বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনে বহু যোগ্য কর্মকর্তাকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ দেয়নি। এতে মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেননি যোগ্য কর্মকর্তারা। এসব বঞ্চিত কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাঠ প্রশাসনে বড় পরিবর্তন আনছে জনপ্রশাসন। এই পরিবর্তন আনতে গিয়ে বির্তক তৈরি হয়। সেই বিতর্ক এড়াতে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয় জনপ্রশাসনকে। এবার মাঠ প্রশাসনে ডিসি, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগে সেই বিতর্ক এড়াতে চায়। সুবিধাবঞ্চিত যোগ্য কর্মকর্তাদের ডিসি পদে নিয়োগ দিতে এগিয়ে যাচ্ছে জনপ্রশাসন। এই নিয়োগে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২৫, ২৭ ও ২৮তম ব্যাচের ৫০৯ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে ২৫তম ব্যাচের ১৩৪ জন, ২৭তম ব্যাচের ২০৫ জন এবং ২৮তম ব্যাচের ১৫৮ জন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা দেশে মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের নিয়ে বিতর্ক থাকা উচিত নয়। বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত পাল্টালে প্রশাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে নিয়োগ দিতে হবে।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিসিদের পাল্টাতে গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন। এই নিয়োগে বঞ্চিতরা অভিযোগ তুলে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল করেন। নিয়োগপ্রাপ্ত কয়েকজন ডিসিকে নিয়ে আপত্তি তোলেন উপসচিবরা। বঞ্চিত কয়েকজন উপসচিবের অভিযোগ, ডিসি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তদের অনেকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং সাবেক মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব কেএম আলী আযম ও জিয়াউদ্দিনের কক্ষে হট্টগোল করেন বঞ্চিতরা। দুই যুগ্মসচিবের কক্ষ অবরুদ্ধ করেন। তাদের রোষানল থেকে বাঁচতে যুগ্মসচিব আলী আযম পাশের রুমের টয়লেটে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর সিনিয়র কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে তাকে বের করে আনেন। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নিয়োগ পাওয়া ৫৯ জন ডিসির মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর নয়জনের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে চার জেলার ডিসি পদে রদবদল আনা হয়। এরপর খালি হওয়া পদে নতুন নিয়োগ দেয়া হয়।
২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর ডিসি নিয়োগে নতুন পদায়ন নীতিমালা জারি করে সরকার। এতে বলা হয়, বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের কর্মচারীদের মধ্য থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্তির এক বছর পর জেলা প্রশাসক পদে পদায়নের জন্য ফিটলিস্ট প্রণয়ন করা হবে বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। ফিট লিস্টে থাকা কর্মকর্তাদের উপ-পরিচালক, স্থানীয় সরকার/অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক/সচিব, জেলা পরিষদ/প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, পৌরসভা এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার উভয় পদে মোট কমপক্ষে ২ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনের রেকর্ড এবং পুরো চাকরি জীবনের শৃঙ্খলা প্রতিবেদন সন্তোষজনক হতে হবে। প্রকল্প ও ক্রয় ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত জ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা থাকতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হতে হবে। জেলা প্রশাসক পদের ফিটলিস্ট প্রণয়নে আগের মতোই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে কমিটি থাকবে। নিজ জেলা বা স্বামী/স্ত্রীর জেলায় জেলা প্রশাসক পদে পদায়ন করা যাবে না বলে নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ডিসি নিয়োগে নীতিমালা তৈরি করলেও বহু যোগ্য কর্মকর্তাদের ডিসি পদে নিয়োগ দেয়নি। ফলে মাঠপর্যায়ে দুই বছর কাজ করার সুযোগ পাননি। মাঠ প্রশাসনে দুই বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়াই এবার ডিসি পদে নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তালিকাতেও এ শর্ত শিথিল করা হয়েছিল। আগামী ডিসি ফিটলিস্ট না হওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে।
সূত্রে জানা গেছে, দেশের ২৬ জেলায় ডিসি পদে রদবদল আসছে। মার্চের মধ্যে নতুন ফিটলিস্ট তৈরিতে ইউএনও ও এডিসি পদের কাজের অভিজ্ঞতার শর্ত শিথিল থাকবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, বঞ্চিতদের নিয়োগ দিতে এমন সিদ্ধান্ত। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বাবুল মিঞা বলেন, বর্তমানে জেলা প্রশাসক পদে ২৪ ব্যাচের ২৬ জন, ২৫ ব্যাচের ২৬ জন আর ২৭ ব্যাচের ১২ জন কর্মরত আছেন। ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির ফিটলিস্ট হচ্ছে। ফলে এই ব্যাচের সবাইকে মার্চের মধ্যে সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এসব জেলায় ডিসি পদে নিয়োগের জন্য ২৫, ২৭ এবং ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের ফিটলিস্ট করা হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে কাজ না করলেও ডিসি হতে পারবেন। তবে মাঠ প্রশাসনের যে কোনো পর্যায়ের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলছেন, যোগ্য-সৎ কর্মকর্তাদের বাছাই করে ডিসি নিয়োগ দিতে হবে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে কাজ না করলেও ডিসি হতে পারবেন। কিন্তু ইকোনমিক ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়া কর্মকর্তারা ওই দুই পদে কাজ না করে ডিসি হতে পারবেন না। এছাড়া লিয়েনে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের লিয়েনের মেয়াদ ছয় মাসের বেশি, তারা ফিটলিস্টে অন্তর্ভুক্ত হবেন না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ওবায়দুর রহমান বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গত ১৫ বছরে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা পদবঞ্চিত ছিলেন। ফলে অনেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদে দুই বছর কাজ করার সুযোগ পাননি। এজন্য মাঠ প্রশাসনের এসব পদে দুই বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডিসি পদে নিয়োগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সাবেক সচিব একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, মাঠ প্রশাসনে কাজের অভিজ্ঞতা ছাড়াই ডিসি নিয়োগ পেলে কাজ করা কঠিন হতে পারে। কারণ, মাঠের কাজের ধরন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।