দীর্ঘ ৪ দশকের বেশি সময় ধরে ইরান এবং ইসরায়েলের ভেতরে যে কঠিন দ্বন্দ্ব চলে আসছে, তার একটা চূড়ান্ত ফয়সালার সময় এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ইরানের পক্ষ থেকে বারবার ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের অস্তিত্ব মুছে ফেলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে এবার ইরানের বিরুদ্ধে মরণকামড় দিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ১৯৭৩ সালের পর গত ৫২ বছরের মধ্যে এই প্রথম ইসরায়েল কোনো স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াল এবং কোনো স্টেটের আক্রমণে সরাসরি ইসরায়েলের ভেতরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলো, নাগরিক নিহত হলো। গত ১২ জুন দিবাগত রাতে ইসরায়েল ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’-এর মাধ্যমে ২০০ অত্যাধুনিক বিমান দিয়ে ইরানের ওপর ঝাঁপিয়ে গড়ে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম নুর নিউজ ইসরায়েলি হামলার প্রথম দিনে দেশটিতে ৭৮ জন নিহত এবং ৩২৯ জন আহত হওয়ার তথ্য জানিয়েছে। এ হামলায় দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি ও রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান জেনারেল হোসেইন সালামি, বিমানবাহিনীর প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহসহ অন্তত ২০ জ্যেষ্ঠ কমান্ডার নিহত হন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পরদিন ১৩ জুন শনিবার সকালে ইরান ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে ১০০ অত্যাধুনিক শাহেদ ড্রোন ছোঁড়ে। সঙ্গে চলে ব্যালেস্টিক ও হাইপারসনিক মিসাইল হামলা। ইরান অভিযানের নাম দেয় ‘অপারেশন প্রমিজ থ্রি’।
এ অভিযানের অংশ হিসেবে ইরান ১৩ জুন শনিবার রাতভর তেলআবিব ও পূর্ব জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের গুরুত্বপূর্ণ শহর-বন্দরে মিসাইল হামলা চালায়। ইরানের এ পাল্টা অভিযান এখনও চলমান। ইরানের শত শত ব্যালেস্টিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তেলআবিব, হাইফা শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ বেনগুরিয়ান বিমানবন্দর মৃত্যুপুরির রূপধারণ করেছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সংঘাত এখন শুধু দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ধেয়ে আসছে ইয়েমেন থেকেও। আক্রমণের ফলে ইসরাইলিরা বারবার আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যেতে বাধ্য হয়। এখন পর্যন্ত ইরানের হামলায় ১৫ জন নিহত, তিন শতাধিক আহত হয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইসরায়েল। ইরানের ধ্বংসাত্মক হামলার ধরন দেখে হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। ইসরায়েলে মিডিয়ার ওপর সেন্সরশিপ কঠোর। সেন্সরশিপের কারণে সব তথ্য সামনে আসে না। ইসরায়েলের পেন্টাগন নামে খ্যাত কিরিয়া ভবনে ইরানিয়ান মিসাইল আঘাত করার পর সেটার সামনে থেকে রিপোর্ট করার সময় ফক্স নিউজের সাংবাদিককে জোর করে সরিয়ে দিতে দেখা যায়। ১৩ জুনের পর ইসরায়েলের অধিকাংশ নাগরিক রাত কাটাচ্ছে মাটির নিচের বাঙ্কারে।
ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ১৩ জুন রাতটা আমার জন্য খুবই খারাপ একটা রাত গেছে। আমাকে পাঁচবার বাঙ্কারে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তেলআবিবের কেন্দ্রস্থলে হামলার পর যে দৃশ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়, তা দেখে মনে হয়েছে, উক্ত স্থানটি যেন গাজা ভূখণ্ডেরই কোনো অংশ। আকাশপথে হামলার পাশাপাশি সাব-মেরিন ও যুদ্ধ জাহাজ থেকেও ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে ইরান।
ইরান ইসরায়েলের দুটি F-35 যুদ্ধ বিমানকে ভূপাতিত এবং এক নারী পাইলটকে আটক করার দাবি করেছে। যদিও ইসরায়েল ইরানের এ দাবি অস্বীকার করেছে। ইরানের দাবি সত্যি হয়ে থাকলে এ যাবতকালে এটিই হবে আমেরিকার তৈরি F-35 যুদ্ধ বিমান ধ্বংসের প্রথম ঘটনা। এ পর্যন্ত থেমে থেমে ইরান পাল্টা জবাব ভালোভাবেই দিয়েছে বলে মনে করেন সমর বিশ্লেষকরা। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের বর্ডার নেই। এতদূর থেকে, এত এত সর্বাধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আইরন ডোম ভেদ করে তারা এতগুলো আঘাত করতে পেরেছে, এটা কম নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঘাতটি হেনেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও মোসাদের হেডকোয়ার্টারে।
উভয় পক্ষের হামলা-পাল্টা হামলায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা যদি বাইরে থেকে বোঝানো হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বড় ধরনের সামরিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইরানের। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, ৪ জন মূল পারমাণবিক বিজ্ঞানী, সঙ্গে আরও ৭ জন সহযোগী বিজ্ঞানীকে সুনির্দিষ্টভাবে হত্যা করার মাধ্যমে ইসরায়েল জানিয়ে দিয়েছে, আগামীর দিন ইরানের জন্য এবং মুসলিম বিশ্বের জন্য কতটা বেদনাদায়ক হতে যাচ্ছে।
ইসরায়েলের এ নিখুঁত হামলা চালানোর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ইরানে নিয়োগকৃত এজেন্টরা। ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক রিঅ্যাক্টরের ওপর ইসরায়েলি বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের জন্য পথ সুগম করতে ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে হ্যাক করে অকার্যকর করে ফেলে ইরানের অভ্যন্তরে নিয়োগকৃত মোসাদের এজেন্টরা। মোসাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল ইরানের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার কাছাকাছি খোলা জায়গায় নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র মোতায়েন, ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত উন্নত প্রযুক্তি এবং তেহরানের কাছে একটি অ্যাটাক-ড্রোন ঘাঁটি স্থাপন। এ ছাড়া ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা তেহরানের নাতাঞ্জ, কুম শহরের ফোর্দো ও ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনাসহ টার্গেট করা হয় দেশটির সামরিক ঘাঁটিগুলোও। অবশ্যই ইরান কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই চীন এবং রাশিয়ার সহযোগিতায় সারা দেশে থাকা আড়াই হাজার এয়ার ডিফেন্স ব্যাটারি চালু করতে সক্ষম হয়। পরদিন ইসরাইল ইরানে হামলা করতে এসে প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হয়। দুটি যুদ্ধ বিমান হারায় বলে দাবি ইরানের।
অনেকের ধারণা, পারমাণবিক ইস্যুতে মার্কিন-ইরান আলোচনার অচলাবস্থার ফলে ইসরায়েল ইরানে হামলা চালিয়েছে। অধিকাংশ রাজনীতি বিশ্লেষকের মতে, এ কথা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ইরানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল তাদের পূর্বপ্রস্তুতি আগেই সেরে রেখেছিল। ইসরায়েল ইরানের প্রতিরোধের অন্যতম অংশীদার হামাসকে নির্মুল করে ঠান্ডা মাথায়। এরপর লেবাননের হিজবুল্লাহ পঙ্গু করে দেয়। যাতে লেবানন থেকে কোনো প্রতিরোধ না আসে। সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপকে টেকনিক্যালি সকল সহযোগিতা দিয়ে আসাদ সরকারকে উৎখাত করে ইরানকে একপ্রকার কোণঠাসা করে ফেলা হয়। সিরিয়ায় ইরানের যে রাডার সিস্টেম চালু ছিল, যার মাধ্যমে ইরান আগেভাগে কিছুটা তথ্য পেত, হামলার আগে ইসরায়েল সিরিয়ার সব ডিফেন্স ধ্বংস করে দেয়। রাশিয়ায় ইউক্রেনের সফল ড্রোন হামলার পরেই সামরিক বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারে, শিগগিরই ইরানে হামলা করতে যাচ্ছে ইসরায়েল-আমেরিকা।
রাশিয়া আর ইরানের বন্ধুত্ব সীমাহীন। ইরানের কাছে নিকটতম কোনো বন্ধু নেই। সবাইকে ইসরায়েল ঘায়েল করে রেখেছে। রাশিয়ার বিমানশক্তিকে দুর্বল করে ইসরায়েল ইরানে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজায়। ইসরায়েল ইরানকে আক্রমণ করতে সৌদি আরব-আমিরাত-কাতারের মতো দেশের আকাশসীমা ও ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি পায়নি। তাই লম্বা দূরত্ব অতিক্রম করে হামলা চালাতে হয়। ইসরায়েলের ২০০ বিমান এ হামলায় অংশ নেয় বলে নিশ্চিত করেছে। ইসরায়েল থেকে ইরানে গিয়ে হামলা করতে হলে মাঝপথে যুদ্ধ বিমানগুলোর জ্বালানি সরবরাহ লাগবে। মাঝ আকাশে জ্বালানি সাপ্লাই দেওয়ার মতো দখলদারদের বিমান আছে মাত্র দুটি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ দুশো বিমানকে কীভাবে মাত্র দুটি বিমান জ্বালানি সাপ্লাই দিল? এতে ধারণা করা হচ্ছে, এ হামলায় মার্কিন ও পশ্চিমা অন্যান্য দেশের বাহিনী সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে এবং তারা বিমান, রিফুয়েলিং, গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছে।
যুদ্ধ প্রবলম্বিত হলে ইসরায়েল একটা সুযোগ নষ্ট করবে বলে মনে হয় না। সেই সুযোগটা হচ্ছে, ইরানকে উস্কে দিয়ে আরবদেশে অবস্থিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোকে নিশানা বানানো। ইরান যদি পার্শ্ববর্তী দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করে, তাহলে যুদ্ধে আমেরিকা সরাসরি জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। সৌদি-কাতার-কুয়েত-আমিরাত তখন তাদের আকাশপথ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুলে দেবে। দিতে বাধ্য। দেশগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব মূলত পেছনের ক্রীড়ানক যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এরই মধ্যে ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিতে এগিয়ে আসছে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। ইরান ঘোষণা দিয়েছে, মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন ঘাঁটিগুলো থেকে হামলা হলে ঘাঁটিগুলো যে দেশে অবস্থিত, সেসব দেশে হামলা করবে। যুক্তরাষ্ট্র এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বিমান আক্রমণের পাশাপাশি স্থল অভিযান চালিয়ে ইরানের বর্তমান শাসকগোষ্ঠীকে হটিয়ে তাঁবেদার সরকার গঠনের পদক্ষেপ নিতে পারে। যে চেষ্টা চালিয়ে আসছে বিগত চার দশক ধরে। এমনটি হলে একদিকে নীলনদ, অন্যদিকে ইউফ্রেটিস নদী পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল আরব ভূখণ্ড নিয়ে গ্রেটার ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের রোডম্যাপে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। সবমিলিয়ে বলা যায়, মুসলিম জাতির জন্য সামনের দিনগুলো খুবই অনিশ্চিত। সময় থাকতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আরব রাষ্ট্রগুলো দ্রুততম সময়ে ইসরায়েলের করদ রাজ্যে পরিণত হতে পারে। আগে ছিল আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের গোপন সহযোগী, আর তখন হবে করদ রাজ্য! এরই মধ্যে ইরান হরমুজপ্রণালি বন্ধ করে দিয়েছে। যে প্রণালি দিয়ে বিশ্বের ৩০ ভাগ জ্বালানি তেল রপ্তানি করা হয়।
বিশ্লেষকদের মতে, খুব দ্রুত ইরান-ইসরায়েল সমাধানে আসতে না পারলে এ যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে তা নয়, সূচনা করতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের। এ ক্ষেত্রে চীন-রাশিয়া ইরানের পক্ষে থাকবে। পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়াও ইরানের পাশে থাকবে বলে ঘোষণাও দিয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা তো ইসরায়েলের সঙ্গে আছেই। এ যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি রূপ নিলে আমাদের মতো দেশগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। এরই মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। কিছুদিন পর দেখা যাবে, এ যুদ্ধের খরচ বাংলাদেশের জনগণও বহন করছে।
লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক