ঢাকা শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫, ২৭ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

দেশে দেশে স্বৈরশাসন ও গণবিপ্লব

গণআন্দোলনের মুখে গেল কয়েক দশকে দেশ ছেড়েছেন বহু স্বৈরশাসক। কেউ কেউ ফিরতে পারেননি সক্রিয় রাজনীতিতে; কারো আবার শেষ পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। দেশে দেশে এমন স্বৈরশাসন ও গণঅভ্যুত্থান নিয়ে লিখেছেন - মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
দেশে দেশে স্বৈরশাসন ও গণবিপ্লব

স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাসে বড় স্থানজুড়ে আছে জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলারের নাম। পৃথিবীবাসী যার কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দায় নিয়ে রুগ্ন হয়ে পড়া জার্মানিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসালেও হিটলারের উচ্চাভিলাস ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বার্লিনের অন্ধকার বাংকারে আশ্রয় নেন হিটলার। এরপর আর কখনোই তাকে কেউ দেখেনি। ধারণা করা হয়, আত্মহত্যা করেছিলেন তিনি। হিটলারের দোসর ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবে বিক্ষুব্ধ জনতার আন্দোলনে পতন ঘটে স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলবির। মিশরে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন তিনি। পরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানে ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করলেও নানা কর্মকাণ্ডে সমালোচিত হন পারভেজ মোশাররফ। পরিণত হন স্বৈরশাসকে। ২০০৮ সালে গণরোষে পার্লামেন্টে অভিশংসনের পর যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নেন তিনি। এরপর নানা চেষ্টার পরও ফিরতে পারেননি রাজনীতিতে। দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে মারা যান পারভেজ।

২০১০ সালের ডিসেম্বরে তিউনিসিয়ায় পুলিশের অত্যাচারে নিজ গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন মুহাম্মদ বৌয়াজিজি। যার প্রতিবাদে সরব হয় গোটা দেশ। শুরু হয় জেসমিন বিপ্লব। ধীরে ধীরে ক্ষমতা আলগা হতে থাকে তিউনিশিয়ার স্বৈরশাসক জাইন আল-আবিদিন বা বেন আলির। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দেশ ছেড়ে পালান তিনি। অবসান হয় ২৩ বছরের শাসনের। এ বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। মিশরে পতন ঘটে স্বৈরশাসক হুসাইন মোবারকের। শেষ হয় তিন দশকের স্বৈরশাসনের। লিবিয়ায় অবসান হয় গাদ্দাফির ৪২ বছরের স্বৈরতন্ত্রের। ইয়েমেনে ক্ষমতা হারান ২২ বছর ধরে গদি আকড়ে থাকা আলি আবদুল্লাহ সালেহ। ২০১৪ সালে মার্কিন মদদে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন আশরাফ গনি। তার স্বৈরশাসনে ত্যক্ত-বিরক্ত ছিলেন আফগানবাসী। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানদের ভয়ে ওমানে পালিয়ে যান তিনি। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় গণআন্দোলনের মুখে পালিয়ে যান দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। তার প্যালেসের দখল নেয় ছাত্র-জনতা। পরে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে এ আন্দোলন পুরোপুরি সফল না হলেও আগের মতো আর দোর্দণ্ড প্রতাপ নেই রাজাপাকসে পরিবারের।

গণবিপ্লব ও জোয়ার দেশে দেশে : স্বৈরশাসন, গণহত্যা ও অন্যায়ের প্রতিবাদে সময়ে-অসময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা আন্দোলন, গণজোয়ার ও গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ১৭৮৯-১৭৯৯ সালে ফরাসি বিপ্লব ছিল গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম উদাহরণ। যা ফ্রান্সের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়। এ বিপ্লবের পেছনে ছিল খাদ্য সংকট, আর্থিক দুরাবস্থা এবং রাজকীয় শাসনের প্রতি অসন্তোষ। বিপ্লবটি জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনার জন্ম দেয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে গণআন্দোলনের প্রেরণা জোগায়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে একটি সফল গণঅভ্যুত্থান। যা রাশিয়ায় জার শাসনের অবসান ঘটায়। কমিউনিস্ট সরকারের উত্থান ঘটায়। যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, খাদ্যের অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা এ বিপ্লবের কারণ হিসেবে কাজ করে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম হয়। যা পরবর্তী বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামি বিপ্লব ছিল গণঅভ্যুত্থান। যা দেশের রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে। একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এ বিপ্লবের পেছনে ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় অসন্তোষ। ইরানের জনগণ শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে একটি নতুন শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়া ১৯৮৬ সালে ফিলিপাইনের ‘পিপল পাওয়ার’ বিপ্লব ছিল এক শান্তিপূর্ণ গণঅভ্যুত্থান। যা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্দ মার্কোসকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়। নির্বাচনে কারচুপি এবং সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ বিপ্লবটি সফলভাবে নতুন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৮৯ সালে ভেলভেট বিপ্লব ছিল চেকোস্লোভাকিয়ায় এক শান্তিপূর্ণ গণঅভ্যুত্থান। যা কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায়। গণতন্ত্রের উত্থান ঘটায়। এ বিপ্লবের ফলে চেকোস্লোভাকিয়া দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়- চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া।

১৯৯৮ সালে ভেনিজুয়েলার বলিভারিয়ান বিপ্লব ছিল হুগো শ্যাভেজের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের আন্দোলন। যা দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও সামাজিকব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। এ ছাড়া ২০০৩ সালে জর্জিয়ার গোলাপি বিপ্লব, ২০০৪ সালে ইউক্রেনের অরেঞ্জ বিপ্লব, ২০০৫ সালে লেবাননের সিডার বিপ্লব, ২০০৫ সালে কুয়েতের নীল বিপ্লব, ২০০৫ সালে ইরাকের পারপেল বিপ্লব, ২০০৫ সালে কিরগিজস্তানের টিউলিপ বিপ্লব, ২০১৯ সালে হংকংয়ের বিক্ষোভ, ২০২০ সালে বেলারুশের বিক্ষোভ এবং ২০২১ সালে মিয়ানমারের অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে দেয়।

দেশ-দেশে স্বৈরশাসনের অবসান : নানা কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে স্বৈরশাসকদের আবির্ভাব ঘটে। এসব স্বৈরশাসকের উত্থান হয় মূলত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। তবে কেউ কেউ বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়েও ক্ষমতায় আসীন হন। মানুষ অনেক আশা নিয়ে তাদের ভোট দেয়। কিন্তু ক্রমেই একসময় স্বৈরশাসক হয়ে উঠতে থাকেন তারা। ক্ষমতার দাপটে ক্রমেই উন্মত্ত হয়ে ওঠেন। এরপর জনগণের ওপর চালাতে থাকেন নানা ধরনের নির্যাতন। স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি তখন তাদের প্রধান কাজ হয়। যে জনগণ তাদের ভোট দিয়েছেন, তাদের সামান্য সমালোচনাও আর সহ্য করতে পারেন না তারা। নতুন নতুন গণতন্ত্রবিরোধী আইন জারি করে জনগণের ওপর চালান নির্যাতনের স্টিমরোলার। প্রথমদিকে জনগণ নীরব থাকলেও ধীরে ধীরে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত ঘটে গণজোয়ার। সে জোয়ারে খড়কুটোর মতো ভেসে যায় স্বৈরশাসকরা। ঘটে বিপ্লব, গণআন্দোলন। যুগে যুগে এমন নির্মম ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে ইতিহাস। একজন স্বৈরশাসকের পতন ঘটাতে কোন কৌশল সবচেয়ে বেশি কার্যকরী? সহিংস প্রতিবাদ নাকি অহিংস আন্দোলন? আর ক্ষমতা থেকে কোনো রাজনীতিককে সরাতে এ রকম বিক্ষোভ কত বড় হতে হবে? হার্ভার্ডের গবেষক এরিকা চেনোওয়েথ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষণা চালিয়েছেন। বিগত কয়েক দশকে বিশ্বের দেশে দেশে যেসব গণআন্দোলন-গণবিক্ষোভ হয়েছে, সেগুলো নিয়ে মন্তব্য উপস্থাপন করেছেন। সেই গবেষণার ভিত্তিতে তিনি বলেছেন, কোনো জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষ যদি গণবিক্ষোভে যোগ দেন, তাতেই তারা সফল হতে পারেন। বিগত কয়েক দশকে বিশ্বে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর সফল আন্দোলনের অনেক নজির আছে। ১৯৮০-এর দশকে কমিউনিস্ট শাসনামলে পোল্যান্ডে হয়েছিল সলিডারিটি আন্দোলন। এর নেতৃত্বে ছিল শ্রমিকদের ইউনিয়নগুলো। দক্ষিণ আফ্রিকায় দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলেছে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন। চিলির স্বৈরশাসক অগাস্তো পিনোশের পতন ঘটেছিল গণআন্দোলনের মুখে। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লোবোদান মিলোসেভিচকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয় সফল আন্দোলনের মাধ্যমে। একেবারে অতি সাম্প্রতিককালের উদাহরণও আছে। আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয় ওমর আল-বশিরকে। একইভাবে আলজেরিয়ায় ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে আবদুল আজিজ বুতেফ্লিকাকে। বৈদেশিক মুদ্রা, খাদ্য ও জ্বালানি সংকটে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষ। তারা একযোগে রাস্তায় নেমে আসে। দখল করে নেয় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন। স্মরণকালের মধ্যেই ঘটেছে এসব সফল গণআন্দোলন। এগুলোর পথ ধরে এসব দেশে দেশে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে।

লেখক : গবেষক ও গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত