ঢাকা শুক্রবার, ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

গৃহস্থালি ব্যয় : সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ

খন্দকার আপন হোসাইন
গৃহস্থালি ব্যয় : সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ

বাংলাদেশে গৃহস্থালি ব্যয়ে পরিবর্তন এসেছে। রূপান্তর ঘটেছে গৃহস্থালি কাঠামোতে। গ্রামীণ সভ্যতায় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটছে। প্রতিফলন ঘটছে সমাজের জীবনযাত্রা ও মানুষের মনোভাবেও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে গৃহস্থালি ব্যয়ের খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। খাদ্য ব্যয়ের হার কমেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বেড়েছে। গৃহস্থালি ব্যয়ের পরিবর্তিত রূপ সমাজ, অর্থনীতি ও জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব ফেলছে। প্রথাগতভাবে বাংলাদেশের গৃহস্থালির অধিকাংশ ব্যয় খাদ্য খাতে ছিল। ২০১০ সালে একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয়ের ৫৬ শতাংশ খাদ্য খাতে ব্যয় হতো।

বর্তমানে, ২০২৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী খাদ্য ব্যয়ের হার কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এ পরিবর্তন জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এর পেছনে রয়েছে আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টা, সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি ও ভিন্ন ভিন্ন খাতে ব্যয় করার প্রবণতা। বিশ্বব্যাংকের ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আয় বৃদ্ধির ফলে মানুষের খাদ্য ব্যয়ের তুলনায় চিকিৎসা, শিক্ষা এবং প্রযুক্তি খাতে ব্যয় বেড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে খাদ্য ব্যয়ের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক কমেছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং রেস্টুরেন্টে খাবারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে অভিভাবকদের ব্যয় দিন দিন বেড়ে চলেছে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসন সীমিত।

আবার গ্রামাঞ্চলে মানসম্মত শিক্ষার অভাব স্পষ্টত দৃশ্যমান। এ কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক অবস্থান নিয়ে গ্রামের মানুষের শিক্ষা ব্যয় বাড়াচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচ্চ ব্যয় সাধারণ মানুষের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মাসিক শিক্ষা ব্যয় গড়ে ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা। কোচিং সেন্টার ও প্রাইভেট টিউটরদের উপর নির্ভরতা বেড়েছে ৭৩ শতাংশ। শিশুদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে ব্যয় বেড়েছে ৬০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তবে এই ব্যয় অনেক পরিবারকে আর্থিক চাপে ফেলছে। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করার জন্য শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত খরচ বাড়ছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা সীমিত। বাধ্য হয়েই অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মানেই অস্বাভাবিক ব্যয়। ব্যয়ের এই অসম ভারসাম্য সামলাতে হিমশিম খেতে হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত ক্রমেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর সীমাবদ্ধতার কারণে মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল সেবার দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু বেসরকারি সেবায় উচ্চ ব্যয়ের কারণে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য খরচ মেটাতে তাদের সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হচ্ছে। ১০ শতাংশ পরিবার ঋণ করে চিকিৎসা খরচ মেটাচ্ছে। বিশেষত দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ ইত্যাদির চিকিৎসা ব্যয় আগের তুলনায় ৭৮ শতাংশ বেড়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় আরও বেড়েছে। বহু পরিবারকে তাদের আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যয় করতে হয়েছে চিকিৎসা সেবার জন্য। ফলে প্রতিনিয়ত তাদের আর্থিক সংকট বাড়ছে তো বাড়ছেই। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বাংলাদেশের জীবনযাত্রায় বিপুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এক সময় যেখানে মানুষ বিনোদন বলতে সিনেমা হল বা টিভি দেখাকে বুঝত, এখন সেটি অনলাইন স্ট্রিমিং, গেমিং এবং সোশ্যাল মিডিয়া দখল করে নিয়েছে।

২০২৫ সালে মোবাইল ডাটার খরচ গড়ে পরিবারের মাসিক ব্যয়ের ৮ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনলাইন স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে সাবস্ক্রিপশন খাতে ব্যয় বেড়েছে ১৫০ শতাংশ এবং স্মার্টফোন ও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের পেছনে ব্যয় আগের তুলনায় তিনগুণ বেড়েছে। এই পরিবর্তনটি তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব এবং ডিজিটাল সেবার প্রতি মানুষের আগ্রহের পরিচায়ক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত