রাঙামাটির আকাশে এখন প্রতিদিনই মেঘের আনাগোনা। একেকদিন হালকা ফোঁটা, তো কখনও দিনভর ধুমধাড়াক্কা বৃষ্টি। বর্ষা যত এগিয়ে আসছে, রাঙামাটির গহীন পাহাড়ে ততই প্রাণ ফিরছে শত শত ঝর্ণায়। কাপ্তাই হ্রদের আকাশে-মাটিতে, পাথুরে ধাপে ধাপে নেমে আসা জলপ্রপাতগুলোর গর্জন যেন পাহাড়ের হৃদস্পন্দন হয়ে উঠেছে।
এই সময়টাতে রাঙামাটির রাজস্থলী থেকে সাজেক, বাঘাইছড়ি থেকে বিলাইছড়ি কিংবা হাজাছড়া থেকে দেবতাখুম সবখানে কেবলই জল আর সবুজের মেলবন্ধন। জীবনের ক্লান্তি ভুলে যেতে, শহরের কোলাহল থেকে পালিয়ে প্রকৃতির কোলে ছুটে আসছেন হাজারো মানুষ। বিশেষ করে সপ্তাহান্তে শহরের হোটেল-মোটেলগুলোতে খালি কক্ষ পাওয়া দুষ্কর।
আমরা রিজার্ভ ট্রলারে উঠেছিলাম সকাল আটটায়। কাপ্তাই হ্রদ পেরিয়ে শুভলং ঝর্ণায় পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক লেগেছে। ঝর্ণার গর্জনে কথা বলা যায় না, শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অবাক হয়ে। কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা থেকে আসা পর্যটক মেহরাব হাসান। সঙ্গে তার স্ত্রী ও ছোট বাচ্চা। সুবলং, ঘাগড়া, সাজেক, দেবতাখুম, বিলাইছড়ি, হাজাছড়া, পানছড়ি, গাইন্দ্যা, লংগদু, বাঘাইহাটসহ অসংখ্য ঝরনার নাম এখন পর্যটকদের মুখে মুখে ফিরছে। অনেক জায়গা এখনও একেবারে অফবিট। স্থানীয় গাইড আর হালকা দুঃসাহস না থাকলে গন্তব্যে পৌঁছানো অসম্ভব। আর এ-ই যেন বাড়তি রোমাঞ্চ হয়ে উঠেছে তরুণদের জন্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অজয় দে বলেন, প্রথমবার রাঙামাটি এলাম। এত রোমাঞ্চ আর সৌন্দর্য একসঙ্গে দেখিনি আগে। ঝরনার জল, সবুজ বন আর পাহাড়ি গ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা জীবনেও ভুলব না। সুবলং ঝর্ণায় বেড়াতে এসে দেখা মিলে গেল সিলেট থেকে আসা মো. আলাউদ্দিন ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে। সকালে রাঙামাটি পৌঁছে সরাসরি তারা ছুটে যান সুবলং ঝর্ণা ও কাপ্তাই হ্রদ দেখতে। ঝর্ণার গর্জন আর হ্রদের নীল জলরাশির অপরূপ দৃশ্য দেখে আবেগে আপ্লুত আলাউদ্দিন বলেন, এমন মনোমুগ্ধকর প্রকৃতির দৃশ্য সারা জীবনে খুব কমই দেখা হয়েছে। সুবলং ঝর্ণা আর কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য একে অপরকে যেন পরিপূর্ণ করে। সিলেটেও পাহাড়-প্রকৃতি আছে, কিন্তু রাঙামাটির রূপ একেবারেই অনন্য। তারা জানান, সুযোগ পেলে আবারও রাঙামাটি ঘুরতে আসবেন। রাঙামাটির হোটেল-মোটেল থেকে শুরু করে রিজার্ভ ট্রলার, হোমস্টে, স্থানীয় গাইড, খাবারের দোকান এমনকি পানির বোতলের ব্যবসাতেও ঈদের মৌসুমের মতো রমরমা ভাব। টু?রিস্ট বোট চালক মনির হোসেন জানালেন, এক সময় দিনে এক-দুইটা ট্রিপ হতো, এখন চার-পাঁচটা। প্রতিদিনই কাপ্তাই থেকে শুভলং বা বিলাইছড়ির দিকে পর্যটক নিচ্ছি। এই বর্ষাই আমাদের সোনার সময়।
শুধু শহর নয়; দূর পাহাড়ি গ্রামেও এখন পর্যটক ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয়রা। কেউ হোমস্টে চালু করেছেন, কেউ আবার ছোটখাটো রেস্তোরাঁ খুলেছেন। কাপ্তাই হ্রদের দ্বীপ-গ্রামে বসে ভাজি-ভাত খেতে খেতে ঝর্ণার শব্দে হারিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পর্যটকদের জন্য অনন্য। তবে এই পর্যটন জোয়ারের সঙ্গেই প্রশ্ন উঠছে অব্যবস্থা ও নিরাপত্তার। বেশিরভাগ ঝরনার পথে নেই কোনো দিকনির্দেশনা, জরুরি সহায়তা কেন্দ্র বা টয়লেট। নৌকাগুলোরও অনেকগুলোর নেই সরকারি রেজিস্ট্রেশন বা ফিটনেস। দুর্গম পথে পড়ে গেলে দ্রুত চিকিৎসা পাওয়াও দুষ্কর। ঢাকা থেকে আসা পর্যটক সালমা বেগম বললেন, সাজেকের এক ঝরনায় উঠতে গিয়ে এক বন্ধু পড়ে গিয়ে পা মচকে বসে। কাছাকাছি ছিল না কোনো ফার্স্ট এইড বা সহায়তা। এই বিষয়গুলো নিয়ে কর্তৃপক্ষের ভাবা দরকার। রাঙামাটি পর্যটন কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপক অলোক বিকাশ চাকমা বলেন, এখন পর্যটনের মৌসুম চলছে। প্রতিদিন হাজারো পর্যটক রাঙামাটি ভ্রমণে আসছেন। বিশেষ করে ঝরনা আর কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করতেই তাদের আগমন বেশি।
তিনি আরও জানান, পর্যটকদের জন্য নৌভ্রমণ, হ্রদভ্রমণ ও ঝর্ণার ট্রেকিংসহ নানা সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করছে পর্যটন কর্পোরেশন। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবার মান নিশ্চিত করতেও প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাঙামাটি জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, পর্যটকদের ভ্রমণের আগে আবহাওয়া বার্তা, নৌকা বা গাইডের তথ্য যাচাই এবং স্থানীয়দের নির্দেশনা অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পর্যটনবান্ধব অবকাঠামো ও সেবার উন্নয়নেও কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। রাঙামাটির ঝর্ণাগুলোর এখন ভরা যৌবন। এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বর্ষায়, কুয়াশামাখা সকালের পাহাড়ি ঝর্ণায় দাঁড়িয়ে মনে হয় বাংলাদেশেরও স্বর্গ আছে, শুধু চোখ খুলে দেখার মানুষ চাই। পর্যটনের বিকাশ, স্থানীয় মানুষের আয় এবং প্রকৃতির রক্ষার ভারসাম্য রক্ষা করেই রাঙামাটির ঝরনা হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম টেকসই পর্যটন গন্তব্য।