১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট, বাংলা ২৬শে শ্রাবণ, ১৩২৯ তারিখ শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রকাশিত হয় একটি পত্রিকা। পত্রিকার সাইজ ফলিও ১৫” ী ১০”। পৃষ্ঠা সংখ্যা আট। মূল্য এক আনা। মেটকাফ প্রেসের মণি ঘোষের ছাপাখানা থেকে প্রকাশ পাওয়া পত্রিকাটির প্রকাশক ও মুদ্রাকর ছিলেন আফজাল-উল হক। কর্মসচিব ছিলেন শান্তিপদ সিংহ। অমর যৌবনের আগ্নেয় দুর্দান্তকে সঙ্গী করে ২২ বছরের এক টকবগে তরুণের হাতে ধরে পরাধীন ভারতবর্ষে উদিত হয় এক নতুন ‘ধূমকেতু’। ধূমকেতুর সারথি হয়ে হাবিলদার কবি কাজী নজরুল দৃপ্তস্বরে উচ্চারণ করেন, দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে ‘ধূমকেতু’ হবে আগুনের সম্মার্জনী।
৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত এই পত্রিকাতেই প্রথম লিখিত আকারে ঘোষণা করা হয় (১৩২৯ সালের ২৬শে আশ্বিন, ১৯২২ খ্রি.) ‘ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চাই’।
ধূমকেতুর উদ্দেশ্য সম্পর্কে নজরুল প্রথম সংখ্যায় জানিয়েছিলেন, ‘মাভৈঃ’ বাণীর ভরসা নিয়ে জয় প্রলয়ঙ্কর’ বলে ‘ধূমকেতু’কে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হলো। আমার কর্ণধার আমি। আমার যাত্রা-শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি-নমস্কার করছি, আমার সত্যকে।...
সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের অচলায়তনকে ভেঙেচুরে নূতন যুগ চেতনার সংকল্প এবং রবীন্দ্রনাথের আর্শিবাদ বাণী নিয়ে ‘ধূমকেতু’ আবির্ভূত হয়। সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার শীর্ষে লেখা থাকতো-
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু/
আয়, চলে আয় রে ধূমকেতু/
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’
ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে নজরুল তার বিখ্যাত ‘ধূমকেতু’ কবিতা প্রকাশ করে সম্পাদকীয় পাতা সমৃদ্ধ করেন। কবিতার প্রতিটি স্তম্ভে নজরুল অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার ক্ষোভানল উগরে দিয়ে বিদ্রোহের চিরন্তনতা প্রকাশ করে বলেন :
আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুন : মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।
ধূমকেতুতে প্রকাশিত প্রবন্ধসমূহ রুদ্রমঙ্গল’ ও ‘দুর্দিনের যাত্রী’ পুস্তক দুটিতে সংগৃহীত হয়। নজরুল ‘ধূমকেতুতে অনেকগুলো অগ্নিবর্ষী প্রবন্ধ লিখে জাতির স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছেন। নবযুগ’ পত্রিকায় কবি মেহনতী জনসমাজের জন্য কলম ধরেছিলেন।
ধূমকেতু পত্রিকায় তার লক্ষ্য ছিল মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজ। অসহযোগ ও অহিংস আন্দোলনের জন্য তখন বৈপ্লবিক আন্দোলন চাপা পড়ে গিয়েছে। মানুষের বিশ্বাসে চির ধরেছে। শোষণের নাগপাশকে গলায় ঝুলিয়ে সাধারণ মানুষ গতানুগতিক জীবনেই খুঁজে চলছিলেন জীবনের দিশা। তাদের শান্তিপূর্ণ জীবনে অকল্যাণ ঘোষণা করে বিপ্লবের ধ্বজা উড়িয়ে দেয় ধূমকেতু। ধূমকেতুর অগ্নিঝরা পুচ্ছ- তাড়নায় ও ভাঙনের জয়গান করতে এগিয়ে আসেন ভূপতি মজুমদার, বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ রায়, মঈনুদ্দীন হোসেন, নলিনীকান্ত সরকার, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন।
ধূমকেতুর আবির্ভাবকে স্বাগত জানিয়ে ৩০শে আগস্ট (১৯২২) তারিখে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় লেখা হয়,
“Dhoomketu”: -We cordially welcome the advent of our contemporary, the Dhoomketu”, A bi-weekly edited by Nazrul Islam published from 32, College street, Calcutta. He has alreadz made his mark as a powerful poet and some of his great verses, particularly the ‘Bidrohi’ are among the most well-known in th literature. The articles from the editorial pen in the ‘Dhoomketu’ tain the reputation of the soldier-poet and the collections he has to make are in tune with the fire and energy of his own writings.
ধূমকেতু শুধু ধ্বংসের প্রতীক না হয়ে স্থায়ী ও পবিত্র কিছু সৃষ্টি করতে সমর্থ হবে অমৃতবাজার পত্রিকায় এই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ‘ধুমকেতু’ ‘বিজলী’, শঙ্খ’ ও ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকাকেও ছাড়িয়ে যায়। যেদিন ‘ধুমকেতু উদিত হতো, তখন যে উত্তেজনা দেখা দিত তা ছিল অভাবনীয়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই দুই হাজার কপি বিক্রি হয়ে যেত। পত্রিকা বের হওয়ার আগেই হকার অগ্রিম দাম দিয়ে যেত। মোড়ে মোড়ে তরুণের দল জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকত। চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরম বক্তৃতা চলত। ছাত্র হোস্টেলে পরদিন পর্যন্ত একমাত্র আলোচ্য বিষয় থাকত ধূমকেতু। দুইশ’ বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা জাতিকে ধাক্কা মেরে জাগ্রত করে তুলেছিল ‘ধূমকেতু’।
কবি ও সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তার স্মৃতিচারণায় বলেন, ‘বিকেলবেলা আরো অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, হকার ধূমকেতু’র বাণ্ডিল নিয়ে আসে। হুড়াহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্য। কালির বদলে রক্ত দিয়ে লেখা এসব সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, সঙ্গে ‘ত্রিশুলের আলোচনা। সে কী দাহ! একবার পড়ে বা শুধু একজনকে শান্ত করবার মতো সে লেখা নয়। যেমন গদ্য তেমনি কবিতা।’
‘ধুমকেতু’ মুষড়েপড়া বৈপ্লবীক আন্দোলনকে অনেক পরিমাণে উদ্দীপ্ত ও শক্তিশালী করে তুলেছিল। অনুশীলন ও যুগান্তর পার্টির অনেক নেতা ‘ধূমকেতুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। গোপীনাথ সাহা ছাড়াও আরো অনেক বিপ্লবীরা উৎসাহ ও প্রেরণা লাভের জন্য আসতেন ‘ধূমকেতু’র অফিসে।
ধূমকেতু ৯ম সংখ্যা (২৯শে ভাদ্র, ১৩২৯ সাল) নজরুলের ‘মেয় ভুখা হুঁ’ প্রবন্ধ পড়ে বিদেশি সরকারের টনক নড়ে ওঠে। অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার নজরুলের কণ্ঠরোধ করার ফন্দি ফিকির খুঁজতে থাকেন। নজরুল ভয়হীন চিত্তে অগ্নিগর্ভ প্রবন্ধ, কবিতা, হাস্যকৌতুক প্রভৃতির মধ্য দিয়ে একদিকে শাসকশ্রেণির অত্যাচার, অবিচার ও শোষণ এবং অপরদিকে হিন্দু-মুসলমান সমাজের জড়তা, দুর্নীতি ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তার শক্তিশালী লেখনী চালিয়ে যেতে থাকেন।
ধূমকেতুর পূজা সংখ্যায় ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ নজরুল প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’।
পরমা প্রকৃতি দেবী দুর্গার আগমন হয় মহিষাসুর বধের জন্য। ব্রহ্মা, শিব, বিষ্ণু, ইন্দ্র প্রমুখ দেবতার দেহ থেকে তেজরাশির নারীরূপ হলেন দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গা প্রথমে অষ্টাদশভূজা উগ্রচন্ডীরূপে এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার দশভূজা দুর্গারূপে মহিষাসুরকে তিনবার বধ করেন। দুর্গার তেজস্বিনী রূপ ও অসুর নিধনকারী দনুজদলনী অবিনাশিনী চণ্ডীরূপকে কবি আহ্বান জানান।
‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি পৌরাণিক আবহমণ্ডলে রচিত হলেও কবিতাটি দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির এবং ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে স্মরণীয় ম্যাগনাকার্টা রূপে পরিগণিত হয়। কবিতাটিতে দেশপ্রেমীদের নিষ্ক্রিয়তা এবং অহিংসার নামে পৌরুষের হীনতার প্রতি ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করে কবি দেশপ্রেমের বন্দনা করে যান।
কবিতাটির সূচনা হয় দেবতা ও অসুরের পৌরাণিক কাহিনিকে কেন্দ্র করে। অসুররাজ মহিষাসুর যেমন করে দেবতাদের নিজ রাজ্য অর্থাৎ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন, তেমনি ব্রিটিশরাজ অত্যাচারী ‘চাড়ালের’ রূপ ধারন করে দেশমাতৃকাকে দখল করে নিয়েছে। স্বর্গরাজ্যের মতো মাতৃভূমিকেও রাহুগ্রাস হতে মুক্ত করার জন্য কবি দেবী দুর্গাকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন- ‘দেবসেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে’ অর্থাৎ বিপ্লববাদীরা আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হয়ে অত্যাচার সহ্য করছে; ‘বিষ্ণু নিজে বন্দি আজি ছয় বছরী অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন ও অহিংসা সত্যাগ্রহের কারণে ১৯২২ খিষ্ট্রাব্দে ৬ বছরের জন্য প্রেপ্তার বরণ করেছেন; আর বিপ্লবী শ্রীঅরবিন্দ কারামুক্ত হয়ে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে অধ্যাত্ম সাধনায় মনোনিবেশ করেছেন। ‘মহেশ্বর আজ সিন্ধুতীরে যোগাসনে মগ্ন ধ্যানে ‘অরবিন্দ চিত্ত তাহার’ বাক্যাংশে শ্রীঅরবিন্দের বিপ্লবী চেতনার উল্লেখ করেছেন। সদ্য অসর গ্রাস চুক্ত ব্রহ্মা চিত্তরঞ্জন’ অর্থাৎ ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কারামুক্ত হন এবং ‘কম-লুর শান্তি বারি সিঞ্চি যেন চাঁদ নদীয়ায়’ বলতে চিত্তরঞ্জনের বৈষ্ণবভাবাপন্ন হয়ে স্বদেশ আন্দোলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
সমকালীন ইতিহাসের রূপায়ণও কবিতায় প্রায় প্রত্যেকটি ছত্রে উপলব্ধি করা যায়। সুরেন্দ্র আজ মন্ত্রণা দেন অর্থাৎ সমকালীন স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক ভূমিকার সমালোচনা করেছেন। সুরেন্দ্রনাথ সসম্মানে সিভিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও যোগদান করেননি। দেশের স্বাধীনতার জন্য রাজনীতিতে যোগদান করেন। কিন্তু অর্থের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইংল্যান্ডে ভারতীয় সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন ।
রবি শিখা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে আজ দিগান্তরে- বাক্যাংশে নজরুল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনা করেন। বিশ্ব কবিসম্রাট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরস্কার পেয়ে সাহিত্যের আঙ্গিনা আলোকিত করেন। নোবেল পুরস্কার লাভের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক খ্যাতি বিস্তৃতি লাভ করলেও বিপ্লবীদের আদর্শের প্রতি রবীন্দ্রনাথের সমর্থন না থাকায় নজরুল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বুড়িগঙ্গার পুলিন বুকে বাঁধছে ঘাঁটি দস্যু রাজায়- বাক্যাংশে অনুশীলন দলের কার্যক্রমে নজরুল ক্রোধান্বিত হন। বাংলাদেশের বিপ্লবগুরু পুলিন বিহারী কারাগারে বন্দি থাকলেও বিপ্লবীদের তৎপরতার অভাবের দিকটি কবি উল্লেখ করেছেন।
খেলাফত আন্দোলন পরবর্তী মুসলমান সমাজের অবস্থা এবং সমসাময়িক হিন্দু সমাজও নজরুল ইসলামের সমালোচনা থেকে রক্ষা পায়নি। তাদের ধর্মাচারের নামে কাপুরুষতা ও ভীরুতা নজরুলকে বেদনাবিদ্ধ করেছে। পরাধীন ভারতবর্ষ ও ভারতবাসী নজরুলের দৃষ্টিতে ‘দানবের রংমহলে তেত্রিশ কোটি খোজা গোলাম’। তারা শুধু লাঞ্ছিত অত্যাচারিত। তাই কবির প্রার্থনা :
‘হান, তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা।
এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরে অনেকেই নজরুলের উপর বিশেষভাবে রাগান্বিত হন। কবিতায় নজরুল ইসলামের আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে যৌবনের পৌরুষ ও বলিষ্ঠতার জন্য। সমগ্র বিপ্লবীদের প্রেরণা দিতে, তাদের স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করার জন্য লেখা এই কবিতাই তার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহমূলক মোকদ্দমা আনা হয়। আদালতে প্রকাশক আফজালুল হক তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন। বিচারে নজরুল এক বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। শেষ হয় নজরুলের ধূমকেতু অধ্যায়।
লেখক : কলামিস্ট