১১ জুলাই তারিখটা ক্যালেন্ডারে প্রতিবার ফিরে আসে। কিন্তু মিরসরাইবাসীর মনে তারিখটা ফিরে আসে একটি চাপা কান্না, এক গভীর হাহাকার হয়ে। আজ মিরসরাই ট্রাজেডির ১৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। সময় এগিয়ে গেছে, কিন্তু এই এলাকার মানুষের ভেতরের ক্ষত একটুও শুকায়নি। ২০১১ সালের সেই অশুভ দুপুরে হারিয়েছিল ৪৪ কোমলমতি শিক্ষার্থী। শোকাবহ স্মৃতির ১৩ বছর ফেরিয়ে ১৪ বছরে পদার্পণ করলো।
২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা সদর থেকে ফুটবল খেলা দেখে পিক-আপে করে বাড়ি ফেরার পথে বড়তাকিয়া-আবুতোরাব সড়কের সৈদালী এলাকার একটি ডোবায় পড়ে নিহত হয় ৪৪ স্কুলছাত্র। এই খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে দেশ-বিদেশে। ভারী হয়ে উঠে মিরসরাইয়ের আকাশ বাতাস। শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো উপজেলা।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে ১৩টি বছর। তবে সে দিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়ায় স্বজনদের। ছেলের ছবি বুকে নিয়ে নিরবে-নিভৃতে কাঁদেন গর্ভধারিণী মা। দিনটি এলেই শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন স্বজন, সহপাঠী ও শিক্ষকরা। এখন স্মৃতি বলতে শুধুমাত্র ছবির সেই বাঁধানো ফ্রেম। পুত্রহারা বাবা-মা সেই ছবি নিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে আহাজারি করেন।
তবে পরিবারগুলোর খবর রাখেন না কেউ। নিহত শাকিব, নয়ন, উজ্জল, টিটু, ইফতেখার, সাজু, কাজল, জুয়েল, মোবারক, ধ্রুব নাথদের পরিবারের খোঁজ রাখে না কেউ। দিবস আসলে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ও স্কুল কতৃপক্ষ ফটোসেশান ও আলোচনা সভায় সীমাবদ্ধ থাকেন বলে অভিযোগ নিহতের স্বজনদের। নিহত এক শিক্ষার্থীর বাবা নিজাম উদ্দিন বলেন, দেখতে দেখতে আজ ১৩টি বছর পার হয়ে গেলো আদরের সন্তানকে হারানোর।
স্বপ্ন ছিল নিজের একমাত্র সন্তানকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু ভয়াল ট্র্যাজেডি কেড়ে নিল তার স্বপ্ন।
সন্তানহারা এই পিতা জানান, দিবস আসলে শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিরা আর স্কুল কতৃপক্ষ শুধু ফটোসেশান আর আলোচনা সভায় সীমাবদ্ধ থাকেন। আমাদের খবর কেউ আর নেয় না এখন। ১১ জন সহপাঠী বন্ধু হারিয়ে নির্বাক ওই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী আজমল হোসেন জানান, তারা ছিল আমার বন্ধুর মতো, ভাইয়ের মতো, সাথীর মতো। একসঙ্গে ক্লাস করেছি, খেলাধুলা করেছি, বই বদল করে পড়েছি, হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠেছি। কে জানতো, সেদিনের খেলার মাঠ থেকে ফিরেই তারা কেউ আর কখনও ঘরে ফিরে আসবে না? মাত্র কয়েক মিনিটেই সব কিছু বদলে গেল একটি ট্রাক, এক মুহূর্তের অসতর্কতা, আর নিঃশেষ হয়ে গেল ৪৪টি জীবন, যাদের মধ্যে ১১ জন আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিল।
১১ বন্ধুর সঙ্গে যুক্ত হলো নিজের পরিবারের শোকও। বাবার চাচাতো ভাই শুভ মামা আমার খেলার সাথী সেদিনের দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে দীর্ঘ ৬ মাস মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষমেষ সে ও মায়া ত্যাগ করে এ পৃথিবীর। এ মৃত্যু যেন আমার শোক বাড়িয়ে দেয় আরও বহুগুণ। দিবসটি উপলক্ষে আবুতোরার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে পবিত্র কোরআন খতম, বেলা ১১টায় স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ এবং ‘অন্তিম’ এ পুষ্পস্তবক অর্পণ, সাড়ে ১১টায় শোক সভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মর্জিনা আক্তার জানান, সকাল ১০টায় নিহতদের স্মরণে দুই স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এরপর বেলা ১১টায় স্কুলের হলরুমে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সোমাইয়া আক্তার, নিহতদের পরিবার, স্বজন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও এলাকাবাসী।
প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাই স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের খেলা শেষে একটি ট্রাকে করে বিজয়োল্লাস করে আবুতোরাবে ফেরার পথে সৈদালীতে একটি ডোবায় শিক্ষার্থীদের বহণকারী মিনি ট্রাকটি উল্টে যায়। ওই সময় বাঁচানো যায়নি পিকআপের তলানিতে আটকে পড়া কোনো খুদে শিক্ষার্থীকে। একে একে নিথর দেহে পরিণত হয় আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের ৩৪ জন, আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার জন, আবুতোরাব ফাজিল মাদ্রাসার দুই জন, প্রফেসর কামালউদ্দিন চৌধুরী কলেজের দুই জন, এক জন অভিভাবক, ২ জন ফুটবলপ্রেমী যুবকসহ ৪৫ জনের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে রচিত হয় মিরসরাই ট্র্যাজেডি। ওই বছর ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণীয় করে রাখতে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে স্থাপন করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ ‘আবেগ’ আর দুর্ঘটনাস্থলে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিস্তম্ভ ‘অন্তিম’।