আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় নওগাঁয় এ বছর কমেছে পাটের আবাদ। তবে শ্রমিক সংকট ও আঁশ ছাড়ানোর বিড়ম্বনা এবং ন্যায্য দাম না পাওয়ায় পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অনেকে। এতে গত ৫ বছরের ব্যবধানে পাটের আবাদ কমেছে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর। তবে পাট চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে প্রনোদনাসহ সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করছে পাট অধিদপ্তর।
জেলা কৃষি অফিসের তথ্যমতে- জেলায় এ বছর ১৫০ হেক্টর আবাদ কমে ৩ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে ৯ হাজার ৬৮৫ টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। ৩ হাজার টাকা মণ হিসেবে যার বাজারমূল্য অন্তত ৭২ কোটি ৬৩ লাখ টাকার বেশি। দেশের প্রধান অর্থকরি ফসল পাট। যাকে সোনালি আঁশ নামে আখ্যায়িত করা হয়। তবে পরিশ্রমের তুলনায় গত কয়েক বছর থেকে পাটের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কৃষকরা। ফলে পাটের সে সোনালি ঐতিহ্য তা হারাতে বসেছে। তবে পাটের সেই সোনালী অতীত আবারও ফিরে আসবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষকরা জানান, প্রতি বিঘাতে পাট চাষাবাদে হালচাষ, বীজ, সার, কীটনাশক, পানি সেচ, নিড়ানি, জাগ দেওয়া ও শ্রমিকসহ ঘরে উঠানো পর্যন্ত খরচ পড়ে প্রায় ১১ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। যেখানে বিঘা প্রতি ফলন হয় ৭-১০ মণ। গত বছর ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা মণ পাট বিক্রি হয়েছিল। পাট চাষাবাদে বাড়তি খরচ, শ্রমিক সংকট ও ঝামেলা হওয়ায় আবাদ কমিয়ে ভুট্টাসহ অন্য আবাদ করা হচ্ছে। জেলার মান্দা উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামের কৃষক সালেক। গত বছর ২ বিঘা জমিতে দেশি জাতের পাটের আবাদ করে খরচ বাদে লাভ করেছিলেন অন্তত ৩০ হাজার টাকা। তবে এবছর আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ১৮ কাঠা জমিতে পাট রোপন করা হলেও বৃষ্টিতে অর্ধেকের মতো নষ্ট হয়ে যায়।
কৃষক সালেক বলেন, এ বছর পাট চাষাবাদে আবহাওয়া অনুকূলে নাই। পাট রোপনের পর এই রোদ এই বৃষ্টি। এতে করে পাটের আবাদ ভাল হয়নি। বর্তমানে খরচের টাকা উঠবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছি। আর এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে পাট চাষে আগ্রহ হারিয়ে যাবে। জেলার সদর, মান্দা, বদলগাছী ও ধামইরহাট উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলার কৃষকরা অনেক স্বপ্ন ও আশা নিয়ে পাটচাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় চারা গজানোর পর বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায়। আবার যেসব জমিতে চারা গজিয়েছে গাছ মরে ফাঁকা হয়ে রয়েছে। আশানুরূপ আবাদ ভালো না হওয়ায় এ বছর হতাশ কৃষকরা। অনেকে আউশ ও আমন ধান চাষাবাদের জন্য জমি ফেলে রেখেছেন। পাটের ন্যায্য দাম না পাওয়া ও আঁশ ছাড়ানোর বিড়ম্বনায় আগ্রহ কমে অন্য আবাদে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
উপজেলার মৈনম গ্রামের পাটচাষি আব্দুস সামাদ বলেন, এ বছর দেড় বিঘা জমিতে পাট রোপন করা হয়েছিল। রোপনের ১মাস পর বৃষ্টি হওয়ায় জমিতে শুয়ে পড়ে। এতে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রায় ৮ হাজার টাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তবে ওই জমিতে পাট হলে অন্তত ২৫-৩০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। আউশ ধান রোপণের জন্য জমি ফেলে রেখেছি।
অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোখলেছুর রহমান বলেন, গত বছর ৪ বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করে ফলন ভালো হওয়ার পাশাপাশি দামও ভালো পেয়েছিলাম। এ বছর পুরোটাই উল্টো চিত্র। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় ৩ বিঘাতে পাট রোপণ করা হয়। তারমধ্যে দেড়বিঘা নষ্ট হয়ে যায়। বর্তমানে আবহাওয়ায় ফসল চাষাবাদে উপযোগী মনে হচ্ছে না। বৃষ্টি হলে পাটের আবাদ হয় না, আবার খরা হলেও আবাদ ভালো হয় না। এতে কৃষকদের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে এবং লাভবান হতে পারছে না। বদলগাছী উপজেলার বালুভরা গ্রামের পাটচাষি আমজাদ হোসেন বলেন, পাট একটু উঁচু জমিতে ভালো হয়। মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হওয়ায় গাছ ভালো হয়েছে। ফলনও মোটামুটি ভালো হওয়ার আশা। বিঘাপ্রতি ৮-১০ মণ ফলন হয়। আশা করছি এবছরও ভালো দাম পাবো।
নওগাঁ পাট উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. আখতারুজ্জামান বলেন, পাট অধিদপ্তর থেকে এ বছর জেলায় ১০ হাজার ৫০০ জন কৃষককে প্রনোদনা হিসেবে ১ কেজি উন্নত জাতের পাট বীজ ও ১২ কেজি রাসায়নিক সার প্রদান করা হয়েছে। পাট চাষে আগ্রহ বাড়াতে চাষিদের উদ্বৃদ্ধ করা হচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ভাবে তাদের সহযোগীতা করা হচ্ছে। এছাড়া পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে সচেতনতা বাড়ানো হচ্ছে।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রতি বছরই কমছে পাটের আবাদ। কারণ হিসেবে দেখা যায় পাটের আঁশ ছাড়ানো ও ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কৃষকরা পাট চাষবাদ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তবে পাটচাষ কমিয়ে অন্য আবাদে ঝুঁকছেন কৃষক। তবে পাটের ন্যায্য দাম ও আঁশ ছাড়ানো আধুনিক কৌশল এবং সুবিধা বাড়ানো গেলে আগামীতে চাষাবাদ বাড়বে। এতে পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।