেখা বিদ্রোহীভাবাত্মক গান ও কবিতাগুলো যেন মূর্ত হয়ে উঠত বলিষ্ঠ সুগঠিত দেহে। নজরুল বিশ্বলয়ের বিরাট শিশু হয়ে খেলেছেন শব্দ নিয়ে। আরবি-ফারসি- উর্দু-হিন্দি- লোকজ-ততসমণ্ডসংস্কৃত-গুরুগম্ভীর-হালকাণ্ডদেশি-বিদেশি শব্দের বিপুল ভাণ্ডার হৃদয়ে ধারন করে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন শব্দের জাগলার। শব্দের সমুদ্রে দেবতাদের মতো সমুদ্রমন্থন করে তুলে এনেছেন এক অমূল্য অমৃত ভাণ্ডার। নজরুলের কাব্য ও সংগীতে শব্দই হলো প্রধান মূলধন। জীবনের সহস্র অনুভূতির অজস্র স্পর্শে তার কথা হয়ে উঠে নান্দনিক রূপকথা। ১৯২৯ সালে কবির অতি আদরের পুত্র বুলবুল মাত্র চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাকে হারানোর পর গানই হয়ে উঠে নজরুলের প্রধান শক্তি। তিনি গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯২৯ সালের ২৯ সালের ডিসেম্বর সংগীতের প্রধান প্রশিক্ষক পদে উন্নীত হন। কাব্যজগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি ডুবে যান সংগীতের জগতে। শুরু করেন সংগীতবিষয়ক ব্যাপক চর্চা ও সাধন। পাঠ করেন ফেলেন নবাব আলির লেখা সংগীতবিষয়ক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ফারসি ‘মারিফুন্নাগমাত’। নিজ দক্ষতায় তিনি হয়ে উঠেন সমকালীন সংগীত ভাবনার অন্যতম প্রধান পুরুষ। অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল বা রজনীকান্ত সেন ছিলেন সমকালীন সফল গীতিকার ও সুরস্রষ্টা। কিন্তু নজরুল শুধু সংগীতের রূপকারই ছিলেন না,তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত সঙ্গীত গবেষক ও আবিষ্কারক। রাগ-রাগিণীর মেলবন্ধনে নজরুল গড়ে তুলেন বাংলা গানে বৈচিত্র্যকে এক অনন্য ভাণ্ডার। তাঁর সংগীতবিষয়ক জ্ঞান বাঙালির গানের দিগন্তকে বিস্তৃত করেছে। তাঁর ধ্রুপদি-রাগিনি আশ্রিত গান বাংলা গানকে করে তুলেছে সঙ্গীতের এক মহাসমুদ্র।
নজরুলের সংগীত ভাবনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তার সঙ্গীতে অসংখ্য রাগ-বাগিণী, তাল ও ছন্দের অন্তহীন বৈচিত্র্য। মাত্র এক দশকের মধ্যে তিনি প্রেমের গান ও স্বদেশ তথা আন্তর্জাতিক ভাবনাবিষয়ক গানের পাশাপাশি বিরহের গান, হাসির গান, মার্চিং সং বা সমরসঙ্গীত, ইসলামি গান, শ্যামাসঙ্গীত, ভজন, সজল, তুরি, কাওয়ালি, কীর্তন, ডুয়েট গান, প্যারোডি গানসহ অন্যান্য শত শত গান রচনা করে গিয়েছেন। নজরুল হিন্দি এবং উর্দুতেও অনেক সার্থক সংগীত রচনা করেন। ম্যাডান থিয়েটারসহ গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য নজরুল অসংখ্য গান রচনা করেন। তার পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয়েছিল থালা ভরা পান আর অর্থের দিক দিয়ে শূন্যের পর মহাশূন্য। তাইতো অসুস্থ থাকার সময় ম্যাডান, গ্রামোফান কারো টিকিও দেখা যায়নি। ১৯৩১ সালে সিনেমা জগতের সঙ্গে নজরুল যোগাযোগ শুরু করেন। সবাক যুগের প্রথম থেকেই তিনি বাংলা সিনেমায় কাজ করা শুরু করেন। তখন কলকাতায় ম্যাডান ফ্রামজি নামক এক ফরাসি ভদ্রলোক সিনেমার ব্যবসা শুরু করেন। তার কোম্পানির নাম ছিল পাইওনিয়ার কোম্পানি। এই কোম্পানিতেই কবি সুরভান্ডারী পদে প্রথম নিযুক্ত হন। সুরভান্ডারীর সুরসেনা হয়ে কবি নজরুল হয়ে উঠেন বাংলা গানের ধ্রুবতারা। নজরুল ছিলেন চিরদিনই সেরা। রাজনীতি, সভাসমিতি, খেলার মাঠে, রঙ্গরসে, ব্যঙ্গদ্রুপে সবখানেই তিনি ছিলেন সেরার সেরা। তাঁর ভেতরে ছিল জাত নেতৃত্ব। তিনি যখন দুষ্টুমি করতেন ছিলেন দুষ্টু দলের সর্দার। মসজিদে কাজ করার সময় হয়েছিলেন সেখানকার ইমাম। লেটোদলে তাকে দেওয়া হয় ওস্তাদের আসন। সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন হাবিলদার। আর কবিতা লিখতে গিয়ে তিনি হয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি। সমাজের বৈষম্য, অনাচার ও ব্রিটিশদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম একক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সমাজের সর্বস্তরে ন্যায় ও সাম্য বিধান করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। হিন্দু পুরাণের মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত, বশিষ্ট প্রমুখ মুনি ঋষিদের মিলিত সত্তায় সৃষ্ট সপ্তর্ষি মণ্ডলের মহাশক্তি, মহাজ্ঞানী, মহাঋষি ছিলেন নজরুল। বাংলার ভাগ্যাকাশের এক অতি দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে ‘বিনাশায় দুষ্কৃতম’ বিদ্রোহী কবি নজরুলের আবির্ভাবের প্রয়োজন ছিল; আর সেই জন্যই তিনি এসেছিলেন। বাংলার যুবশক্তিকে উজ্জীবিত করে, মূঢ় ম্লান দেশবাসীর মুখে ভাষা দিয়ে কবি নজরুল আবার চিরনিস্তব্ধ হয়ে যান।