চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় বাংলাদেশের হৃদপি-। বন্দর নগরীর গর্বের একটি জায়গা চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দরকে কেন্দ্র করে আশেপাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চল। বলা চলে, দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের। সম্প্রতি কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বিশ্বের ৬৭তম এ বন্দরটি। সময়ের সঙ্গে পণ্য রপ্তানি বাড়ছে ক্রমাগতভাবে। ডলারসংকট কাটিয়ে আমদানিও স্বাভাবিক হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির ওপর ভর করে কনটেইনার পরিবহনে নতুন উচ্চতায় জায়গা করে নিল বিশ্বের ৬৭তম অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম বন্দর।
সদ্য বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের প্রধান এ সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রায় ৩২ লাখ ৯৬ হাজার একক কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। কনটেইনার পরিবহনে বিগত ৪৮ বছরের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যা। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে। সেবার সাড়ে ৩২ লাখ কনটেইনার পরিবহন হয়েছিল, যা এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তৃতীয় সর্বোচ্চসংখ্যক কনটেইনার পরিবহনের রেকর্ড রয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। বন্দরের হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কনটেইনার পরিবহন হয়েছিল ৩১ লাখ ৬৮ হাজার একক, অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে কনটেইনার পরিবহন বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি টার্মিনাল, কমলাপুর কনটেইনার ডিপো ও পাঁনগাও নৌ টার্মিনালে এসব কনটেইনার পরিবহন হয়েছে। এ হিসাবে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবাহী এবং খালি কনটেইনার রয়েছে।
কনটেইনার পরিবহনে প্রবৃদ্ধি হলেও বন্দরের কার্যক্রম অন্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয়েছে বিদায়ী অর্থবছরে। অর্থবছরের শুরুতে জুলাই-আগস্টে আন্দোলন কর্মসূচি, অর্থবছর শেষে কাস্টমসের শাটডাউন কর্মসূচি, পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা কারণে বন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে। বছরজুড়ে বন্দরে মোট ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ৬৭টি টিইইউ (২০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সমতুল্য ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৭ টিইইউ বেশি। আগের বছর হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউ।
ফলে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ শতাংশ। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার অপারেশন শুরুর পর থেকে এটিই সর্বোচ্চ কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের রেকর্ড।
একই সঙ্গে, দেশের সবচেয়ে বড় কাস্টমস স্টেশন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় করেছে ৭৫ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এ অঙ্ক ছিল ৬৮ হাজার ৭৫৫ দশমিক ৭ কোটি টাকা। বছরে রাজস্ব আদায় বেড়েছে ৬ হাজার ৬৭৬ দশমিক ৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, এই পরিমাণ কনটেইনার হ্যান্ডলিং আমাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। এ অর্জনে বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। আমরা সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।’ লন্ডনভিত্তিক শিপিং প্রকাশনা লয়েড’স লিস্ট অনুযায়ী, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরগুলোর মধ্যে ৬৭তম অবস্থানে রয়েছে। অর্থবছরের শেষে আন্দোলন কর্মসূচি না হলে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার পরিবহন আরও বাড়ত। এরপরও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বন্দরের এ সাফল্য এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে মোট পণ্য পরিবহনের ২৩ শতাংশ কনটেইনার আনা-নেওয়া হয়। বাকি ৭৭ শতাংশ হচ্ছে কনটেইনারবিহীন পণ্য। যেমন খোলা পণ্য, জ্বালানি ও ভোজ্যতেল। পণ্যের পরিমাণে কম হলেও সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য আনা হয় কনটেইনারে। যেমন শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, বাণিজ্যিক পণ্য কনটেইনারে আসে। আবার রপ্তানির পুরোটাই যায় কনটেইনারে। বাংলাদেশে কনটেইনার পরিবহনের জন্য দুটি বন্দর রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরেই ৯৯ শতাংশ কনটেইনার পরিবহন হয়। মোংলায় পরিবহন হয় ১ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৮০ হাজার ৪০২ কোটি টাকার তুলনায় ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা পিছিয়ে থাকলেও সার্বিক আদায় ইতিবাচক ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ হাউস রাজস্ব আদায় করেছিল ৬২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, অর্থবছরের শেষ দিকে এনবিআর কর্মকর্তাদের কর্মবিরতি ও আন্দোলনের কারণে বন্দর ও কাস্টমসে কার্যক্রম ব্যাহত না হলে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ৩৩ লাখ ছাড়িয়ে যেত এবং রাজস্ব আদায় আরও বেশি হতো বলে জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ। বছরজুড়ে কাস্টমস ও বন্দর কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে বিভিন্ন ঘটনা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, দুটি ঈদ উপলক্ষে ছুটি, পরিবহন ধর্মঘট, এনবিআর কর্মকর্তাদের একাধিক ধাপের কর্মবিরতি এবং পুরোপুরি কার্যবিরতি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক অর্থবছরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ছিল: ২০২০-২১ সালে ৩০ লাখ ৪ হাজার ১৪২টিইইউ, ২০২১-২২ সালে ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৩৬টিইইউ, ২০২২-২৩ সালে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮টিইইউ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩৭৫টিইইউ। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে যে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়, তারমধ্যে মূল জেটি, কমলাপুর অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো (আইসিডি) ও পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত। এতে আমদানি-রপ্তানি উভয় কনটেইনার এবং খালি কনটেইনারও অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বর্তমানে মোট আমদানির ২৩ শতাংশ হয় কনটেইনারে। বাকি ৭৭ শতাংশ আসে বাল্ক পণ্য, তেল ও কেমিকেল ট্যাংকারে। বন্দরে ভিড়েছে এমন জাহাজের মধ্যে ৪৫ শতাংশই কনটেইনারবাহী, ৪৫ শতাংশ বাল্ক ক্যারিয়ার এবং ১০ শতাংশ তরল পণ্যবাহী জাহাজ। দেশের মোট কনটেইনার বাণিজ্যের প্রায় ৯৯ শতাংশ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বাকিটা পরিচালিত হয় মংলা বন্দর থেকে। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস আমাদের অর্থনীতির হৃদপি-। কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধি মানেই বাণিজ্য বেড়েছে, যার সরাসরি প্রতিফলন পড়ে রাজস্বে। এ ধারা ধরে রাখতে হলে কর্মসূচির মাধ্যমে বন্দর ও কাস্টমস কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে। তবেই অর্থনীতি আরও এগোবে। এদিকে, রাজস্ব আদায়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৮০ হাজার ৪০২ কোটি টাকার তুলনায় ৪ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা পিছিয়ে থাকলেও সার্বিক আদায় ইতিবাচক ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ হাউস রাজস্ব আদায় করেছিল ৬২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।