ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার শঙ্কা

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার শঙ্কা

ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের গতবছর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন বিনিময় হয়েছিল। কিন্তু অতীতের যে কোনো সংঘাতের তুলনায় ইরানের তরফে সাম্প্রতিক এ হামলা অনেক বেশি বিস্তৃত। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এটা ইরানের ভূখণ্ডের ওপর চালানো সব চেয়ে বড় হামলা। ভোরের আলো ফোটার আগে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী শুধু ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্থাপনাগুলোকেই নয়, সে দেশের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোকেও নিশানা করে হামলা চালায়। ফলে ইরানের পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা কমেছে। জানা গেছে, ইরানের সামরিক কমান্ড এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নেটওয়ার্ক। ইসরায়েলের তরফে চালানো এ অভিযানে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রধান, মূলধারার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং আইআরজিসির বিমান বাহিনীর প্রধানের মৃত্যু হয়েছে।

আইআরজিসি ১৯৭৯ সালে শাহের শাসনকে উৎখাতকারী ইসলামি বিপ্লবের মূলে ছিল। ইরান জানিয়েছে, কমপক্ষে সে দেশের ছয়জন বিজ্ঞানীরও মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা সফলভাবে ইরানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের একেবারে কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করে আঘাত হেনেছে। প্রমাণ করে দিয়েছে, সেখানে কেউই আর নিরাপদ নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সংবাদে ৭৮ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে। মোসাদ ইরানের ভেতর থেকেই ড্রোন হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানা গেছে। এ পুরো অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক স্থাপনা এবং আইআরজিসির ঘাঁটি। দীর্ঘ সময় ধরেই ইসরায়েল ঠিক এ কাজটাই করতে চেয়েছিল। এ হামলা ইরানকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হতে পারে, এটা সূচনা মাত্র। হতে পারে, ইসরায়েলের তালিকায় সম্ভাব্য আরও লক্ষ্যবস্তু রয়েছে; যেখানে আঘাত হেনে ইরানকে আরও প্রভাবিত করতে চায় তারা। এর মধ্যে কিছু লক্ষ্যবস্তু ইসরায়েলের নাগালের বাইরেও থাকতে পারে। হতে পারে, সেইসব লক্ষ্যবস্তু শক্ত পাথরের নিচে শক্তিশালী ঘাঁটিতে গভীর ভূগর্ভে রাখা আছে।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি টার্গেট : ইসরায়েল এবং বেশ কয়েকটা পশ্চিমা দেশ সন্দেহ করে, ইরান গোপনে ব্রেকআউট সক্ষমতা গড়ে তুলছে। এর অর্থ হলো, কোনো দেশের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও তা দ্রুত মোতায়েন করার ক্ষমতা। এখান থেকে ফেরার কোনো পথ নেই। ইরান অবশ্য তাদের বিরুদ্ধে ওঠা এ অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। তারা সবসময় জোর দিয়ে বলেছে, ইরানের বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি আছে; যার জন্য তারা রাশিয়ার কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছে। এ কর্মসূচির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। গত এক দশক ধরে ইরানের পারমাণবিক অগ্রগতিকে ধীর করতে এবং তা পিছিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল। বিভিন্ন মাত্রায় তারা এ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে রহস্যজনকভাবে ইরানি বিজ্ঞানীদের মৃত্যু হয়েছে। তেহরানের কাছে এক নির্জন রাস্তায় রিমোট কন্ট্রোল মেশিন-গানের গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল পারমাণবিক কর্মসূচির সামরিক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফাখরিজাদেহের। সালটা ছিল ২০২০। এর আগে, ইরানের সেন্ট্রিফিউজ সিস্টেমকে নষ্ট করতে মার্কিন ও ইসরায়েলি সাইবার গোয়েন্দারা স্টাক্সনেট সাংকেতিক নামযুক্ত বিধ্বংসী কম্পিউটার ভাইরাস ব্যবহার করেছিল। ফলে সেগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সেন্ট্রিফিউজ সিস্টেম ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা) বা আইএইএ ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার রোধ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করার অভিযোগ তুলে তাদের জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানোর হুমকি দিয়েছে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, বিশেষত সে দেশে উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুদ রাখাকে কেন্দ্র করে। এ ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছে; যা বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় স্তরের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু বোমা তৈরি শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় স্তরের চেয়ে তুলনামূলক কম। ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর লাগাম কষতে একটা যৌথ পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

২০১৫ সালে বারাক ওবামার সময়ে ইরানের সঙ্গে সে দেশের পারমাণবিক কর্মকাণ্ডে লাগাম টানার উদ্দেশ্যে করা এ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও ছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম দফায় ক্ষমতায় আসার পরই একে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ চুক্তি বলে অভিহিত করে যুক্তরাষ্ট্রকে সেখান থেকে সরিয়ে নেন। পরের বছর ইরান ওই চুক্তি মেনে চলা বন্ধ করে দেয়। আসলে ইরান ছাড়া কেউই চায় না, এ ইসলামি প্রজাতন্ত্র পারমাণবিক বোমার অধিকারী হোক। ইসরায়েলের মতো ছোট দেশ যার জনসংখ্যা ৯৫ লাখ, পরমাণু শক্তিধর ইরানকে তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে। এর নেপথ্যে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইরানের বিভিন্ন জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের অসংখ্য বিবৃতি; যেখানে তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ডাক দিয়েছেন।

সৌদি আরব, জর্ডান ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলো ইরানের বিপ্লবী ইসলামি প্রজাতন্ত্র সরকারকে খুব একটা পাত্তা দেয় না। তবে তারা প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে শিখেছে। ইসরায়েল এবং ইরানের এখনকার সংঘাত তাদের দোরগোড়ায় এসে উপস্থিত হতে পারে, এ ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো। এ সময়টা ইসরায়েলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেবানন, সিরিয়া ও গাজায় তাদের সমর্থক ও মিত্রদের কার্যকর পরাজয় বা নির্মুল হওয়ার ফলে ইরান এরই মধ্যে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গত অক্টোবরে ইসরায়েলের হামলার পর ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসে একজন সহানুভূতিশীল প্রেসিডেন্ট রয়েছেন। এ ছাড়া আরও একটা বড় কারণ হলো, ইসরায়েল আশঙ্কা করেছিল, ইরান তাদের কিছু প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সরঞ্জাম ভূগর্ভের গভীরে সরাতে চলেছে।

এরপর যা হতে পারে : এ অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েল কী করতে চায়, তা স্পষ্ট। তারা অন্তত ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে বছরের পর বছর পিছিয়ে দিতে চায়। তবে সম্ভব হলে এ কর্মসূচিকে পুরোপুরি বন্ধ করতে চাইবে। ইসরায়েলের সামরিক, রাজনৈতিক ও গোয়েন্দা মহলের অনেকে আশা করেন, যাতে এ অভিযান ইরানের নেতৃত্বকে এতটাই দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়, যাতে তারা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং সেখানে এমন শাসন দেখা যাবে, যা আর হুমকি সৃষ্টি করবে না। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুক্রবার বলেন, ইরান একটা চুক্তিতে সম্মত হওয়ার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছে। রোববার মাস্কাটে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান ষষ্ঠ দফা আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও ইসরায়েল এসব আলোচনাকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। ঠিক যেমন ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় ট্রাম্পের সঙ্গে রাশিয়ার আঁতাতের অভিযোগ উঠেছে, ইরানের ক্ষেত্রেও একই জিনিস হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ইসরায়েল।

ইরানের সন্দেহভাজন পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করার জন্য এটাই তাদের সেরা এবং সম্ভবত শেষ সুযোগ বলে মনে করে ইসরায়েল। ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) সিনিয়র পলিসি ফেলো এলি গেরানমায়েহ বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে নষ্ট করার জন্যই ইরানে রাতভর নজিরবিহীন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এ বিষয়টা স্পষ্ট, তাদের (হামলার) টাইমিং এবং বড় আকারের প্রকৃতির উদ্দেশ্য ছিল আলোচনাকে পুরোপুরিভাবে লাইনচ্যুত করা। ওয়াশিংটন ইরানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, এ হামলার সঙ্গে তারা জড়িত নয়। কিন্তু ইরান যদি ওই অঞ্চলে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটির যে কোনো একটাতে সরাসরি বা প্রক্সির মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যের আরও একটা সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে পারে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইসরাইলকে কঠোর শাস্তি দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও দু’বছর আগের তুলনায় ইরান এখন অনেকটাই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। তাদের কাছে প্রতিশোধ নেওয়ার বিকল্পও সীমিত।

পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতা : তবে এখানে আরও বড় ঝুঁকি রয়েছে। ইসরায়েলের এ অভিযান এখনও উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে এবং পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। ইরানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরের কট্টরপন্থিরা দীর্ঘদিন ধরে এ যুক্তি দেখিয়ে এসেছেন, ভবিষ্যতে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণ ঠেকাতে সর্বোত্তম প্রতিরোধ হতে পারে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা। তারা লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন নেতাদের কথা মাথায় রেখেছে। লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি ২০০৩ সালে তার গণবিধ্বংসী অস্ত্র কর্মসূচি ত্যাগ করেন। তার আট বছর পর পশ্চিমা বিমানশক্তির সমর্থনপুষ্ট আরবের গণবিক্ষোভের সময় তাকে হত্যা করা হয়। এর ঠিক উল্টো উদাহরণ উত্তর কোরিয়া। তারা সমস্ত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পারমাণবিক ওয়ারহেড এবং আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের একটা শক্তিশালী অস্ত্রাগার তৈরি করেছে; যা যে কোনো সম্ভাব্য হামলাকারীকে দু’বার ভাবতে বাধ্য করবে। ইসরাইলের অপারেশন রাইজিং লায়ন থেকে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, ইরানের শাসকগোষ্ঠী যদি টিকে থাকে যেমনটা আগেও দেখা গেছে, তাহলে এখন একটা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। সেটা আর কিছু নয়, তারা পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে, এমনকি তা পরীক্ষা করতে উদগ্রীব হয়ে উঠবে। যদি তা-ই হয়, তাহলে প্রায় অনিবার্যভাবেই মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। সৌদি আরব, তুরস্ক এবং সম্ভবত মিশর সকলেই মনে করবে, তাদেরও পারমাণবিক শক্তির প্রয়োজন আছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত