ঢাকা বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চিকিৎসক সংকটে পাহাড়ে ব্যাহত স্বাস্থ্যসেবা

চিকিৎসক সংকটে পাহাড়ে ব্যাহত স্বাস্থ্যসেবা

দূর পাহাড়ের কঠিন ও ক্লান্তিকর পথ পেরিয়ে একজন রোগী যখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছান, তখন তার একমাত্র আশা—একজন চিকিৎসকের সেবা পাওয়া। কিন্তু হাসপাতালে তালা ঝুলতে দেখা গেলে, কিংবা ডাক্তার ওষুধ কিছুই না থাকলে সেই আশার বাতি মুহূর্তেই নিভে যায়। রাঙামাটি জেলার প্রেক্ষাপটে এটি কেবল কল্পনা নয়, বরং নিত্যদিনের বাস্তবতা।

পার্বত্য জেলা রাঙামাটির চিকিৎসা ব্যবস্থায় ভয়াবহ সংকট বিরাজ করছে। জেলার ১০টি উপজেলার মধ্যে ৯০টি অনুমোদিত চিকিৎসক পদের মধ্যে ৪৬টিই শূন্য পড়ে রয়েছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক চিকিৎসক পদে কেউ নেই। এই শূন্যতা কার্যত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তুলেছে। জেলার প্রাণকেন্দ্র রাঙামাটি সদর হাসপাতাল যেটি ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসা সুবিধা দেওয়ার কথা সেখানেও ১২টি চিকিৎসক পদ খালি। নেই কোনো গাইনি, শিশু, সার্জারি, এনেস্থেশিয়া বা অর্থোপেডিকস বিশেষজ্ঞ। ফলে অপারেশন থিয়েটার থাকলেও হচ্ছে না জরুরি অপারেশন।

উপজেলা পর্যায়ে চিত্র আরও উদ্বেগজনক। বাঘাইছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩টি পদের মধ্যে ৪টি ফাঁকা। বরকল ও বিলাইছড়িতে ৪টি পদের মধ্যে ৩টি করে শূন্য। কাপ্তাই ও জুরাছড়িতেও ৩টি করে চিকিৎসক পদ খালি। এমন পরিস্থিতিতে অধিকাংশ উপজেলা হাসপাতাল যেন কার্যত ‘রেফারাল সেন্টার’-এ পরিণত হয়েছে। রোগী দেখা বা প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়েই তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে জেলা সদর হাসপাতালে। ফলে গুরুতর রোগীদের দ্রুত চিকিৎসা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

প্রায় উপজেলায় গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকায় অনেক নারী এখনও গৃহেই সন্তান প্রসব করতে বাধ্য হচ্ছেন। জরুরি ক্ষেত্রে হাসপাতালে পৌঁছালেও সেসময় না থাকে চিকিৎসক, না থাকে অপারেশনের সুযোগ। এতে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি বেড়েই চলেছে। অধিকাংশ উপজেলায় শিশু রোগ বিশেষজ্ঞও অনুপস্থিত, এনেস্থেশিয়া চিকিৎসক না থাকায় অপারেশন থেমে আছে বছরের পর বছর।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্গম পাহাড়ে জরুরি সময়ে চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার কারণে প্রায়ই প্রাণ হারাতে হয় সাধারণ মানুষকে। সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকেন শিশু ও গর্ভবতী নারীরা। সময়মতো সেবা না পেয়ে অনেক নবজাতক পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই হারিয়ে যায়, আবার কেউবা জন্ম নিয়েও বাঁচে না বেশি সময়। অন্যদিকে, প্রসবকালীন জটিলতায় অনেক মায়ের প্রাণও চলে যায় চিকিৎসকের অভাবে। রোগীকে হাসপাতালে নিতে নৌকায় তিন ঘণ্টা লাগে। অনেক সময় পথেই মারা যায়,’ এমন হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়ার বাসিন্দা এক নারী। পাহাড়ি এলাকায় চিকিৎসক আসতে চান না এটা যেন এক অলিখিত বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়োগের পর অনেকে জয়েনই করেন না, আর যারা আসেন তারাও দ্রুত বদলির জন্য আবেদন করেন।

‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘পাহাড়ে চিকিৎসা দেওয়া শুধু পেশাগত দায়িত্ব নয়, একটা চ্যালেঞ্জও বটে। প্রতিকূল আবহাওয়া, দুর্গম অঞ্চল আর নিরাপত্তাজনিত শঙ্কা সবসময় কাজ করে। মাঝে মাঝেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে চিকিৎসা দিতে চাইলেও পারা যায় না। রাঙামাটির সিভিল সার্জন ডা. নুয়েন খীসা বলেন, চিকিৎসক সংকট একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমরা বারবার চাহিদা জানাচ্ছি, কিন্তু পার্বত্য এলাকায় কাজ করতে আগ্রহী চিকিৎসকের সংখ্যা কম। মূল সমস্যা হলো নিরাপত্তার অভাব, আবাসন সুবিধার ঘাটতি, চিকিৎসক পরিবারের শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা না থাকা। এ কারণে অনেকেই বদলি চান। তিনি আরও জানান, রাঙামাটির মতো দুর্গম এলাকায় যারা নিয়োগ পান, তাদের অনেকে দায়িত্ব নেন না বা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই অন্যত্র বদলি চান। এই অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা ধরে রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

দুর্গম পাহাড়ি গ্রামে বসবাসরত একজন সাধারণ রোগীর ভরসা থাকে ওই একমাত্র সরকারি চিকিৎসকের ওপর। কিন্তু সেই চিকিৎসক না থাকলে তার ভরসা থাকে বেসরকারি চেম্বারের ওপর—যেখানে একজন রোগীকে ফি দিতে হয় ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এই অর্থ অধিকাংশ দরিদ্র পাহাড়ি মানুষের সাধ্যের বাইরে। স্বাস্থ্যখাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ি অঞ্চলে নিয়োজিত চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ও ঝুঁকি ভাতা দিতে হবে। নিরাপদ আবাসন, স্বাস্থ্যবান্ধব পরিবেশ ও শিশুদের শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় স্থানীয় ছাত্রছাত্রীদের মেডিকেলে সুযোগ দিয়ে পাহাড়ি ডাক্তার গড়ে তুলতে হবে, যারা এখানেই থেকে সেবা দিতে আগ্রহী হবেন।

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। সেটি পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য। যদি হাসপাতালে চিকিৎসক না থাকেন, তাহলে সেসব স্থাপনা নির্মাণের অর্থ কী? যদি রোগী চিকিৎসা না পান, তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সফলতার গল্প কাদের জন্য? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একদিন দিতে হবে—যেন চিকিৎসকের অভাবে কোনো মৃত্যুই আর ‘অবধারিত’ না হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত