
কালের বিবর্তণে অনেক নিদর্শন হারিয়ে গেলেও মুঘল আমলের স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম এক নিদর্শন মির্জাপুর শাহী মসজিদ আজও মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে রয়েছে। পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে আটোয়ারী উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে অবস্থিত এই মসজিদটি। আনুমানিক ৩৬৯ বছর আগে স্থাপিত মসজিদটির নির্মাণশৈলীর নিপুণতা ও দৃষ্টিনন্দন কারুকার্য এখনও দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে।
মসজিদটির দেওয়ালজুড়ে ইসলামিক টেরাকোটা, ফুল ও লতাপাতার কারুকার্য খোদাই করা আছে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ধারণা অনুযায়ী, মুঘল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে (১৬৫৬ সাল) মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদের নির্মাণ সম্পর্কে মধ্যবর্তী দরজার উপরে একটি ফলকে পারস্য ভাষায় লিখিত রয়েছে। এর সামনে আয়তকার টেরাকোটার কারুকার্যগুলো একটির সঙ্গে অন্যটির সাদৃশ্যের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। মসজিদটি ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৫ ফুট প্রস্থ। একই সারিতে আছে ৩টি গম্বুজ। এর চারকোণায় আছে ৪টি মিনার। সামনে আছে ৩টি দরজা। সদর দরজা ও মাঝখানের গম্বুজের সামনের দিকে দুপাশে রয়েছে ২টি ছোট মিনার। মসজিদের ভেতরের অংশে খোদাই করা আছে ফুল, লতাণ্ডপাতা ও কোরআনের আয়াত সংবলিত ক্যালিগ্রাফি। বিভিন্ন রঙে সাজানো এসব খোদাই করা কারুকার্য। মসজিদের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য ইবাদতে মশগুল ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের হৃদয়কে আরও প্রসারিত করে।
এ ধরনের কারুকার্যমণ্ডিত নকশা মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের মসজিদ ও প্রাচীন অট্টালিকাগুলোতে দেখা যায়। মসজিদের সামনে আছে একটি খোলা স্থান। এর একপাশে আছে সুসজ্জিত পাকা তোরণ। এর উভয় পাশেই আছে আকর্ষণীয় নকশা ও খাঁজকাঁটা স্তম্ভ। তার মধ্যে চ্যাপ্টা গম্বুজ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলেছে তোরণের সৌন্দর্য। সুসজ্জিত গম্বুজের উপরে ক্ষুদ্র আকৃতির চূড়া তোরণটিকে রুপের ১৬ কলা পূর্ণ করে দিয়েছে। এ মসজিদের পাশেই আছে একটি নুরানী মাদ্রাসা। সামনের দিকে আছে প্রাচীন আমলের একটি অব্যবহৃত কূপ। এছাড়াও তোরণের সামনের দিকে আছে একটি পুকুর। যেখানে শিশু-কিশোর ও এলাকাবাসীরা গোসল করতে পারে। মসজিদটির নামকরণ নিয়েও আছে নানা ইতিহাস।
ফলকের ভাষা ও লিপি অনুযায়ী ধারণা করা হয়, মুঘল সম্রাট শাহ আলমের রাজত্বকালের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। কেউ মনে করেন, মুঘল শাহজাদা আজমের সময়কালে (১৬৭৯ সাল) নির্মিত ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণের মসজিদের সঙ্গে এই মসজিদের নির্মাণশৈলীর সাদৃশ্য আছে।
স্থানীয়দের কাছে জানা যায়, মালিক উদ্দিন নামে মির্জাপুর গ্রামের এক ব্যক্তির উদ্যোগেই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এই মালিক উদ্দিন মির্জাপুর গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা। তার বন্ধু মোহাম্মদ নামের এক ব্যক্তি মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এলাকাবাসীরা জানান, মসজিদটি নির্মাণের দীর্ঘ প্রায় ৩৬৫ বছর পার হলেও কোথাও উল্লেযোগ্য ত্রুটি চোখে পড়েনি।একসময় প্রবল ভূমিকম্পে মসজিদটির বেশ কিছু অংশ ভেঙে যায়।
তখন মির্জাপুর গ্রামের বাসিন্দা মালিক উদ্দীন ইরান থেকে কারিগর নিয়ে এসে মসজিদটি সংস্কার করেন। তখন থেকে আর সংস্কার হয়নি। বর্তমানে মসজিদটির দেওয়ালে ও গম্বুজে কিছুটা ফাটল ধরেছে। এছাড়া ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় পলেস্তারাও অল্প অল্প খসে পড়েছে। মির্জাপুর শাহী মসজিদের নিপুণ কারুকার্য, সোন্দর্য্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভ্রমণ পিপাসুদের তৃষ্ণার্ত হৃদয়কে যেনো প্রশান্তি দেয়। মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণে এলাকাবাসীর পাশাপাশি সরকারের সহযোগীতা জরুরি বলে মনে করেন স্থানীয়রা।