সপ্তম শতাব্দীতে কারবালার হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড, পনের শতকের গ্রানাডা ট্রাজেডি এবং আঠার শতকের পলাশীর বিয়োগান্তক ঘটনা মুসলিম জাতির বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণে মুসলিম জাতির উপর যে বিপর্যয় নেমে আসে তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কুফল আজও ভোগ করতে হচ্ছে মুসলমানদের। তিনটি ঘটনার কারণেই মুসলিম বিশ্বের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। কারবালার মুসিলম বাহিনীর পরাজয়ের পর ওমর বিন আব্দুল আজিজ এবং পরবর্তীতে গাজী সালাহ উদ্দিন আয্যূবীর দক্ষ নেতৃত্বে পতনোন্মুখ মুসলমানরা সগৌরবে শির উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। কিন্তু স্পেনের ও ভারতীয় উপমহাদেশের দুর্দশার পর আজও মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারেনি এ জাতি। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে এ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ভিন্নরূপ হতে পারে। এগুলোর মধ্যে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে নবী (সা.) দৌহিত্র ইমাম হুসাইনসহ (রা.) আহালে বাইতের ৭২ জন সদস্যের মর্মান্তিক শাহাদৎবরণ, স্পেনের গ্রানাডাই খ্রিষ্টান বাহিনী কর্তৃক মুসলমানদের উপর পৈশাচিক হত্যাকান্ড এবং পলাশীর প্রহসনে লর্ড ক্লাইভ ও জগৎ শেঠ মাড়োয়ারীদের চক্রান্তে নবাব সিরাজউদ্দৌলার মর্মান্তিক পরাজয়ে ও পরবর্তীতে নিহত হওয়া কোনো বিছিন্ন ঘটনা নয়। সমস্ত ঘটনার পেছনে মুসলমানদের চির শত্রু ইহুদী জাতির ও মুসলমান নামধারী মুনাফিক চক্রের হীন ষড়যন্ত্র কাজ করেছে।
হিজরী বর্ষ বা আরবী সনের প্রথম মাস মুহররম। এই মুহররম মাসের দশম দিবসটি আশুরা নামে পরিচিত। আশুরা একটি ফজিলতপূর্ণ, মহিমান্বিত দিবস। শুধুমাত্র ইসলামের ইতিহাসেই নয় সমগ্র মানবজাতির ইতিহাসেও ১০ই মুহররম তারিখে পবিত্র আশুরা অনন্যসাধারণ ফজিলতপূর্ণ দিবসরূপে পরিচিহ্নিত হয়ে আসছে। এই আশুরার দিনে বিশ্বের বহু ঐতিহাসিক ও অলৌকিক ঘটনাবলি সংঘঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তিনটি প্রধান সম্প্রদায় (মুসলিম, ইহুদী ও খ্রিষ্টান) যথাযথ মর্যাদায় ও ঐকান্তিকতায় দিবসটি প্রতিপালন করে থাকে। ১০ই মুহররম তারিখ কারবালার ঐতিহাসিক ঘটনা আশুরাকে বহুমাত্রিকতায় রূপ দিয়েছে।
হাদীস শরীফের বর্ণনামতে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হুজুর (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে চলে যান, তখন দেখতে পান মদিনার আহালে কিতাব ইহুদীরা এই দিবসটিতে রোজা রাখছে এবং দিবসটিকে তারা বিশেষ মর্যাদায় পালন করছে। নবীজী (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, এই দিনে তোমরা কি জন্য রোজা রাখছো? তারা বলল, এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন। আল্লাহ তায়ালা এ দিনে হযরত মুসা (আ.) ও তার কওমকে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ দরিয়ায় নিমজ্জিত করেছিলেন। এরপর হযরত মূসা (আ.) এ দিনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোজা রাখতেন। তাই আমরাও রোজা রাখি। নবীজী (সা.) এক কথা শুনে বললেন- হযরত মুসা (আ.) এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। এরপর নবীজী (সা.) নিজেও রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখতে বললেন। (সহীহ মুসলীম, হাদীস নং-১১৩০)
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন- আশুরার রোজা রাখছিলেন এবং অন্যদের রাখতে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ এই দিনকে তো ইহুদী নাসারা খ্রিষ্টানরা সম্মান করে রোজা রাখে। তখন নবীজী (সা.) বললেন, আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও রোজা রাখবো। ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় হুজুর (সা.) সাহাবা কেরামদের উপদেশ দিলেন- তোমরা নবম ও দশম মুহররমে রোজা রাখো এবং ইহুদীদের খিলাফ কর। (ওয়া খালেফুল ইয়াহুদা) (জামে তিরমিজি, হাদীস ৭৫৪)। এখানে একটি বিষয় আমাদের মনোজগতকে আন্দোলিত করে, তা হলো ইসলামী শরিয়তে বৈধ এবং ফজিলতপূর্ণ ইবাদতের ক্ষেত্রে যদি ইহুদীদের বিরোধীতার কথা আসে তাহলে ইহুদী-নাসারাদের নিজস্ব সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি এবং বিজাতীয় কালচারের ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করার বিধান কতটা কঠোর হতে পারে! হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি একদা রাসূলুল্লাহ (সা.) দরবারে হালকা হলুদ রং মিশ্রিত জামা পরে উপস্থিত হয়েছিলেন। আল্লাহর নবী (সা.) তাকে বলেছিলেন এটি কাফেরদের পোশাক; পরিধান করো না। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেছিলেন- আমি কাপড়টি ধুয়ে রং মুছে ফেলি। আল্লাহর নবী (সা.) বলেছিলেন, না, কাপড়টি পুড়িয়ে ফেল। এ হাদিস থেকে অনুমান করা যায় বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি আল্লাহর নবীর (সা.) ঘৃণা কতটা তীব্র ছিল! মুসরিকদের ব্যাপারে আল্লাহ বলেন- আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ কর সমবেত ভাবে। যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেত ভাবে। মনে রেখ আল্লাহ মুত্তাকীনদের সঙ্গে রয়েছেন। (সূরা আত তওবা, আয়াত-৩৬) রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সর্ম্পক নেই যারা মুখ চাপড়ায়, কাপড় ছেড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে।
এখন প্রশ্ন থেকে যায়, কোরআন কাফেরদের সঙ্গে আন্তরিক বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার সর্ম্পক স্থাপন এত কঠোরভাবে নিষেধ করে কেন? কোনো অবস্থাতেই এরূপ সম্পর্ক বৈধ না হওয়ার রহস্যটা কী? এর একটি বিশেষ কারণ এই যে, জগতের বুকে মানুষের অস্তিত্ব সাধারণ জীব-জানোয়ার অথবা জঙ্গলের বৃক্ষ ও লতাপাতার মতো নয় যে, জন্মলাভ করবে, বড় হবে ব্যাস মরে পঁচে নিঃশেষ হয়ে যাবে। বরং ইসলাম মনে করে যে, মানুষের জীবনের একটি লক্ষ্য স্থল আছে, একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে। মানুষের খাওয়া-পরা, উঠা-বসা, নিদ্রা-জাগরণ এমনকি জন্মণ্ডমৃত্যু সবটি একটি উদ্দেশ্যের চারপাশে অবিরত ঘুরছে। এসব কাজকর্ম যতক্ষণ সে উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে ততক্ষণ তা নির্ভূল ও শুদ্ধ; পক্ষান্তরে উদ্দেশ্যের বিপরীত হয়ে গেলেই তা অশুদ্ধ। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের আনুগত্য ও এবাদতই যখন মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য তখন জগতের কাজ-কারবার, রাজ্যশাসন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক সম্পর্ক সবই এই লক্ষ্যের অধীন। অতএব যে মানব এ লক্ষ্যের বিরোধী সে মানবতার প্রধান শত্রু। সুনানে আবু দাউদে এ বিষয়টি এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে- ‘মান আহাব্বা লিল্লাহী ওয়া আবগাদা লিল্লাহী ওয়া আতা লিল্লাহী ওয়া মানাআ লিল্লাহী ফাক্কদ ইসতেকমালাল ঈমান।’ অর্থাৎ যে ব্যাক্তি স্বীয় বন্ধুত্ব ও শত্রুতাকে আল্লাহর ইচ্ছার অধীন করে দেয় এবং দান করে এবং দান থেকে বিরত থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সে তার ঈমানকে পূর্ণতা দান করে।
ইহুদীরা হলো বিশ্বের সবচেয়ে অভিশপ্ত জাতি। চরিত্রগত ভাবে ও জিনগতভাবে মুসলিম বিদ্বেষী। আল্লাহ যাদেরকে ইসলামের দুশমন বলে অভিহিত করেছেন। ইসলাম ধর্মের শুরু থেকেই এই ইহুদীরাই রাসূল (সা.) কে গোপনে প্রকাশ্যে হত্যার চেষ্টা করেছে বহুবার। খেলাফায়ে রাশিদার তিনজন জলিল কদর সাহাবীকে চক্রান্তের ফাঁদে ফেলে নির্মমভাবে শহীদ করে এই ইহুদী প্রেতাত্মারা।
মুসলমানেরা যে ঈমানী চেতনা নিয়ে আরব থেকে বের হয়ে এশিয়া ভূমধ্য সাগর থেকে সূদূর স্পেনে ইসলামের বিজয় পতাকা তুলেছিল, যে মুসলমানদের ঈমানী শক্তির সামনে রোম ও পারস্য সামজ্য পদানত হয়েছিল, সেই মুসলমান জাতি আজ সকল শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে ইহুদী-নাসারাদের গোলামে পরিণত হয়েছে। হাদিস শরীফে মুসলমানদের পতন ও বর্তমান দুরাবস্থার কারণ বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে- সেই দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন পৃথিবীর অন্যান্য জাতি তোমাদের ধরা পৃষ্ঠ হতে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মানসে পরস্পরকে আহব্বান জানিয়ে একত্রিত হবে। যেভাবে ভোজনবিলাসীরা সুস্বাদু খাবার ভক্ষণের জন্য একে অপরকে আহব্বান করে। সাহাবা কেরামগণ জিজ্ঞাসা করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! সেদিন কী আমাদের সংখ্যাল্পতার কারণে এরূপ দুর্দশা দেখা দেবে? তিনি বললেন না, বরং তোমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে কিন্তু তোমরা বন্যার স্রোতে ভাসমান শুষ্ক তৃণখণ্ডের ন্যায় হবে। তোমাদের শত্রুদের অন্তরে তোমাদের সম্পর্কে যে ভীতি ও ত্রাস বিরাজমান সেদিন আল্লাহ তায়ালা তা দূর করে দেবেন এবং তোমাদের মধ্যে অহং এর সৃষ্টি করে দেবেন। সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন- হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! অহং কিভাবে প্রকাশ পাবে? তিনি বললেন- ‘দুনিয়ার প্রতি লোভ লালসা ও মৃত্যুকে অপছন্দ করা থেকে’ মুসলমানরা যতদিন ঈমানের দাবিতে শতভাগ খাঁটি নির্ভেজাল ছিল ততদিন শত্রুর অন্তরে তাদের সম্পর্কে ভীতি ত্রাস বিদ্যামান ছিল। ইয়ারমুকের যুদ্ধে খ্রিষ্টান সৈন্য দু’লাখ চল্লিশ হাজার আর মুসলমান মুজাহিদ ছিলেন মাত্র আটচল্লিশ হাজার। এই অসম যুদ্ধে এক লাখ খ্রিষ্টান সৈন্য মুসলিম মুজাহিদের হাতে মৃত্যুবরণ করে এবং মুসলমানদের ভয় ও ত্রাস তাদের অন্তরে এতো প্রবলভাবে জমাট বাঁধে যে রাতের বেলায় যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে গিয়ে বহু সৈন্য পরিখায় পড়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ খ্রিষ্টান সৈন্যদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন- মদ যেমন তোমাদের নিকট প্রিয় যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যু আমাদের নিকট ততোধিক প্রিয়। সূরা ফাতেহার মাধ্যমে প্রতি নামাযে আমরা আল্লাহর শিখানো কালাম দ্বারা এভাবে দোয়া করি ‘গাইরিল মাগদুবী আলাইহিম ওলাদ দোয়াল্লিন’ ঐ সব লোকের পথে নয় যাদের প্রতি গযব নাজিল হয়েছে এবং তাদের পথেও নয় যারা পথ হারা। এ কথা দ্বারা যে জাতির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তারা হলো ইহুদী জাতি। এদের থেকে আমরা প্রতি নামাযের প্রতি রাকাতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই কেন? কারণ তারাই সেই জাতি যারা সত্য জানার পরও হঠকারিতা ও বিদ্বেষবশত তা গ্রহণ করেনি। আল্লাহ তায়ালার কুদরত, নিয়ামত ও আযাব-গজব সরাসরি প্রত্যক্ষ করার পরও যারা সবক নেয়নি বরং কুফর, শিরক, অন্যায়, অত্যাচারের সব সীমা অতিক্রম করেছে। বহু নবী রসূলকে হত্যা করেছে। তাদের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যই হলো- সত্য গোপন করা, নবী রাসূলদের বিরুদ্ধাচারণ করা, বিদ্বেষ পোষণ করা, ইসলামের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা, ওয়াদা ও চুক্তি ভঙ্গ করা, বিশ্বাসঘাতকতা, খেয়ানত, খুন-খারাবি, পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি, যুদ্ধ বিগ্রহ জিইয়ে রাখা, অন্যায় ভাবে মানুষের সম্পদ ও ভূমি গ্রাস করা, মুসলমানদের সঙ্গে মুসলমানদের দন্দ্ব বিবাদ, শত্রুতা সৃষ্টি করা। তাই আল্লাহর নবী (সা.) তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করার জন্য মুসলিম উম্মাহকে বারবার সর্তক করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশগুলো থেকে ইউরোপীয়রা পশ্চাদপসারণের পর বিভিন্ন দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী শাসন ক্ষমতা চলে যায় পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতি ও চিন্তা ধারায় বিকশিত আমলা অথবা তথাকথিত রাজবংশের হাতে। এসব শাসকরা ইউরোপীয় স্টাইলে জাতীয়তাবাদ, সেকুলার মতবাদ ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করে যা মুসলিম বিশ্বের জন্য কোনো কল্যাণ তো বয়ে আনেনি বরং ইসলামের মূল স্পিরিট থেকে তাদেরকে দূরে সরিয়ে দেয়। ইউরোপীয় ইহুদী ও খ্রিষ্টীয় পন্ডিতরা তুর্কী ও আরব জাতীয়তাবাদের উপর পৃথক গ্রন্থ রচনা করে তরুন তুর্কী ও আরবদের এই ধোকা দিল যে, তোমরা হলে অভিজাত আরব তুর্কীদের সঙ্গে তোমাদের থাকা উচিত নয়। আর তুর্কীদের বলল, তোমরা তো খান্দানি তুর্কী তোমরা কেন আরবী ভাষা রেখছো? এইভাবে তাদের মাঝে বিদ্বেষের বীজ বপন করে তুর্কী খেলাফতকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ইহুদীরা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- দীর্ঘকাল ধরে আরব ও তুর্কী শাসকরা পারস্পরিক সমমর্মিতার ভিত্তিতে মুসলিম খেলাফতের দায়িত্ব পালন করত। তুর্কী খলিফার দরবারে আরব আলেম পণ্ডিতদের প্রধান্য ছিল। তাদের ভিতর কোনো বর্ণবিদ্বেষ বা জাতীয়তাবাদের চেতনা মাথা চড়া দিয়ে ওঠেনি। জায়োনিস্ট ইহুদী খ্রিষ্টান বুদ্ধিজীবীরা কুটকৌশলে তাদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দিয়ে মুসলিম ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে দিনে দিনে মুসলিম সমাজ আদর্শিক ভাবে আর নিষ্ঠাবান থাকতে না পারায় তাদের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তারা নানান ফিরকা দল-উপদল গোষ্ঠী-আরব বনাম তুর্কী, তুর্কী বনাম পারসিক, শিয়া বনাম সুন্নী ইত্যাদিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ হিসেবে আরব বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বৃটেনের ফর্মুলায় মার্কিন মদদে ১৯৪৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে আমেরিকার মিডিল ইস্টের ‘গ্যারিসন সিটি’ বলে খ্যাত ‘ইসরাইল’ নামক ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় খ্রিষ্ট সমাজ নব নব আবিস্কারে ধর্মের অর্থাৎ গির্জার বাধার মুখে ধর্মের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে ধর্মকে সরিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ফলে ইউরোপের দেশে দেশে প্রতিষ্ঠা পায় সেকুলারিজম। আর সেকুলারিজমের আলোকে গড়ে তোলা হয় ধর্মহীন এক সমাজ। উপনিবেশের মাধ্যমে দুনিয়ার দেশে দেশে এ মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যার উত্তরাধিকার এখনও আমাদের বহন করতে হচ্ছে।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ অঞ্চলের মানুষের মন-মগজ পড়তে পারতো বিধায় তারা মাত্র ৩০০০ বৃটিশ প্রায় ২৫০ মিলিয়ন লোককে শাসন করে গেছে। তারা নৃবিজ্ঞান গবেষণায় জোর দিত। তারা বুঝতে পারে আগের মতো এখন দেশ দখল করা কঠিন। এখন সংস্কৃতি তথা মূল্যবোধকে কন্ট্রোলে নিতে হবে। এর ফলে তথাকথিত গণতন্ত্র সিস্টেমের কথা বলে তারা তাদের পছন্দের লোককে ক্ষমতায় বসায়। তারা ফান্ডিং করে স্বার্থ কী? ফান্ডিংয়ের অন্তরালে তারা তাদের ভ্যালু সিস্টেম বা মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করাই হল মূল লক্ষ্য। মুসলমানরা নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মেটাবে? না, এই সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রের সুদূরপ্রসারী মতলব বুঝবে? আত্মবিসৃত মুসলিম জাতির মনস্তাত্বিক ও বুদ্ধিভিত্তিক পরাজয়ের একটি সংক্ষিপ্ত ন্যারেটিভ এখানে তুলে ধরা হল যাতে চেতনার এন্টিনা একটু উদ্দিপ্ত হয়। আশুরার ফযিলত শুধু নফল ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আশুরা একটি সংস্কৃতি, একটি মূল্যবোধের চেতনা। নবী (স.) আশুরার নফর রোজা রাখার ক্ষেত্রে ইহুদীদের বিরোধিতা করতে বলেছেন অথচ জীবন-জগত, সমাজ-সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি সর্বত্রই ইহুদীদের জয়-জয়কার। তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মুসলমান শাসকরাই মদদ জোগাচ্ছে বেশি। চাল-চলন, কৃষ্টিকালচার, বেশভূষা, চেহারা-সুরত দেখে বুঝার উপায় নেই কে মুসলমান আর কে ইহুদী? কী হবে আশুরার এই নফল রোজায় যদি না জীবনাচার থেকে বিজাতীয় সংস্কৃতি বয়কট করা গেল! মানুষ যেমন ভেজাল জিনিস পছন্দ করে না মহান পবিত্র আল্লাহপাক তেমনি ভেজাল মানুষ পছন্দ করেন না। আমরা মুসলমান। আমাদের একটা স্বতন্ত্র আইডেনটিটি আছে। আমরা যাকে পানি বলি ওরা (মুশরিকরা) তাকে বলে জল। আমরা পাগড়ি পরি মাথার টুপির উপর, ওরা পাগড়ি পরে খালি মাথার উপর। আমরা বাংলাদেশি মুসলমানেরা বাংলা ভাষায় কথা বলি আর ওরা বাংলাদেশি হিন্দুরাও বাংলা ভাষায় কথা বলে (যদিও একটি মুসলমানী বাংলা এবং অপরটি হিন্দুয়ানী বাংলা)। ভাষা আমাদেরকে একসূত্রে গাথলেও সংস্কৃতি আমাদেরকে পৃথক করেছে। এই পার্থক্যটুকু আমরা অনেক সময় গুলিয়ে ফেলি। যারা বলে ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ তারা হতে পারে ধর্মনিরপেক্ষবাদী মডারেট (উদার) মুসলিম। বিশুদ্ধ মুসলিম বলা যাবে কী? সারা বিশ্বের মুসলমানদের প্লাটফর্ম একটি। ভৌগলিক অবস্থান ভেদে জাতীয়তা আলাদা হয়না। মুসলমানদের জাতীয়তা একটাই, তা হল ইসলাম। এখানেই নিহিত আশুরার মোরাল ভ্যালু।
পাকিস্তানের জাতীয় কবি আল্লামা ইকবাল (রহ.) পতন্মুখ মুসলমানদের দুরাবস্থা দেখে কবিতা রচনা করেছিলেন-
শোর হ্যায় হো গায়ে দুনিয়া সে মুসলমাঁ না-বুদ
হামণ্ডইয়ে কেহতে হ্যায় কে থে ভি কহি মুসলিম মওজুদ?
ওয়াযে মে তুম হো নাসারা, তো তামাদ্দুন মে হানুদ
ইয়ে মুসলমাঁ হ্যায়! জিনহে দে’খ কে শরমায়ে ইয়াহুদ
ইউ তো সাইয়্যেদ ভি হো, মির্যা ভি হো, আফগান ভি হো
তুম সবহি কুছ হো, বাতাউ তো মুসলমান ভি হো?
বাংলা তরজমা-
‘চারিদিকে শুধু চিৎকার ধ্বনী গেল-গেল বিশ্বের মুসলিম গেল
আমি তখন বলি প্রকৃতই আছে কি কোন মুসলিম এ বিশ্ব ধরায়?
চাল চলনে খ্রীষ্টান: সংস্কৃতিতে হিন্দু
এইতো তোমরা মুসলমান যাদের দেখে ইহুদীরা পর্যন্ত মাথা নোয়ায় লজ্জায়।
হতে পার তুমি সাইয়েদ মির্জা আফগান
হয়েছো তোমরা সব কিছু
তবুও বল দেখি হয়েছো কি তোমরা মুসলমান।
যুগের প্রেক্ষাপটে কবিতাটির মর্মার্থ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ভুলে গেলে চলবে না- আমরা কোনো সিঁদুর সংস্কৃতির পূজা করি না; আমরা লা-শারীক এক আল্লাহর গোলামী করি, যিনি বদর, হুনায়ন, কাদসিয়ার রণক্ষেত্রে বিপদের সময় মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন, যিনি আফগানিস্থানের মাটি থেকে আমেরিকাকে নাকে খর দিয়ে বিদায় করেছিলেন, তিনি চাইলে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে ‘ইসরায়েল’ রাষ্ট্রের চিহ্ন মুছে দিতে পারেন। তবে শর্ত হল- আল-কুরআনের বাণী- ‘আর তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখিত হয়ো না আর তোমরাই হবে বিজয়ী যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সূরা আল-ইমরান, আয়াত-৩৯)
এখানে মহান আল্লাহ মুসলমানদের শক্তির প্রকৃত উৎস এবং তাদের সফলতার মূল ভিত্তি কোথায় তা পরিস্কার করে দিয়েছেন। আশুরার প্রকৃত শিক্ষা ও দীক্ষা মুসলমানদের মন, মনন, মস্তিস্কে নব চেতনার উন্মেষ ঘটাক; বিপর্যস্ত মুসলিম উম্মাহ আবার জেগে উঠুক এই প্রত্যাশা নিয়ে প্রবন্ধটির ইতি টানলাম।
লেখক : উপ-পরিচালক(অব.), ইসলামিক ফাউন্ডেশন